তখন মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের হাউসস্টাফ। আজ ভাবলে অবশ্য গত শতাব্দীর কথা মনে হয়..
তখন সদ্য ডাক্তারি পাশ
তখন রক্ত গরম
তখন কারণে-অকারণে থোকা থোকা ইমোশন
তখন মাসখানেকের না-কাচা জিন্স
তখন হোস্টেলের পাঁচিলের ওপারে পৃথিবী দেখা শুরু হয় নি।
তখন মৃত্যু দেখেছি অনেক, ছোঁয় নি সেভাবে।
ওয়ার্ডে আমাদের কাজ ছিল মূলত ওই রক্ত টানা, চ্যানেল করা, ড্রেসিং, ওষুধপত্র-স্যালাইন চালানো.. এইসব আর কী। রক্তের জটিল সব রোগ নিয়ে পেশেন্ট ভর্তি হয়। আমরা খুব বুঝি না সেসব, তখন অল্প অল্প করে চিনে নেওয়ার সময়।
বছর সতেরো-আঠারোর একটি মেয়ে ভর্তি হ’ল। আসল নামটা গোপন রাখি, ধরে নিন জয়িতা। উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, হঠাৎ ধূম জ্বর। হাজারো ওষুধ খেয়েও জ্বর কমে না কিছুতেই। এদিকে জ্বর বেড়ে চলে, ওজনও কমে যায় অনেকটা। অনেক জায়গা ঘুরে মেডিক্যাল কলেজে এসে রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় সন্দেহজনক রক্তকোষ। হাড়ের রস পরীক্ষায় ধরা পড়লো টি-সেল লিউকিমিয়া। রক্তের ক্যান্সার।
ছটফটে মেয়ে। মুখে হাসির অভাব দেখিনি কোনোদিন। এত কেমো নিয়েছে…শরীরে অজস্র সূঁচ ফোটানো হয়েছে… জ্বরে গা পুড়ে গেছে…অগুন্তি জীবাণু কুরে কুরে খেয়েছে…তবু মুখে হাসির অভাব দেখি নি। সাথে উজ্জ্বল দুটো চোখ!!
‘দাদা’ বলতো…
– দাদা, জানো তো আমি এইবার সেরে যাই তারপর জয়েন্টের প্রিপারেশন নেবো। এ বছর পরীক্ষা দেওয়া হল না, সামনের বার দিতেই হবে..
– আচ্ছা, আমি কবে পুরো সুস্থ হবো? বন্ধুদের সাথে কতদিন দেখা হয় নি..
– দাদা, তোমরা এই এত মোটা মোটা বইগুলো পড়ো কিভাবে? আমার তো দেখলেই ঘুম পায়..
– তুমি যে আমাকে এত সূঁচ ফোটাও তোমার ভালো লাগে?
– আমাকে কিছু টিপস দাও না দাদা, কি করে তাড়াতাড়ি সিলেবাস শেষ করা যায়?
সব কথার উত্তর দিতে নেই। সব কথার উত্তর হয় না।
ততদিনে অল্পস্বল্প জেনে গেছি.. টি সেল লিউকিমিয়া সম্পর্কে।
হোঁচট খেতে খেতে কেমোর প্রথম সাইকেল শেষ করে জয়িতা। মাথায় চুল নেই। হাত-পাগুলো পাটকাঠি। হাসিটা খানিক দুর্বল। এখন অল্পেতে বড্ড এলিয়ে পড়ে।
আমি তার কেবিনে যাই। মাথা নিচু করে কাজগুলো সেরে পালানোর পথ খুঁজি। চোখের সামনে এই ক্ষয় আমি আগে দেখি নি। তার দুর্বল হয়ে আসা গলার আওয়াজে এখন দুঃখ যত না, ভয় লাগে তার চেয়ে বেশি। কী অসহ্য! কী তীক্ষ্ণ! কী বিদারক!
কেমোর প্রথম সাইকেল শেষ।
দশদিন হল, জয়িতা আগের চেয়ে সুস্থ। জ্বর আসে নি হপ্তাখানেক।
মহালয়ায় ভোর চারটেয় উঠে মহিষাসুরমর্দিনী শুনেছে। আগের পুজোর গল্প বকবক করে গিয়েছে। হাসিটা ফিরে এসেছে আবার!!
আমি পুজোর সময় দিন চারেক বাড়ি ফিরে এসেছি। কদিন ওয়ার্ডে যাওয়া হয়নি। আমার বদলে ডিউটি করেছে আর একজন। কালীপুজোয় তার রিপ্লেসমেন্ট দিয়ে দিতে হবে।
জ্বরটা আবার ঘুরে এসেছে জয়িতার। ওষুধগুলো আর পেরে উঠছে না। বাবা-মায়ের অসহায় ছুটোছুটি…আর ক্রমশ নেতিয়ে পড়া আঠারো।
দীপাবলি। হাজারো আলোর রোশনাই।
গেটের মুখটায় ঘুগনি-শেঁকা রুটি, সেন্ট্রাল ল্যাবের লম্বা লাইন, ইমার্জেন্সির চিল চিৎকার, লাইব্রেরির ব্রেকিয়াল প্লেক্সাসের ব্রাঞ্চ, লাভার’স লেনের যুগল, ফুড-স্টেশনের স্যুপ..
সব ছিলো। সঅঅঅঅঅব ছিলো।
শুধু, জয়িতা ছিলো না।
রাতে বাজি পুড়েছে একই রকম, ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়েছে একই রকম। পৃথিবীর কোনখানে এতটুকু কুটোও বদলায়নি।
শুধু এক সদ্য-ডাক্তার ওয়ার্ড থেকে হোস্টেল ফিরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর কতগুলো রাত তার ঘুমের দুনিয়া জুড়ে ঘুরে,পুড়ে,খুঁড়ে বেড়িয়েছে এক আঠারো… এক বোন…
সেই প্রথম মৃত্যু ছুঁয়ে দেখা।
সৌম্য দা, অসাধারণ লেখা, তুমি তো 2nd ঐন্দ্রিল ভৌমিক
আমারো চোখে জল এসে গেলো।
বড় কষ্ট সহ্য করা যায় না
Darun lekha daktarbabu.ami daktar noi Nurse…kichu mrityu amon vabe chuye jai….
???
সবাই কি আপনার মত মনে রাখে স্যার? সত্যিই খুব কষ্ট লাগছে
Very pathetic.