৫ অক্টোবর, ২০২২-এ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা তথা হু-র তরফে একটি “মেডিক্যাল প্রোডাক্ট অ্যালার্ট” জারি করা হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়াতে ভারতের মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালসের (হরিয়ানার কোম্পানি) তৈরি চারটি ওষুধ – প্রমেথাজিন ওর্যাল সলিউশন, কোফেক্সমালিন বেবি কাফ সিরাপ, মাকফ বেবি কাফ সিরাপ এবং মাগ্রিপ এন কোল্ড সিরাপ – চিহ্নিত হয়েছে ৬৬ জন শিশুর অ্যাকিউট কিডনি ইনজ্যুরিতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে। হু-র তরফে বিজ্ঞপ্তি জারির সময় পর্যন্ত উৎপাদক সংস্থার তরফে এই প্রোডাক্টগুলোর নিরাপত্তা এবং গুণমানের ব্যাপারে কোনরকম তথ্য হু-কে জানানো হয়নি। বরঞ্চ হু-র তরফে জানানো হয়েছে, চারটি প্রোডাক্টের নমুনায় ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণে নিশ্চিতভাবে দেখা গেছে অগ্রহণীয় পরিমাণের ডাইইথিলিন গ্লাইকল এবং ইথিলিন গ্লাইকল রয়েছে। হু-র অনুমান, আপাতত গাম্বিয়াতে এই প্রোডাক্টগুলো পাওয়া গেলেও বিধিবহির্ভুত বাজারের সাহায্যে আরও অনেক অঞ্চলে বা দেশেও পৌঁছে যেতে পারে।
একই সতর্কীকরণে ডাইইথিলিন গ্লাইকল এবং ইথিলিন গ্লাইকলের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে এগুলো মনুষ্যদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক। এগুলোর বিষাক্ত প্রভাবের মধ্যে রয়েছে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়ারিয়া, প্রস্রাব না করতে পারা, মাথাব্যথা, পরিবর্তিত মানসিক অবস্থা এবং অ্যাকিউট কিডনি ইনজ্যুরি যার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এখানে বলা দরকার, বেশিরভাগ তরল কাফ সিরাপে দ্রাবক হিসেবে গ্লিসারিন ব্যবহার করা হয় যাতে কোন ক্ষতি না হয়। কিন্তু অসাধু ওষুধ-উৎপাদকেরা মুনাফা বেশি রাখার জন্য গ্লিসারিনের (বা গ্লিসারল) পরিবর্তে উপরোক্ত ক্ষতিকারক পদার্থগুলো ব্যবহার করে। মানুষের জীবন মৃত্যু এদের মুনাফার উদগ্র লিপ্সার কাছে নগণ্য।
৬ অক্টোবর, ২০২২-এ এনডিটিভির সংবাদ জানাচ্ছে যে “গাম্বিয়া রিকলস ইন্ডিয়ান-মেড কাফ সিরাপ লিংকড টু ডেথ অফ সিক্সটি-সিক্স চিল্ড্রেন”। জানা যাচ্ছে, গাম্বিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সর্দিকাশির সিরাপ তুলে নিচ্ছে। ৭ অক্টোবর বিজনেস টুডে পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে যে এই ভারতীয় কোম্পানিটি অনেকদিন ধরেই এর প্রোডাক্টের গুণমান নিয়ে প্রশ্নের মুখে রয়েছে। ২০১১ সালে বিহার সরকার এ কোম্পানিকে নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে। ভারত সরকারের “ল্যাবরেটরি অ্যান্ড লিগ্যাল নোড (এক্সএলএন)”-এর তথ্য অনুযায়ী কেরলা এবং গুজরাটের সরকার বারংবার এ কোম্পানির বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা জারি করেছে। কেরালা সরকার ২০০৫ সালে এদের বিরুদ্ধে মামলাও করে, যার দরুন ২০১৭ সালে এদের জরিমানা হয়। এখানে প্রশ্ন উঠবে – এমন সর্বশক্তিমান একটি দেশে যেখানে প্রতিটি নাগরিক কি করছে তার ওপরে রাষ্ট্রের সদাসতর্ক দৃষ্টি রয়েছে, সে দেশের ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি এতদিন ধরে কি করেছে এই অসাধুতাকে বন্ধ করার জন্য?
এছাড়াও একাধিক প্রশ্ন উঠে আসে আফ্রিকার ৬৬ জন শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। প্রথমত, সামজিকভাবে সুষম স্বাস্থ্য সবার অধিগম্যতার মধ্যে থাকবে – সামজিক ন্যায্যতার এই ধারণা লঙ্ঘিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভারত যে জেনেরিক ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে “বিশ্বের ঔষধাগার” এ ধারণা কলঙ্কিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটিকে আমরা কি চোখে দেখব এ প্রশ্নও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। চতুর্থত, ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি জানিয়েছে যে যতক্ষণ পর্যন্ত না হু-র তরফে এতগুলো শিশুর মৃত্যুর জন্য এ ওষুধগুলোই নিশ্চিতভাবে দায়ী ততক্ষণ অবধি কড়া পদক্ষেপ নেওয়া যাবেনা। এরকম কথার নির্গলিতার্থ হল হু-কে প্রমাণ দিতে হবে যে অভিযুক্ত সংস্থাটি অপরাধ করেছে। ডিজিসিআই-এর দায় নেই অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখার।
একথা কি আমরা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর তরফে অন্য সময়েও শুনতে পাব? মনে রাখতে হবে, মেইডেন ফার্মার একজন ডিরেক্টর হলেন প্রভূত বিত্তশালী, একদা জেট এয়ারওয়েজের মালিক নরেশ গোয়েল। আমরা তো জানি, অর্থ এবং ক্ষমতা হাত ধরাধরি করে চলে।
এর একটি উদাহরণ হিসেবে ভিন্ন প্রসঙ্গে বলা যায়, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৯১, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন, মতামত চান। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে পত্রিকা দ্য ইকনমিস্ট পত্রিকা নোটটি প্রকাশ করে দেয় “লেট দেম ইট পলিউশন” শিরোনামে। নোটটির মোদ্দা কথা ছিল, ধনী বিশ্বের সমস্ত দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা বা কম-উন্নত দেশগুলো-তে পাচার করতে হবে। এজন্য সামার্সের স্বাস্থ্যের যুক্তি ছিল, আমেরিকার মতো দেশে ১,০০,০০০ জনে ১ জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের জন্য প্রোস্টেট ক্যান্সার হয় তাহলেও এর গুরুত্ব আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে যেখানে ৫ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হার ১০০০ শিশুতে ৫ জন তার চাইতে বেশি। এরকম চমৎকার ও অভিনব ধারণার পুরস্কার হিসেবে ক্লিন্টন প্রশাসনে ৭ বছর ট্রেজারি সেক্রেটারি পদে ছিলেন। সে মেয়াদ শেষ হলে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
গাম্বিয়ার মতো দরিদ্র দেশে যাদের ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করার ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নেই সেসব দেশে স্বাস্থ্যের ওপরে এধরণের আঘাতকে পল ফার্মার “কাঠামোগত হিংসা” বলছেন। যদি হু মারফত বিশ্বের কাছে উন্মোচিত না হত তাহলে এরকম ঘটনা, আরও অনেক ঘটনার মতো, আমাদের কাছে অদৃশ্য এবং অশ্রুত রয়ে যেত। অমর্ত্য সেন পল ফার্মারের বিখ্যাত গ্রন্থ প্যাথলজিস অফ পাওয়ার-এর ভূমিকায় লিখছেন – “প্রতিরোধযোগ্য রোগকে যথার্থই প্রতিরোধ করা যায়, নিরাময়যোগ্য রোগকে নিরাময় করা যায়, এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাধিগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য চিৎকার করে। প্রকৃতির বিরুদ্ধতার জন্য আক্ষেপ করার পরিবর্তে আমাদের সামাজিক অবস্থার আতঙ্কের কারণগুলো ভালো করে বোঝা দরকার”। বোঝা দরকার “বিশ্বগুরু” হবার সাথে সাথে আমরা যেন শিশু-হন্তারক না হয়ে উঠি।
সংযোজন – বিবিসি-র সংবাদ অনুযায়ী (৭.১০.২২) “India investigates cough syrups after Gambia deaths”। এ সংবাদ জানাচ্ছে – “The health body said it was “conducting further investigation” with the firm and Indian authorities. “All batches of these products should be considered unsafe until they can be analysed by the relevant National Regulatory Authorities,” it added.” সিএনএন সংবাদ সংস্থার ১৪ অক্টোবর, ২০২২-এর সংবাদ জানাচ্ছে “India halts production of cough syrups suspected of links to child deaths”।
কালিমা অপনোদনের অন্তিম চেষ্টায় নেমেছে ডিজিসিআই – আন্তর্জাতিক জগতে শোরগোল পড়ে যাবার পরে। সিএনএনের সংবাদেই বলা হয়েছে – “Health officials believe the medicines may be linked to the deaths of more than 60 children in the Gambia, Africa, and potentially more than 20 children in the Southeast Asian country of Indonesia.
On Wednesday, India’s Central Drugs Standard Control Organization said Maiden Pharmaceuticals had been “manufacturing and testing drugs without adhering to, and in contravention of, the various good manufacturing practice requirements.” এবং হরিয়ানা সরকার সংস্থাটির কাশির সিরাপ উৎপাদনের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
কিন্তু শেষ অবধি জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অবহেলা এবং ওষুধের গুণমানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নজরদারির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কি ভূমিকা নেবে এ প্রশ্নগুলো এখনও অমীমাংসিত।
(এ লেখাটির একটি স্বল্প ভিন্ন ভার্সন আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৩.১০.২২ তারিখে ছাপা হয়েছে। কৃতজ্ঞতাঃ স্বাতী ভট্টাচার্য এবং আনন্দবাজার পত্রিকা)
সুপ্রভাত অসামান্য ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ,সমৃদ্ধ হলাম, ধন্যবাদ স্যার
Excellent one sir
ইথিলিন গ্লাইকল বা ডাই ইথিলিন গ্লাইকল কাফ সিরাপে ব্যবহার করে ফার্মা কোম্পানির এই অনাচার মারাত্মক। আফ্রিকার মত গরিব দেশে অপুষ্টি জনিত শিশুমৃত্যু এমনি বেশি। তার উপর ফার্মা ব্যবসায়ীদের বিষের চালান।৯১ তে বিশ্বব্যাঙ্কের সামার্স যে গোপন নোট দিয়েছিলেন – বড় ভয়াবহ। পড়তে পড়তে বিস্মিত এবং বিপন্ন হচ্ছিলাম। ‘উন্নত’ দেশের বাজে ফার্প্রোমা ডাক্ট তৃতীয় বিশ্ব এবং আফ্রিকায় চালান দেওয়ার এই পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র মানবসভ্যতার কালো দিক।এমন লেখা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ
খবরটা আগেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
শিশু হত্যার ওষুধ তৈরী ও বিক্রীর অনুমোদন দেওয়া হল উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই।
এ তো অপরাধ।
আপনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সমস্যাটি বিশদভাবে বুঝতে সাহায্য করল।
“একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে”- নির্মলেন্দু গুণের কবিতার এই লাইন দুটি মনে এল।
ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে।