তিরিশে মে, ২০২১।
শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। কি যেন একটা অসোয়াস্তি। সারা গা হাত পা টনটন করছে, ছিঁড়ে পড়ছে মাথা। নিজেই বুঝতে পারল গা বেশ গরম। মনোজিৎ ঘুমোচ্ছে পাশেই। শিউরে ওঠে সে – সব্বোনাশ, এখনও প্রতিদিন এগারো হাজারের উপরে কোভিড কেস ধরা পড়ছে। এই সময়ে জ্বর, মাথা যন্ত্রণা। আর কি বাকি রইল। দ্রুত নিজের ফোন আর চাবি নিয়ে একতলার অতিথি-ঘরে নেমে আসে সে। ঠিক ছ’দিন আগে স্কুলে গিয়েছিল নন্দিনী – অসহ্য গরমে ভিড়, চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি – কিসের সামাজিক দূরত্ব, কিসের মাস্ক! কি হবে এখন? তার সন্তান, স্বামী, বাড়িতে বয়স্কা শাশুড়ী….তার উপরে মনোজিৎ স্মোকার, ভারী চেহারা। দরদর করে ঘামতে থাকে সে। কিছু মাথায় আসছে না। মোবাইল খুলে সরকারি হেল্পলাইন খোঁজে। আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে? ভর্তি হতে হবে? হাসপাতাল ত সব ভর্তি। বাড়িতে থাকবে নিচের ঘরে একা একা? যদি শ্বাসকষ্ট হয়? অক্সিজেন পাওয়া যাবে ত? সে কি মারা যাবে? যেতেই পারে – দ্বিতীয় দফায় ত কম বয়সেই মরে যাচ্ছে কত মানুষ, আর সে ত চল্লিশ। মৃত্যু লেখা থাকলে কিছু করার নেই, কিন্তু পিকু, মনো… এদেরও যদি হয় তার থেকে? উঃ ভগবান, এ কী করল সে? সেইদিন একটু সাবধান হতে পারল না? আসন্ন বিপর্যয়ের আভাসে একলা ঘরে বসে কাঁপতে থাকে নন্দিনী।
ইতিমধ্যে আকাশে আলো। প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে নন্দিনী তার সতের বছরের স্থায়ী হেল্পলাইনে ফোন করে। সাতসকালে মোবাইলের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসে মনোজিৎ। নন্দা ফোন করছে! ভোরবেলা! কোত্থেকে? ব্যাপারটা কি হল! কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। “হ্যালো। কোথায় তুমি? কি ব্যাপার?”
“নিচে এসো। না না, এমনি এসো না, দুটো মাস্ক পরে তবে নামবে। আর বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ড় সব তুলে ফেল। তারপর হাত ধোও সাবান দিয়ে। তারপর এসো নিচে।”
“মাস্ক পরব? নিজের বাড়িতে? সক্কালবেলায়? বিছানার চাদর তুলব? কেন?” চোখ কচলাতে কচলাতে প্রশ্ন করে মনোজিৎ।
“আমার করোনা হয়েছে। আর বাঁচবো না” – কত বছর পরে জানা নেই নন্দিনীর, ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে সে।
“কাঁদে না পাগলি, আমি আসছি এক্ষুণি। কিচ্ছু হবে না।”
পরের দু’ দিনের ইতিহাস সংক্ষেপে এইরকম। সকালে প্রাইভেট ল্যাবরেটরি থেকে লোক ডেকে বাড়ির সকলের পরীক্ষা। দুপুর থেকে নন্দিনীর গলায় ব্যথা, কাশি। শাশুড়ী রান্না করেন, মনোজিৎ মাস্ক পরে নন্দিনীর দরজার সামনে খাবার দিয়ে যায়। মাঝসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পিকু ছলছল চোখে তার মা কে দেখে। পরদিন সকালে নন্দিনীর রিপোর্ট পজিটিভ, বাকি তিনজনের রেহাই। সরকারি হেল্পলাইন থেকে ফোন করে মেলে চার-পাঁচ রকমের ওষুধের নাম আর বিপদে সাহায্যের আশ্বাস। পাড়ার দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়ে ‘এ ত করোনার ওষুধ! কার হল দাদা?’ দোকান থেকে পাড়ায় পাঁচকান। কাজের দিদিদের আসা বন্ধ। স্বাস্থ্য দপ্তর, করপোরেশন থেকে ফোন, কাউন্সিলরের পিএ-র ফোন। বাড়িতে স্যানিটাইজার টিম হাতকামান হাতে। মনোজিৎ দোকান-বাজারে বেরোলে পাড়ার মানুষের নীরব আপত্তি, চোখ চাওয়াচাওয়ি। সলিটারি সেলে ফাঁসির আসামীর মত একাকিনী অসুস্থ, অবসন্ন নন্দিনী। ওষুধ খায়, পালস্ অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন দেখে, ক্লান্ত শরীরে শুয়ে থাকে। এ এমন রোগ, যাতে প্রিয়তম জনও কাছে আসতে পারে না, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারে না। দিশাহারা গোটা পরিবার, নন্দিনীর মা-ভাই। কি হবে কে জানে।
পয়লা জুন ঘুম ভাঙতেই নিচে নামল মনোজিৎ, যেমন নেমেছিল কালও। সোফায় বসে হাঁফাচ্ছে নন্দিনী। ঘর্মাক্ত, চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
“এসো না, প্লিজ এসো না। দোহাই তোমার। অন্তত তোমরা ভালো থাকো।” – এই অবস্থাতেও স্বামীকে কাছে আসতে বাধা দেয় সে।
দরজার চৌকাঠে আটকে যায় মাস্ক পরিহিত মনোজিৎ। কিছু কিছু নিষ্ঠুর মুহূর্ত মানুষকে বুঝিয়ে দেয় সে সবচেয়ে ভালোবাসে নিজেকেই। তাছাড়া, সে সংক্রামিত হলে নন্দিনীকে, ছেলে-মাকে দেখবে কে? তাকে ত সুস্থ থাকতেই হবে।
“কখন থেকে এরকম হচ্ছে? স্যাচুরেশন দেখেছ?”
“রাত থেকেই। এইট্টির আশপাশে – আটকে আসতে থাকা শ্বাসের মধ্যেই উত্তর দেয় নন্দিনী।
“তুমি-তুমি আমাকে ডাকবে ত? এইভাবে কষ্ট পাচ্ছ নিচে একা, আর আমি…সবসময় উল্টোপাল্টা কাজ… “
চিরকালের গোছানো মনোজিৎ তৈরীই ছিল এহেন সম্ভাব্য বিপর্যয়ের জন্য। তাছাড়া তিন-চার সপ্তাহ আগের সেই হাহাকারময় পরিস্থিতি – বেড নেই, অক্সিজেন নেই – তারও উন্নতি হয়েছে একটু। কার্ভ নামছে দ্রুত। সরকারি হেল্পলাইনে ফোন করে সে – ভাগ্যক্রমে টালিগঞ্জে এম আর বাঙুর হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা হয়। একঘন্টার আগেই সাদা-নীল পিপিই কিট আর মুখোশ পরা দুজন মানুষ এসে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে নিয়ে যায় নন্দিনীকে – গ্রহান্তরের প্রাণী আর তাদের ক্যাপসুল স্পেসশিপের মত। সে গাড়িতে কারুর ওঠার হুকুম নেই, নিকটতম জন হলেও না। তাছাড়া, সত্যিই কি কেউ উঠতেও চায় – প্রাণ যে বড় আপন ধন।
নিজের গাড়িতে পিকুকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের অনুগমন করে মনোজিৎ। জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি সেদিন সকালে প্রাক্-বর্ষার ধারা। কাঁচের বাইরে বৃষ্টি, ভিতরে কিশোর পিকুর নীরব অঝোর অশ্রুপাত। একবার শুধু সে বলে – “বাবা, মা যে ডায়াবেটিক”। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে মনোজিৎ, আরও যেন বেশি সজাগ হয়ে যায় তার হাত-পা, চোখ-কান, তাকে ঠিক থাকতেই হবে। পিকু যে এখনও ছোট। হুটার বাজানো অ্যাম্বুল্যান্সের সাথে তাল রাখা মুশকিল – তবু দু একটা সিগন্যালে কখনও সখনও পাশাপাশি আসে দুটি গাড়ি। রোগিণী আর তার আপনজনের মাঝে নীরব দৃষ্টি বিনিময় হতে থাকে। দু তরফেই আশঙ্কার কালো মেঘ চোখের সামনে – এই কি তবে শেষ দেখা! দু তরফেই আকুতি – এভাবে যেন শেষ না হয়।
হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে এক ঝলক দেখা করিয়েই নন্দিনীকে দ্রুত ভিতরে নিয়ে যান কর্মীরা। থমথমে পরিবেশ, পিপিই কিট পরা মানুষের খসখসে চলাচল। হাসপাতালের পরিবেশ কখনওই সুখকর নয়, কিন্তু এই কাল-মহামারীর কালে সর্বত্র যমরাজের দীর্ঘ, অশুভ ছায়া। দূুরের একটা দরজা দিয়ে সাদা-নীল বস্তাবন্দী তিনজনর মানুষের মৃতদেহ তোলা হচ্ছে গাড়িতে। একই রংয়ে সর্বাঙ্গ আবৃত বহনকারীর দল, চালক। সাদা রং যে এত বিভীষিকাময় হতে পারে, এ দৃশ্য দেখার আগে কখনও ভাবতে পারেনি মনোজিৎ। নিস্তব্ধতার মাঝে একটি মেয়ের বুক ফাটানো আর্তনাদ – “আ-ব্বা-জা-ন”। সে শিউরে ওঠে – তাদের পিকুকেও কি তবে একদিন এখানে এভাবেই….. তা কেন, কত কত মানুষ ত রোজ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন কো-মর্বিডিটি নিয়েও। সরকারি হাসপাতাল হলেও এম আর বাঙুর রীতিমতো সুনাম করেছে কোভিড চিকিৎসায়। দৈনন্দিন জীবনে ততটা ভক্ত মানুষ নয় মনোজিৎ। তাও যেন চোখ বুজে একবার কাকে স্মরণ করে। তারপরে ছেলেকে বলে -“চল্। বিকালে খোঁজ নিতে আসব আবার।”
তারপরের এগারো দিন বুকে পাথর বাঁধা উৎকণ্ঠা, প্রতীক্ষা আর আকুল প্রার্থনা। রোগীর সাথে দেখা করা বারণ, মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ। দুবেলা পার্টি মিট – তাতে মূলত দুটি সংখ্যা। প্রথমটি বেড নম্বর, দ্বিতীয়টি অক্সিজেন স্যাচুরেশন কত আর সেটা কি পদ্ধতিতে। এছাড়া এদিক উদিক আয়ামাসি বা ভাইদের ধরে একটু চায়ের পয়সা দিয়ে খবর চালাচালি – ‘তুমি কেমন আছ? আমরা ঠিক আছি।’ শুরুতে হাই-ফ্লো অক্সিজেন, দুদিন পরে আই সি সি ইউ তে বাইপ্যাপ, পাঁচদিন পরে বাইপ্যাপ থেকে আবার অক্সিজেন, শেষ দুদিন বিনা অক্সিজেনে কাটিয়ে, এই ক’দিনে চোখের সামনে অন্তত কুড়িজন মানুষকে প্যাকেটবন্দী লাশে পরিণত হতে দেখে, মনে চিরস্থায়ী দগদগে ক্ষত নিয়ে এগারো দিনের কোভিড-যাত্রা শেষ করে নন্দিনী। হাসপাতালের দরজায় গাড়ি নিয়ে মনোজিৎ-পিকু। চোখে জল নিয়ে ছেলের সামনে সম্বরণ ভুলে হাসতে হাসতে নন্দিনীকে যেন সেই কলেজের দিনের মতই বলতে থাকে মনোজিৎ -“কিরে ছাগলি, ভেবেছিলিস আমাকে ছেড়ে পালাবি? আমি তোর সিনিয়র না?” মায়ের প্রতি এই অশ্রুতপূর্ব সম্বোধন শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পিকু।
বাড়ি ফিরেও অশেষ ক্লান্তি। সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম। একতলার ঘরে নিয়মমতো সাতদিন আইসোলেশনে কাটিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ পরে দোতলায় নিজের ঘরে ওঠে নন্দিনী। প্রিয় ঝুলবারান্দার দিকে চোখ পড়ে তার। আশ্চর্য! এতদিন তার একবারও মনে পড়েনি! এও সম্ভব? ছি ছি! মানুষ তবে নিজেকেই এভাবে আঁকড়ে ধরে প্রাণসংশয় হলে!
মনোজিৎ যথারীতি টিভিতে খেলা দেখছিল।
“এই, শোনো না, এ কে আরের কোনও খবর জানো? অবশ্য তুমি কি আর আমার মতো বারান্দায় বসে থাকবে ওনার জন্য? তাও ত একটু খেয়াল করতে পারতে – চেম্বারে আসছেন কিনা। কি গো, দেখেছ একদিনও? বলো না।”
টিভির আওয়াজ বন্ধ করে দেওয়ালে গণেশের ছবিতে মনোনিবেশ করে মনোজিৎ। ডান হাত মুঠো করে নাকের নিচে। কনুই সোফার হাতলে।
“একটা কাজ করো না, একটু মাদার্স অ্যাবোডে ফোন করে খবর নাও, উনি আসছেন কিনা। যদি না আসেন, ওনার মোবাইলে ফোন করো। জানো ত বাবা, আমি পারি না। কিরকম হয়। করো না। বসেই ত আছো” – স্বামীকে নরম ধাক্কা মেরে বলে চলে নন্দিনী।
“ফোন করার কোনও উপায় নেই। উনি আর নেই।” বজ্রাহত নন্দিনীর সামনে কোনওক্রমে কথাটা শেষ করে মনোজিৎ – “পয়লা জুনে কোভিডে চলে গেছেন। আমি তোমায় কিভাবে বলতাম জানিনা।”
ভাগ্যিস উঠে দাঁড়িয়েছিল সে – ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সামনে আর কিছু না পেয়ে মনোজিতের বুকের কাছে গেঞ্জিটাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচে নন্দিনী। তাড়াতাড়ি তাকে সোফায় শুইয়ে মনোজিৎ ছেলেকে ডাকে – “পিকু, পালস্ অক্সিমিটারটা একবার নিয়ে আয় তো, বাবা।”
**************************************************
এইবারে শেষ করা গেল না। দুঃখিত। আগামী পর্বে এই জংলী নটে মুড়োবে।