আমি জানি, আমার ‘মারীর দেশ’ সিরিজের লেখাগুলো ভীষণ একঘেঁয়ে। ‘সেই তো একই ঢাল-তলোয়ার’, সেই তো একই দৈত্যদানো। সামান্য কিছু টুকরো-টাকরা ঘটনা বাদ দিলে অধিকাংশ লেখাগুলোই একঘেঁয়ে রকম মন খারাপের। আসলে এই লেখাগুলোর একটাও কেউ পড়বে, বাহবা দেবে ভেবে আমি লিখি না। এই লেখাগুলো কোভিডকালে আমার প্রাত্যহিকতার ডায়েরি। আমার একান্ত স্বগোতক্তি। বলাই বাহুল্য, তার বেশিরভাগই ভীষণ বিমর্ষ, ভীষণ ম্যাড়মেড়ে। অন্যান্য সব মহামারীর মত করোনাকালও শেষ হয়ে যাবে একদিন। আবার স্কুল খুলবে, বাচ্চারা নির্ভয় খেলবে, অফিস টাইমে ট্রেনে বাসে বিচ্ছিরি ভিড় হবে, শাবল গাঁইতির ঠং ঠং আওয়াজ হবে, ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যাবে, কোনও কিশোর কাঁপতে কাঁপতে ঘামে ভেজা চিঠি ধরিয়ে দেবে প্রেমিকার হাতে, রুক্ষ দিনের শেষে গনগনে লাল সূর্য তামাটে হতে হতে হারিয়ে যাবে সুবর্ণরেখার পাথুরে জলে। সেসব সন্ধ্যায় আমি বড় মমতায় খুলে দেখব আমার ডায়েরির পাতা। আমার ফেলে আসা দিনের ঘামের কথা, নির্ঘুম রাতের ইতিহাস। তখন আমার চামড়া ঝুলবে, থেকে থেকে কোমরে ব্যথা, চুলগুলো সব বিদায় নিয়েছে কবেই। সেসব সন্ধ্যায় নিজেকে প্রশ্ন করব, কেন লিখেছিলাম এসব? শুধু মন খারাপের রোজনামচা নিয়ে এত মাতামাতি কেন? কোত্থেকে যেন এক ক্ষ্যাপা পাগল ছুটে আসবে। চিৎকার করে বলবে, “মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করবো?” আমি তখন ডায়েরির পাতা বুকের উপর চেপে ধরে চোখ রাখবো ধ্রুবতারায়…
ডাক্তার হওয়ার সুবাদে রক্তের জন্য হাহাকার দেখি রোজ। অন্য সব বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে যদি শুধু থ্যালাসেমিয়া বাচ্চাদের কথাই ধরি, তাতেই সেসব রক্তের জন্য টানাটানির গল্প বলে শেষ করা যাবে না। থ্যালাসেমিয়া বাচ্চাদের চিকিৎসার বিষয়ে আমরা পড়ি একরকম আর বাস্তব চিত্র দাঁড়ায় সম্পূর্ণ উল্টো। রক্ত নিতে আসার সময় অনেকেরই হিমোগ্লোবিন নেমে যায় ৪-৫ কিংবা তারও কমে। লকডাউনের জন্য যাতায়াতের অসুবিধে ইত্যাদি মিলিয়ে সে সমস্যা আরও বেড়েছে। অথচ সঠিক চিকিৎসা হলে থ্যালাসেমিয়া বাচ্চারাও প্রায় স্বাভাবিক বাচ্চার সমানই বেড়ে উঠবে। আমাদের দেশে সেসব হয় না বললেই চলে। ঘনঘন রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়লেই পিলেটা বাড়তে শুরু করে। তার সাথে অপুষ্টি আর অন্যান্য রোগভোগ তো আছেই। অনেকের পিলে কেটে বাদ দিতে হয়। রক্ত আনতে গেলে অনেক সময়ই রক্ত পাওয়া যায় না। রক্তের দালালরাও ওঁত পেতে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। এভাবেই চলতে চলতে ঝুপ করে কোনও একদিন…
অথচ আমরা একটু সচেতন হলেই ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের অভাব হওয়ার কথা নয়। আর পাঁচটা জিনিসের মতো রক্তদানও একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যেই আসা উচিত। আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই রক্ত দিতে কোনও বাধা নেই। অথচ, রক্তদানের কথা বললেই আমরা না-বাচক কথাগুলোই প্রথমে ভাবতে শুরু করি। রক্ত না দেওয়ার জন্য জোর করে বিভিন্ন যুক্তি খাড়া করি। যার অধিকাংশই ভিত্তিহীন। ফ্যাটফেটে সাদা রক্তহীন চোখ, রক্ত ভেঙে গিয়ে জন্ডিস, রক্ত তঞ্চনের ক্ষমতা কমে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনবরত রক্তপাত, রক্তের অভাবে শ্বাসকষ্ট; এসব বহুদিনের বহুপরিচিত ঘটনা। রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা একসময় পড়েছিলাম। এখন ছুঁয়ে দেখি।
আজ হাসপাতালে রক্তদান শিবির ছিল। এদিকে পরপর নাইট ডিউটি চলছে। আউটডোর শেষের পর টুক করে সময় নিয়ে রক্ত দিয়ে এলাম। এখন একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। রাতে আবার ডিউটি। মারীর দেশ বলে যায়…
“এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”