প্রারম্ভঃ মানুষ মরণশীল। কিন্তু মানুষের মৃত্যু কখন ও কিভাবে হবে তার জানা নেই বা তার হাতে নেই। জন্মের ক্ষেত্রেও তাই। অসুস্থতা ও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকটাই। তবে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি; উন্নত রাষ্ট্র, সামাজিক ও চিকিৎসা ব্যাবস্থা; পরিবার পরিকল্পনা; যত্নশীল লালনপালন ও উপযুক্ত শিক্ষালাভ; সঠিক নিরাপত্তা, প্রতিষেধক ও প্রতিবিধান গ্রহণ; স্বাস্থ্যসম্মত সুশৃঙ্খল জীবনযাপন প্রভৃতি জন্ম, অসুস্থতা ও দুর্ঘটনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জীবনযাপনের মান উন্নত করে তোলে। মানুষকে দীর্ঘায়ু ও সুস্থ রাখে। কিন্তু ভারতের মত গরীব ও পশ্চাদপর দেশে এগুলি সম্ভব কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র, ধনী ও সচেতন জনসংখ্যার মধ্যে। আবার ধনী দেশগুলিতেও অনেকক্ষেত্রে এগুলি সম্ভব নয় গরীব, অভিবাসী শ্রমিক, কৃষ্ণাঙ্গ, জনজাতি প্রভৃতি জনসমষ্টির মধ্যে। এর কারণ বিশ্লেষণে আইন, অঙ্গীকার ইত্যাদির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড অতিমারিতে সবচাইতে বেশি মারা গেছেন এখনবধি পেছিয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গরা। ভারতের ক্ষেত্রে ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। হাওড়া জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসনে থাকার সময় দেখেছি হাওড়া এবং সংলগ্ন লিলুয়া ও শিবপুরে অতিধনী কিছু অবাঙালি বড় দালাল ও ব্যবসায়ী বাস করেন। রেলের লোহার ছাঁট নিলামে কিনে ব্যবসা, যন্ত্রাংশ, শেয়ার, পরিবহন ইত্যাদি ব্যবসার সাথে যুক্ত এদের স্থানীয় ভাষায় কালোয়ার বলা হয়। এদের পরিবারে হঠাৎ কোন অসুস্থতা ঘটলে হয়তো হাওড়া বা কলকাতার কোন কর্পোরেট হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, কিন্তু পরিকল্পিত চিকিৎসা ও প্রসবের ক্ষেত্রে তারা মুম্বাই বা সিঙ্গাপুরের তারকাখচিত হাসপাতালগুলি পছন্দ করেন। প্রবল ঘিঞ্জি ও দূষণময় একদা শিল্পাঞ্চল ঐ হাওড়াতেই বাস করেন প্রচুর মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। তাদের পরিবারে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তারা নেতাদের ধরে সরকারি হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থ হলে ছোট নার্সিং হোম বা প্রাইভেট হাসপাতালের দ্বারস্থ হন এবং চিকিৎসার বিল নিয়ে খুব উদ্বেগের মধ্যে থাকেন। হাওড়া শহরের আরও একটি বড় জনসংখ্যা বিভিন্ন পেশার গরীব শ্রমজীবী, ভবঘুরে, ভিখিরি, শহুরে সর্বহারা যাদের নিবাস পিলখানা, ভোটবাগান, পি এম বস্তি, বেলগাছিয়া ভাগাড় সহ অজস্র অস্বাস্থ্যকর কিলবিলে বস্তি, ঝুপড়ি, ফুটপাথ, বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন ইত্যাদিতে। এদের প্রাথমিক চিকিৎসা হল সহ্য করা, কাজ না হলে তারপর টোটকা, তারপর হাতুড়ে কিংবা গাসতো দয়ানন্দ প্রমুখ সমাজসেবী এবং মিশনারিদের ক্লিনিকসগুলি । গুরুতর কিছু হলে সরকারি হাসপাতালের উপচে পড়া ওয়ার্ড। তাদের অপরিকল্পিত জন্ম এবং অবহেলার মৃত্যু সবই হয় ঝুপড়িতে – ফুটপাথে, নয় সরকারি হাসপাতালে। পূর্বোক্ত ধনীদের মৃতদেহ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শবযানে ফুলের স্তুপের উপর শ্মশানে পৌঁছলে কেজি কেজি ঘি মাখিয়ে চন্দন কাঠে দাহ করা হয়। শেষোক্ত হতদরিদ্রদের অনেক সময় দাহ করার বা কবর দেওয়ার সংস্থান থাকেনা। তাই কখনও কখনও দেখা যায় মৃতদেহ ফেলে রেখে যেতে। শুধু হাওড়া নয় কলকাতা সহ অন্যত্রও এরকম দেখা যায়। একটি ছোট জনবহুল অঞ্চলে আর্থিক বৈষম্যজনিত জন্ম মৃত্যুর প্রভেদ বোঝাতে হাওড়ার উদাহরণটি দেওয়া হয়েছে।
জন্ম-মৃত্যু বৃত্তান্তঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিভিন্ন দেশের ও রাজ্যের সরকার, পুরসভা ইত্যাদি কন্যা সন্তানের পুষ্টি ও যত্ন; বিবাহের ন্যুনতম বয়স নির্ধারণ; জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভাবস্থায় পুষ্টি, প্রতিষেধক ও নিয়মিত চেক–আপ; লেবার রুমের আধুনিকীকরণ; মাতৃযানের ব্যাবস্থা ও হাসপাতালে নিরাপদ প্রসব; প্রসূতি ও নবজাতকের যত্ন ও চিকিৎসা; ক্যাঙ্গারু কেয়ার, মাতৃ দুগ্ধ পান ও টিকাকরণ প্রভৃতির মাধ্যমে প্রসূতি ও নবজাতকের নিরাপত্তা ও যাবতীয় চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে জন্ম প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও সম্মানজনক করে তোলার ব্যাবস্থা করেছেন। তারা আধুনিক চিকিৎসা ও ভেষজ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির আবিস্কারগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রবর্তন করে; রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থায় বা রাষ্ট্র পোষিত স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে সকলের জন্যে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে; প্রবীণদের (Geriatric) স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে; পর্যাপ্ত হাসপাতাল, ওয়ার্ড, হসপিস, বৃদ্ধাশ্রম, অ্যাম্বুল্যান্স ইত্যাদি ব্যাবস্থা গড়ে তুলে প্রবীণ সহ সকলকে সুস্থ রাখার ও মৃত্যুর সময়কার সমস্যা লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছেন যার ফলে মানুষের দীর্ঘায়ু ও সুস্থ থাকার এবং অন্তিমে মৃত্যু প্রক্রিয়া মসৃণ হওয়ার সম্ভবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রেও সমাজের এক বিপুল অংশ গরীব, প্রান্তিক, অভিবাসী, পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষ্ণাঙ্গ, দলিত, আদিবাসী, জনজাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রমুখেরা অধিকার ও সুযোগগুলি থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
আবার আমাদের মত দেশে যেখানে অপ্রতুল হলেও এক দীর্ঘ, বৃহৎ ও পরীক্ষিত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা ও পরিকাঠামো রয়েছে সেখানেও কেউ যদি কোন দুরারোগ্য রোগে দীর্ঘদিন ভুগতে থাকেন তাহলে তার নিজের কষ্ট ছাড়াও তার চিকিৎসার ব্যাবস্থা ও ব্যয়ভার বহন করার ক্ষেত্রে তার পরিবার – পরিজন কিংবা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা বিড়ম্বনা ও সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে। অনেক পরিবারের ক্ষেত্রেই সেভাবে জানা চেনা অথবা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি না থাকলে সরকারি ব্যাবস্থার সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয়না। তখন তাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলির, কখনওবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে কর্পোরেট হাসপাতালগুলির দ্বারস্থ হতে হয়। গরীবরা পারেনই না, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সাধ্যাতীত হয়ে পরে। এরপর যদি অতিচিকিৎসা ও অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে বিলের বহর বাড়িয়ে দেওয়া হয় তখন পরিবারগুলির ঘটি বাটি বিক্রির পরিস্থিতি হয়। আর আপনারা তো জানেন চিকিৎসায় ‘ আউট অফ পকেট এক্সপেন্ডিচার ‘ এ ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তাই প্রায়শই দেখা বা শোনা যায় বয়স্ক বা অসুস্থ অথবা দুরারোগ্য রোগীকে রাতের অন্ধকারে হাসপাতাল বা রেল স্টেশন বা বাস স্ট্যান্ড বা ফুটপাথ বা অন্য কোন স্থানে ফেলে রেখে চলে যেতে। নদীয়া, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার তিনটি বড় সরকারি হাসপাতালের এবং দুই দিনাজপুর, বীরভূম, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও ডায়মন্ড হারবার জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসনের দায়িত্বে থাকার সময় বহুবার দেখেছি কোন দুরারোগ্য ও বয়স্ক রোগী অথবা দুর্ঘটনাগ্রস্ত কিংবা পুলিশ কেসের ড় এমনকি মৃতদেহকে হাসপাতালের এমারজেন্সিতে রেখে লোকজনদের পালিয়ে যেতে। দক্ষিণ কলকাতার একটি বড় সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বে থাকার সময় প্রায়ই দেখতাম এলাকার প্রভাবশালী নেতা অথবা স্থানীয় ক্লাবের দাপুটে যুবকদের ধরে অনেকেই পিতা, মাতা বা পরিবারের বয়স্ক ব্যাক্তিদের বলপূর্বক হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে চলে যেতেন। আর কোন খোঁজখবর নিতেন না। সীমিত শয্যার ব্যস্ত হাসপাতালের একটি গুরুত্বপূর্ণ শয্যা পূর্ণ রেখে সেই দুর্ভাগা বৃদ্ধ বৃদ্ধারা আমৃত্যু কাটিয়ে দিতেন।
কাশী ও বৃন্দাবনে প্রেরিত বাঙালী বিধবাদের অসহায়তার অনেক কাহিনী শুনেছি, কিছুটা চাক্ষুষ করেছি। রানাঘাট ও বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম মহিলা ওয়ার্ডের একাংশ ভরিয়ে রেখেছেন পরিবার থেকে বিতাড়িত বয়স্কা মহিলারা। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ বিধবা। হাসপাতালের মধ্যেই পুরনো জিনিসপত্র রাখা দুটি বড় ঘর খালি ও পরিষ্কার করে তাদের স্থায়ী থাকার ব্যাবস্থা করা হল। হাওড়া ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা হাসপাতাল সহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে দেখেছি ফেলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, মানসিক ভারসাম্যহীন, ভবঘুরে প্রভৃতিদের জন্যে অলিখিত একেকটি আস্ত ওয়ার্ড তৈরি হয়ে গেছে। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোভিড অতিমারির প্রথম ও দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এরমধ্যে আমাদের দেশ ও রাজ্যের সমাজ – অর্থনীতি ও রাজনীতির কারণে সুস্থ অথবা অসুস্থ দুধরনের বয়স্ক মানুষদের হাসপাতালে বছরের পর বছর ভর্তি থাকা, কষ্ট পাওয়া এবং পরিশেষে মৃত্যু হওয়া রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে তারা হাসপাতালের মধ্যেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম সহ বিভিন্ন জেলায় গ্রামাঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে আবার অন্যরকম কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা বিষ খাওয়া, সাপে কাটা প্রভৃতি রোগীর মৃত্যু হলে পুলিশ, প্রশাসন, আদালতের ভয়ে লাশ গায়েব করে গোপনে অন্ত্যেষ্টি করার প্রবণতা দেখেছি। পুরুলিয়ায় অবস্থিত একটি আঞ্চলিক মানসিক হাসপাতালের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এক রাতে যে গৃহে ভাড়া থাকতাম তার মালিক এক প্রতিষ্ঠিত ধনী মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ীকে নিয়ে উপস্থিত হন। মাড়োয়ারির ভাই উন্মাদ হয়ে গেছে তাকে হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হবে এবং এর জন্যে তিনি একটি মোটা অর্থ দেবেন। তাদের তখনই দরজা থেকে বিদেয় করলেও পরে বুঝতে পারলাম এরকম একটি প্রভাবশালী চক্র দীর্ঘদিন কাজ করে আসছে। শীঘ্রই কিছু ব্যাবস্থা নিয়ে চক্রের কাজকর্ম বন্ধ করতে সক্ষম হলাম যদিও এর জন্যে অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হল। সেসময়েই আবিস্কার করেছিলাম রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল ও কলেজে তাদের ব্যাচের ফার্স্ট বয় এক ব্যাক্তিকে তার ভাইয়ের পরিবার মানসিক রোগী সাজিয়ে এখানে ভর্তি করে রেখেছে সম্পত্তি নিজেরা ভোগ করার জন্যে। তাকে বাড়ি পাঠানোর উদ্যোগ নিতেই তিনি সবিনয় অনুরোধ করলেন যে বাড়িতে গেলেই আবার অশান্তি শুরু হবে তাই তিনি সেখানে না ফিরে হাসপাতালেই থেকে যেতে চান।
আমাদের রাজ্যে আরেকটি বিষয় হামেশাই ঘটে থাকে। দুর্বল পরিবহন ব্যাবস্থার কারণে সময়মত উপযুক্ত যানবাহনের অভাব, অন্যদিকে গাড়ি ভাড়া করার আর্থিক অক্ষমতা। এরফলে অনেক গুরুতর রোগী সময়মত হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে গৃহে বা পথিমধ্যে মারা যান। অনেক হ্যাপা করে শহরে পৌঁছলেও শয্যার অভাবে সরকারি হাসপাতালে এবং অর্থাভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করতে না পারায় অনেক রোগী মারা যান। অনেক ছোট ও মাঝারি হাসপাতালে ন্যুনতম চিকিৎসা না করে বড় হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। সেরকম পরিচিতি না থাকলে মেডিকেল কলেজগুলির পারস্পরিক ঠেলাঠেলির খপ্পরে পড়তে হয়। এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে শ্রান্ত অবসন্ন রোগী মারা যান। এস এস কে এম হাসপাতালে হাউসস্টাফ শিপ করার সময় দেখতাম আমাদের নিজেদের ইউনিটেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা যে গুরুতর রোগীদের ভর্তি করা দরকার তাদের ভর্তি করতে পারতাম না। অন্যদিকে রাজনৈতিক মাফিয়াদের মদতে দালাল চক্র নার্সদের ভয় দেখিয়ে ট্রলিতে করে রোগী ভর্তি করে ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে দিত। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্যানসার প্রভৃতি ব্যয়বহুল দুরারোগ্য রোগের ক্ষেত্রে অর্থাভাবে চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে যেতে না পারার জন্যে মৃত্যু। দক্ষিণবঙ্গে কৃষক সমাজের মধ্যে আর্সেনিক দূষণ জনিত বিষক্রিয়া একটি বড় সমস্যা। এটি প্রথমে বোঝাও যায় না, ধরাও পড়েনা। পরে হয়তো ধরা পরে, ততদিনে রোগী অক্ষম হয়ে পড়েছেন কিংবা মৃত্যু ঘটে গেছে। যক্ষ্মা রোগের ক্ষেত্রে একদিকে রোগীর দিক থেকে অনিয়মিত চিকিৎসা, অপরদিকে হাতুড়ে বা চিকিৎসকদের দ্বারা অতি চিকিৎসা রোগ প্রতিরোধী যক্ষ্মার জন্ম দেয়। অনেকক্ষেত্রেই যার পরিণতি মৃত্যু। প্রতিহত করা সম্ভব এরকম বহু মৃত্যুর কথাই বলা যায়।
জন্মদান পদ্ধতিও কি মসৃণ করা গেছে ? কিছু ভাগ্যবানের যেমন নামিদামি কর্পোরেট হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কয়েক লক্ষ টাকার প্যাকেজে রাজকীয় ব্যাবস্থায় জন্মলাভ হয়, অন্যদের সেখানে কোন প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলের ভাঙাচোরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নোংরা প্রসূতিঘরে হ্যারিকেনের আলোয় নার্স বা দাইদের দক্ষ হাতে। সেখানে প্রসূতি ও নবজাতকের জন্যে থাকেনা ন্যুনতম আপতকালীন কোন চিকিৎসা ব্যাবস্থা, আকছার শিশু চুরির ঘটনা ঘটে, কখনও বা প্ল্যাসেন্টা খেতে ঘুরে বেড়ানো পথ কুকুর নবজাতককেই তুলে নিয়ে যায়। দুর্গম অঞ্চলের অনেক প্রসূতি হাসপাতাল অবধি না পৌঁছতে পেরে পথেই প্রসব করেন। গ্রামীণ ও শহুরে হতদরিদ্র, গৃহহীন, যাযাবর, জনজাতি অনেকেরই প্রসব হয় কুঁড়ে, আস্তাকুঁড়ে, ঝোপে বা ফুটপাথে। সেই উষ্ণতাটুকুও অনেক শিশুর জোটে না। রানাঘাট হাসপাতালের এমারজেনসির বাইরে শীতের রাতে এক নবজাতককে ফেলে যাওয়ার পর হাসপাতালের নার্স এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা তাকে যত্ন করে বড় করে তোলেন। বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালের কাছেই একটি পতিতালয় ছিল। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মাঝেমাঝে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে শিশু রেখে চলে যেত। এক শীতের ভোরে ডাক পেয়ে কোয়ার্টার থেকে হাসপাতালে গিয়ে দেখি ডাস্টবিনে ফেলে রাখা একটি গুরুতর অসুস্থ নবজাতককে কুকুর ও কাকের ঝাঁকের আক্রমণ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলে বড় করে তোলেন। ভারতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এখনও উদ্বেগজনক। জন্ম ও মৃত্যুর উপর কোন ব্যাক্তির যেমন হাত নেই, তেমন ই আর্থিক দৈন্য, সামাজিক পরিবেশ, পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব, স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার অপ্রতুলতা ও অব্যাবস্থ্যা প্রভৃতি কারণে বেশিরভাগ জন্ম ও মৃত্যুর পদ্ধতি ই মসৃণ নয়। সেখানে যন্ত্রণামুক্ত স্বেচ্ছামৃত্যুর বাস্তবতা সুদূর পরাহত।
নিষ্কৃতি ও স্বেচ্ছামৃত্যুঃ ক্যানসার রোগে বিশেষ করে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লে এবং তার চিকিৎসার সময় অনেক রোগী খুব যন্ত্রণা পান। স্ট্রোক বা সেরেব্রো ভাসকুলার অ্যাক্সিডেন্টে অনেক রোগী জ্ঞান হারিয়ে বা অঙ্গ প্রত্যঙ্গর প্যারালিসিস হয়ে দিনের পর দিন খুব কষ্ট পেতে থাকেন। এই ধরনের অসুখগুলিতে কিংবা দুরারোগ্য অ্যালঝাইমারসের মত রোগে মানুষ যখন বছরের পর বছর কষ্ট পেতে থাকেন এবং যখন তাদের আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভবনা থাকেনা তখন তাদের ক্ষেত্রে নিষ্কৃতি মৃত্যুর (Euthanasia) কথা ভাবা হয়। আবার প্রাক্তন সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী যখন ২০০৭ থেকে ২০১৭ অবধি দীর্ঘ সময় কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় এ আই আই এম এস নিউ দিল্লি, অ্যাপেলো নিউ দিল্লি এবং জার্মানির ডুসেলডরফের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যান কিংবা হাসপাতালের মধ্যে হাসপাতাল কর্মী দ্বারা আক্রান্ত নার্স অরুণা সেহবাগ যখন ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ অবধি মুম্বাইয়ের কে ই এম হাসপাতালে কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় ভেন্টিলেটরের সাপোর্টে থেকে শেষে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের এবং অনুরূপ ক্ষেত্রগুলিতে দীর্ঘ যন্ত্রণার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে, তার সাথে, এই ধরনের ফলহীন চিকিৎসা ও শুশ্রূষার বিপুল ব্যায়ভার থেকে অব্যহতি পেতেও নিষ্কৃতি মৃত্যুর প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। একইভাবে দুর্ঘটনা ও বহু গুরুতর রোগের কারণে মস্তিস্কের মৃত্যু বা ব্রেন ডেথ হলেও ভেন্টিলেটরের ও অন্যান্য লাইফ সাপোর্ট এর সাহায্যে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। কিন্তু আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় না। যুক্তি আসে এই সংক্রান্ত অর্থ, সময় ও শ্রম সংকটাপন্ন অন্য রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসায় ব্যয় করলে অনেক কার্যকর ফল পাওয়া যেত। ব্রেন স্টেম ডেথ হলেই মৃত্যু ঘোষণার কথা ডাঃ সমীরণ নন্দীরা অনেকদিন বলে আসছিলেন। সেই ক্ষেত্রে মৃত ব্যাক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ অন্য যাদের একান্ত প্রয়োজন তাদের দেহে সংস্থাপিত করে তাদের বাঁচানো ও সুস্থ করে তোলা যেত। পাশাপাশি শ্রী ব্রজ রায়ের নেতৃত্বে ‘ গণ দর্পণ ‘ প্রভৃতি সংগঠন মৃত্যুর পর অঙ্গ ও দেহদান, চক্ষু দান বিষয়ে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
অন্যদিকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের মৃত্যু কিভাবে হবে তা নিয়ে তার চিন্তা যেমন স্বাভাবিক এবং সেই চিন্তা মানুষের জ্ঞান উন্মেষের প্রথম থেকেই। সেই সঙ্গে যদি কোন কঠিন রোগ বা দুর্ঘটনায় অচেতন ও অক্ষম হয়ে পড়েন কিংবা বৃদ্ধাবস্থায় একেবারে দুর্বল ও অশক্ত হয়ে পড়েন এবং সামগ্রিকভাবে পরিবার, স্বজন ও সমাজের বোঝা হয়ে অথবা অবহেলিত হয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকেন তার থেকে স্বেচ্ছা মৃত্যুই শ্রেয় ভাবনাও তখন থেকেই। অনেক পরে সেটি ওষুধ ইত্যাদির মাধ্যমে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু (Euthanasia or Mercy Killing or Assisted Suicide) এবং তার অধিকার, অঙ্গীকার ও সংশ্লিষ্ট আইন হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসে। প্রাচীন যুগে জৈন সাধক এবং দর্শনপন্থীরা একটি বয়সের পর খাদ্য ও জল গ্রহণ না করে প্রকৃতির মধ্যে নিরালায় ধ্যান বা মনঃসংযোগপূর্ণ অবস্থায় মৃত্যুকে বরণ করে নিতেন। কথিত আছে জৈন দর্শন অনুসারী পরাক্রমশালী মগধ সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এভাবেই শ্রাবণবেলগোলায় দেহত্যাগ করেন। এই পদ্ধতিকে অভিহিত করা হত সাল্লেখানা, সাম্লেহানা, সমাধি মরন, সন্ন্যাস মরণ, সান্থারা প্রভৃতি নামে। প্রাক্তন বিপ্লবী ও হিন্দু মহাসভার সভাপতি বিনায়ক দামোদর সাভারকার স্ত্রী বিয়োগের পর মৃত্যুর এই পথ বেছে নিয়ে নামকরণ করেন ‘ আত্মরপন ‘। কয়েক বছর আগে কলকাতার ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনস এর এক জৈন ব্যাবসায়ী পরিবারের বৃদ্ধার সান্থারা পদ্ধতিতে মৃত্যু বরণ নিয়ে শোরগোল হয়েছিল।
হিন্দু ধর্মে চতুরাশ্রমের শেষ দুই পর্যায় বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসে সংসার থেকে মুক্তি, মোক্ষ লাভের চেষ্টা, সংসার ত্যাগ করে বনে গমন ইত্যাদির নির্দেশ থাকলেও মৃত্যু পদ্ধতি নিয়ে কিছু স্পষ্ট করে বলা নেই। সুতরাং স্বেচ্ছামৃত্যু নতুন কোন ধারণা নয়। অতীতেও ছিল, আধুনিক যুগে আইনসম্মত ভাবে উঠে আসে। বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়। যার ফলস্বরূপ বেলজিয়াম, কানাডা, কলম্বিয়া, লাক্সেমবুরগ, পর্তুগাল, নিউজিল্যান্ড, দ্যা নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে, অস্ট্রেলিয়ার একটি বাদে সবকটি রাজ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসিদ্ধ। নবতিপর বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক জা লুক গদারকে সম্প্রতি আমরা স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করতে দেখলাম। আবার স্বেচ্ছামৃত্যু আইনের যেমন বিভিন্ন জটিলতার দিক রয়েছে, অপপ্রয়োগেরও বিপদও রয়েছে। স্বেচ্ছামৃত্যু অনেকরকম হতে পারে। প্রধানত চার রকমের স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা আলোচিত হয়। (১) ঐচ্ছিক স্বেচ্ছামৃত্যু (ব্যাক্তির ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যু নিশ্চিত করা), (২) অনৈচ্ছিক স্বেচ্ছামৃত্যু (ব্যাক্তির অচেতন অবস্থায় অপর কোন ব্যাক্তি বা নির্দেশিকায় মৃত্যু নিশ্চিত করা), (৩) সরাসরি স্বেচ্ছামৃত্যু (বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ, বিষ ইত্যাদি প্রয়োগে মৃত্যু নিশ্চিত করা) এবং (৪) অন্যভাবে স্বেচ্ছামৃত্যু (ওষুধ বা বিষের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা)।
সম্মানের সাথে মৃত্যুঃ ১৯৩৫ এ ভারতীয় আইনের অনুচ্ছেদ ২১ এর ব্যাক্তি স্বাধীনতার একটি ধারাকে কেন্দ্র বিন্দুতে ধরে দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় আদালতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায় বেরিয়েছে। পরিশেষে ২০২৩ এ সুপ্রিম কোর্টে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার সংক্রান্ত রায়টি বেরোয়। এই রায়ের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিদ্বজ্জনদের একাংশ সম্মানের সাথে মৃত্যুর অধিকারকে তুলে ধরছেন এবং সেই সংক্রান্ত আইনি অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করছেন। অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু প্রধান প্রশ্ন ১৪৪ কোটির দেশে কজন এর আওতাভুক্ত হতে পারবেন? আগেই বলেছি যে দেশের ও রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ জানেন না আগামীদিন কিভাবে চলবে? যে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের নুন আনতে পান্তা ফুঁড়োয় তাদের কাছে এটি কোন বিষয় নয়। ধর্ম ও জাতপাতের দেশে তারা জানেন মৃত্যু তাদের বিধির বিধান। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তারা ইহলোকে এসেছেন, আবার সময় হলে ঈশ্বরই তাদের ডেকে নেবেন। এছাড়াও শুধু রায় হলে হবেনা বিষয়টি কার্যকর করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অন্যান্য আইনি বাধাগুলি রয়েছে। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় সকলে এই অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করলেন। তাদের সবাইকে কি এই পরিষেবা দেওয়া সম্ভব?
সুতরাং আমাদের মনযোগ দেওয়া উচিত এমন বিষয়গুলিতে যাতে সমগ্র জনসংখ্যা সুফল পায়। প্রতিটি নাগরিকই যাতে সম্মানজনক মৃত্যুর সুযোগ পান। আমরা যদি মার্কিন ও রাশিয়া দুই বৃহৎ শক্তির সাথে সখ্য রেখে প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলি এবং আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারি, তারসাথে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিজেরাই প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে সামরিক খাতে বিপুল বাজেট কমিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বৃদ্ধি করতে পারি। এর ফলে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে সকলের জন্যে সম্মানজনক প্রসব, জন্ম, চিকিৎসা ও মৃত্যুর ব্যাবস্থা করতে পারি। সেটা যদি নাও বা পারি স্বাস্থ্যে আর মাত্র ২% বাজেট বৃদ্ধি করে, অপচয় ও দুর্নীতি গুলি বন্ধ করে, অন্য অনেক দেশের মত সুফলদায়ী ও পরীক্ষিত ‘ ইউনিভারসাল হেলথ কাভারেজ ‘ লাগু করতে পারি। যেটি প্রবর্তন করার দাবিতে ‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ‘ সহ বিভিন্ন সংগঠন প্রয়াস চালিয়ে আসছে। করের অর্থ থেকে চলা এই তুলনামূলক কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় কোন ধরনের চিকিৎসাতেই ব্যাক্তি অর্থ খরচের প্রয়োজন হবেনা। জন্ম, চিকিৎসা, বার্ধক্যের শুশ্রূষা সবই হবে সুরক্ষিত। ফলে মৃত্যুও হবে মসৃণ এবং সম্মানজনক।
৪ জানুয়ারি ২০২৪