ভদ্রলোক পেশায় স্কুলের প্রধানশিক্ষক, নেশায় কবি ও লেখক। বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন, বেশ কিছু কবিতার বইও লিখেছেন, বেশ গর্ব করেই জানালেন। এসেছিলেন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, এক শ্যামবর্ণা, পৃথুলা চেহারার মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা – দেখে আর যাই হোক, আকর্ষণীয়া বলা যায় না।
তো সে যাই হোক, আগমনের হেতু জিজ্ঞেস করতে ভদ্রমহিলা জানালেন তার স্বামী অনিদ্রারোগে ভুগছেন। মেজাজ খিটখিটে থাকে, কাজে বা সংসারে মন নেই ইত্যাদি। ভদ্রলোকও স্বীকার করলেন ইদানিং তার মনোকষ্ট, হতাশা , বিরক্তি ইত্যাদি নানা সমস্যার কথা। স্বাভাবিভাবেই পরবর্তী প্রশ্ন আসে – কবে থেকে?
খুব অর্থবহ হাসি হেসে বললেন – এই যবে থেকে আমার চরিত্র খারাপ হলো তবে থেকে।
– মানে?
– মানে বুঝলেন না? এই যবে থেকে আমি দুশ্চরিত্র হয়ে পাইকারিভাবে বিভিন্ন মহিলার সাথে জড়িয়ে পড়ছি তবে থেকে।
– সে আবার কি?
– না মানে আমার স্ত্রী তাই ভাবেন আর কি ?
-আমি শুধু ভাবি? তুমি করো না ঐসব জঘন্য কাজ? ধোয়া তুলসী পাতা না? এইজন্যেই আমি আসতে চাই নি তোমার সাথে। শুধু লোকের কাছে মিথ্যেবাদী বানাবে – ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ভদ্রমহিলা।
প্রায় উঠেই চলে যাচ্ছিলেন , কোনরকমে ডেকে বসানো গেলো। কিন্তু রাগে থমথমে মুখ, পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকেই পরবর্তী প্রশ্ন – বলুন তো ম্যাডাম, আপনিই বলুন,ঘটনাটা আসলে কি?
ব্যাস, বন্যার জলে বাঁধ ভাঙলো। গড়গড়িয়ে বলে চললেন কবে, কখন, কোথায়, কিভাবে ও কার কার সাথে স্বামী ভদ্রলোকটি ঠিক কি কি বেচাল করেছেন, কবে বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই অজানা কাউকে ফোন করতে দেখা গেছে তাকে, কবে হাসি হাসি মুখে বাড়ি ফিরে চোখাচোখি হতেই গম্ভীর মুখ করে নিয়েছেন স্ত্রীকে দেখে তার একেবারে পুঙ্খানুপুঙখ বর্ণনা। স্কুলের সুন্দরী শিক্ষিকারা যে আজকাল সর্বদা তার মনে বিচরণ করছেন এতটুকু বোঝার ক্ষমতাও কি তার নেই, এতটাই মূর্খ ভাবেন স্বামী তাকে!
স্বামী ততক্ষণে কিছু একটা প্রতিবাদের চেষ্টা করছিলেন খুব রাগত মুখে কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললাম। ভদ্রমহিলা এবার কখনো ক্রন্দনরতা, কখনো মিষ্টভাষিনী, কখনো বা ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ স্বরে স্বামীর দুশ্চরিত্রের প্রমাণের ঝাঁপি খুলে বসলেন। সমস্যা হলো যে হাজার তথাকথিত প্রমাণ সত্ত্বেও তিনি এটা বলতে পারলেন না যে কেন আজ পর্যন্ত কাউকে চাক্ষুষ দেখেন নি স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে, যে কোনো ভাবে । ঘুরেফিরে একটাই উত্তর পেলাম বার বার – আমি কি এতই লাজলজ্জাহীন যে সব রকম ঘেন্নাপিত্তি বাদ দিয়ে কি সব অশ্লীলতা করে বেড়াচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করব?
আমি তো এখনও ঘর করব ভাবি, তাই, নইলে কত আগেই সব প্রমাণ জোগাড় করে দিতাম। লোক নিয়ে গিয়ে বাজারে সবার সামনে চাবুক মেরে সত্যি কথা বার করে দিতাম ।
অতঃপর তিক্ত বাদানুবাদ এড়াতে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম – আপনার খিদে, ঘুম সব ঠিক হয়? শরীরে শক্তি পান আগের মতো?
– সব ঠিক। কোনো সমস্যা নেই। আর আপনি আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেনো? পেশেন্ট তো ও। আমি তো ওকে দেখাতে এসেছি, ওর এই অসম্ভব শারীরিক চাহিদার চিকিৎসা করাতে।
– অসম্ভব শারীরিক চাহিদা মানে ?
– অন্য মেয়েদের সাথে। নইলে এরকম দুশ্চরিত্র কেউ হয়। আমার উপর কোনো টান নেই। অবশ্য আমার ওসব ভালোও লাগে না।
কথায় কথায় জানা গেলো ভদ্রমহিলা মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণা, খুব অল্প বয়েসে বিয়ে, ছেলে মেয়ে দুজনেই এখন প্রাপ্তবযস্ক এবং কলেজে পাঠরত। বিয়ের প্রথম থেকেই তিনি ঘোর সংসারী, কিন্তু না ছিল স্বামীর সংস্কৃতি জগতে তার কোনো আগ্রহ, না ছিল তার স্বামীর উপর বিশ্বাস। বরাবরই স্বামীর চরিত্র নিয়ে তিনি ছিলেন সন্দিহান, যা কিছুকাল যাবত একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেছে। অবশ্যই তিনি মনে করেন এই সন্দেহ সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত।
জিজ্ঞেস করলাম – তো আপনার স্বামী যখন এতই দুশ্চরিত্র, তা আপনি তার সাথে পড়ে আছেন কেন? ছেড়ে চলে যাচ্ছেন না কেন?
– কোথায় যাবো ডাক্তারবাবু? আমি তো পড়াশুনা করিনি, কি কাজ করবো? আর সমাজ বলবেই বা কি ? ওতো ওটাই চায়। কিন্তু আমি আমার অধিকার ছাড়বো কেন ডাক্তারবাবু ?
ভদ্রলোক একটু চাপা গলায় বললেন – আমি আলাদা করে কিছু বলতে চাই।
– কেন? আলাদা কেন? আমি শুনি না, কি ক্ষতি ?
ভদ্রলোক একটু কেশে বলেন – না তোমার পেটের টিউমারটার কথা বলছিলাম। দেখুন তো ডাক্তারবাবু, ওটা ঠিক কি ?
টিউমার শুনে স্বাভাবিভাবেই একটু কৌতূহলী হয়ে উঠি – কই চলুন তো দেখি, কোথায় টিউমার ?
দেখা হলো। কোনো টিউমার নেই, পেটের এক জায়গায় খানিকটা চর্বি জমে শক্ত হয়ে আছে মাত্র – ভদ্রমহিলা এটাকেই টিউমার ভাবছেন। একথা বলতে ভদ্রলোক বেশ অর্থবহ ভাবে বললেন – ও কিন্তু মাথার কোনো ওষুধ দিলে খাবে না ।
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। মাঝে মাঝে রোগীর স্বার্থে, রোগীর পরিজনের স্বার্থে অশ্বত্থামা হত ইতি গজ করতে হয় বৈকি। পণ্ডিতগণ হয়ত বলবেন এটাকে unethical, কিন্তু বাস্তবে এমন অনেক কৌশল করতে হয় যা এমন পুথিসর্বস্ব পাণ্ডিত্যের ধার ধারে না ।
– শুনুন, এই টিউমারটা ওষুধেই গলে যাবে, অপারেশন লাগবে না। কিন্তু নিয়ম করে খেতে হবে কিন্তু।
– টিউমারের ওষুধ খেতে হবে ?
– আপনার ইচ্ছে
– ঘুম হবে নাতো?
– প্রথম দিকে একটু হতে পারে। খুব সমস্যা হলে ওষুধ পাল্টে দেওয়া যাবে। তবে একটু সহ্য করতে পারলে তাড়াতাড়ি গলে যাবে।
– কিন্তু আপনি তো যার কারণে আসা তাকেই কোনো ওষুধ দিলেন না
– দেবো বৈকি। এই আপনার প্রেসক্রিপশনেই লিখে দিচ্ছি।
বস্তুত মাষ্টারমশাই-এর বেশ দরকারই ছিল antidepressant টার । একটু বুঝিয়ে বলতে খুব একটা গররাজিও হলেন না।
এরপর নিয়মিত কয়েক মাস এলেন দম্পতি। ওষুধের পাশাপাশি থেরাপিও শুরু হলো। কিন্তু ওথেলো সিনড্রোম তো আর এতো তাড়াতাড়ি যাবার নয়, সবচেয়ে কঠিন মানসিক অসুখ বলে কথা – তাই গেলো ও না। স্ত্রীর মতে স্বামী রইলেন আগের মতোই দুশ্চরিত্র, আর স্বামীর মতে জীবন আগের মতোই দুর্বিসহ।
মুশকিল হলো এই সন্দেহের অসুখের যেটি সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ সেটি দেওয়া গেলো না ভদ্রমহিলার ডাইবেটিস থাকার কারণে। যাইহোক , সবদিক দেখে শুনে নিরাপদ অথচ মোটামুটি কার্যকর ওষুধে শুরু হলো চিকিৎসা। সঙ্গে যোগ হলো নিয়মিত সাইকোথেরাপি।
মুশকিল হচ্ছে এই সন্দেহের রোগ যা পরিভাষায় delusion of infidelity ( Othello syndrome) নামে পরিচিত তার সেরে ওঠার হার খুব একটা আশাপ্রদ নয়, বিশেষত যদি শারীরিক কোনো কারণ যেমন ডাইবেটিসের জন্য সব ওষুধ দেওয়া না যায়। যাইহোক, মাস ছয়েক কেটে গেল, যোগাযোগ নেই। রোগীর ভিড়ে মনেও রইলো না। তারপর হঠাৎ আবার একদিন চেম্বারে দুজনে।
জিজ্ঞেস করলাম – কেমন আছেন আপনারা?
মাষ্টারমশাই বললেন – আছি মোটামুটি। মানিয়ে নিচ্ছি।
– যাক ভালো ।
জানলাম, আমায় না দেখালেও আমার ওষুধ তারা চালিয়ে গেছেন। থেরাপিও চলেছে নিয়ম করে।
ওষুধপত্র লিখে দিলাম। বিদায় নেবার আগে বললাম
– তা, লেখা কেমন চলছে আপনার? নতুন কিছু প্রকাশ করলেন?
– না
– কেন?
– লেখাতো কবেই ছেড়ে দিয়েছি। আর লিখি না ।
– ওমা সেকি?
– বারে, লেখার সময় যদি কায়দা করে কাউকে প্রেমপত্র লিখি।
ভদ্রমহিলার চোখে আগুন তখন।
না বলে পারলাম না – আপনি পারছেন কিভাবে মাষ্টারমশাই? আপনার তো লেখা অন্ত প্রাণ ছিলো।
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পরে মাষ্টারমশাই বললেন – ” মড়া আবার সাহিত্যচর্চা করে নাকি ডাক্তারবাবু? সাহিত্যচর্চা আমার সেইদিনই শেষ হয়ে গেছে যেদিন সমাজের দিকে, ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যেতে পারলাম না। অনেক সাধ ছিল সাহিত্যজগতে নাম করবার জানেন। যাক গে। ”
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পরের রোগী ডাকতে হলো। চোখের সামনে একটি প্রতিভার অপমৃত্যু দেখে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগে বৈকি।
বাহ।
দারুন
হ্যাঁ, একটা সুন্দর পারি পাটি গল্প, যদিও কিছুটা বেদনার।
Thik jodi er ulto ta hoye doctor, tahole remedy ki?