খুব নামডাকওলা ডাক্তারই হোন কিংবা শিক্ষানবিশ ডাক্তার- সবাই জীবনের বিভিন্ন সময়ে ‘গোল’ খেয়েছেন। বলা ভালো, প্রায় প্রতিদিনই অল্পবিস্তর খান। অভিজ্ঞতা বাড়লে ‘গোল খাওয়া’ খানিক কমে বটে কিন্তু বন্ধ হয় না কোনোদিনই…
একদমে কথাগুলো বলে একটু থামলেন ডা. ঘোষ। ডাক্তারবাবুর চেম্বারে তাঁর জনাপাঁচেক এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী ‘কেস’ দেখবে বলে ভিড় জমিয়েছে। আমরা দরজার বাইরে উৎকর্ণ হয়ে শুনছি। সকাল সকাল ‘গোল খাওয়া’র কথা শুনে জিভের ডগায় নলেন গুড়ের রসগোল্লার স্বাদ বিড়বিড়িয়ে উঠছে।
– স্যার, ‘গোল খাওয়া’… মানে, ব্যাপারটা ঠিক…
– ও হো! (খানিক হেসে) চোখের সামনে পড়ে থাকা সোজা ডায়াগনোসিস মিস করে গেলে বা বোকার মতো ভুল করে ফেললে আমরা তাকে ‘গোল খাওয়া’ বলি। বুঝিসই তো, আমরা স্টেথোওলারা জীবনের এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে গোলকিপার। প্রতিনিয়ত গোলার মতো ছুটে আসবে রোগ আর মৃত্যু। পেনাল্টি শুট-আউটে দুর্বল শট আটকাতে না পারলে মুশকিল।
অ্যাপ্রন পরে, স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে প্রথমদিন ওয়ার্ডে সেজেগুজে আসা বাইশ-তেইশের ছেলেমেয়েগুলো চোখ বড় বড় করে তাকালো। ডা. ঘোষ বলতে শুরু করলেন– আসলে এই জটিল মানবদেহের এত কোটি ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, প্যাথোলজির ঘোরপ্যাঁচ সামলাতে গিয়ে আমরা সবাই ঘেঁটে যাই।
– আর বলবেন না স্যার… ফার্স্ট ইয়ারের অ্যানাটমি সামলাতে গিয়ে আমার নিজের নাম-ই ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বলেই হেসে ফেললো সামনের চেয়ারে বসা মৈত্রেয়ী। ডাক্তারবাবু চায়ের কাপে আরাম করে একটা চুমুক দিলেন।
– বুঝলি, তখন সদ্য ইন্টার্নশিপ শুরু হয়েছে। বেশ একটা ডাক্তার-ডাক্তার গন্ধ লেগেছে গায়ে। দু’দিনের বাচ্চার নাক দিয়ে জল ঝরছে। গিয়ে দেখি, মারাত্মক ব্যাপার। পায়ের তলায় বড় কালশিটে! ক’দিন আগেই ব্লাড কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডার পড়ে এসেছি। সব ফ্যাক্টর আর পাথওয়ে মাথার মধ্যে কিলবিল করছে। ব্লাড ইনভেস্টিগেশন, ফ্যাক্টর অ্যাসে, প্লাজমা ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি সাতপাঁচ ভাবছি। এমন সময় আমাদের ওয়ার্ড বয় এসে গজ পিসে স্যালাইন ভিজিয়ে পায়ে ঘষে দিতেই কালশিটে উধাও! বুঝতে পারলাম, কালশিটে নয়। ওটা বাচ্চার পায়ের ছাপ নেওয়ার রঙ ছিল। আবার পরে এরকমই এক বাচ্চার পায়ে কালচে দাগ দেখে দিব্যি রঙ বলে ভেবে বসে আছি। পরে বুঝেছিলাম, হোল ডেলিভারি কেসে জন্মের পর বাচ্চা কাঁদে নি দেখে বেশ করে পায়ের তলায় জোরে জোরে টোকা মেরেছে দাই-মা। ফলস্বরূপ, নরম পায়ে কালশিটে!
স্যারের সামনে বসা ছেলেমেয়েগুলোর চোখ তখন সত্যিই নলেন গুড়ের রসগোল্লার আকার নিয়েছে।
– তিনদিনের বাচ্চার একশো এক জ্বর! আমি তো দিব্যি সেপ্টিসেমিয়া ভেবে লাফঝাঁপ শুরু করেছি। এক সিনিয়র সিস্টার দিদি দেখে-টেখে বললেন, “ডাক্তারবাবু, আমার মনে হয় ওর সেরকম খারাপ কিছু নেই। আমি এই বাচ্চাটাকে দেখছি। আপনি থ্যালাসেমিয়ার দিকটা সামলান।” নিমরাজি হয়ে গেলাম।
প্রায় দু’ঘন্টা ঘেমে-নেয়ে এসে দেখি, বাচ্চা দিব্যি খাচ্ছেদাচ্ছে, হাত-পা ছুঁড়ছে! তাহলে জ্বর? সেপ্টিসেমিয়া? দিদিকে গিয়ে পাকড়াও করলাম। দিদি বুঝিয়ে দিলেন, “এই গরমে কেমন সোয়েটার পরিয়ে রেখেছিল দেখেছেন? তার ওপর বাচ্চা পেচ্ছাব একটু কম করছে। ডিহাইড্রেশনে নিউবর্নের ফিভার হয়। বাচ্চা কেমন অ্যাক্টিভ আছে দেখুন…” সত্যি সত্যিই বাচ্চার তারপরে আর জ্বর আসে নি।
– স্যার, এরকম হ’লে তো আমরা আর গোল বাঁচাতেই পারবো না…
– পারবি, পারবি। সব পারবি। ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে যেদিন জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যাবে সেদিন থেকে একটু একটু করে পারবি। আসলে ডাক্তারি বিদ্যায় বুদ্ধির থেকে ঘষটাতে পারার দাম বেশি। যত দেখবি, তত শিখবি। একদিনের কথা বলি শোন- সবে চ্যানেল করা শিখেছি। চ্যানেল করে স্যালাইন ঝোলাতে পারলেই তখন বুকের মধ্যে ‘বিধান রায় ফিলিং’ হয়। অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজের পেশেন্টের কবজিতে চ্যানেল করে স্যালাইনের বোতল ঝোলাতেই অবাক কান্ড! স্যালাইন যাওয়া তো দূরের কথা বরং স্যালাইনের নলের মধ্যে রক্ত উঠে আসছে! এ আবার কী ভুতুড়ে কান্ড! নাকি কারণসুধার জোরেই রক্ত টগবগিয়ে উঠেছে? আবার সমস্যার সমাধান করলেন এক নার্সিং স্টাফ দিদি। “ডাক্তারবাবু, চ্যানেলটা আর্টারিতে হয়ে গেছে!” তোরা বুঝতে পারলি ব্যাপারটা? আর্টারিতে প্রেশার অনেক বেশি। তাই রক্ত স্যালাইনের চাপ টপকে ওপরে উঠতে শুরু করেছে।
– এটা একটা দারুণ জিনিস শিখলাম স্যার…
– আরও কত কত গল্প… বললে শেষ হবে না। তখন পিডিয়াট্রিক্সে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করে হাসপাতালে জয়েন করে গেছি। একদিন ভয়ানক বিজি ওপিডিতে ডাক এলো- এক নিউবর্নের বমি হচ্ছে। সে অনেক সময়েই এরকম হয়। বাচ্চা দুধ খেয়ে অল্পবিস্তর দুধ তুলে দেয়। কখনো পেটের মধ্যে পায়খানা খেয়ে ফেললেও এরকম হয়। তারপর, নাড়িভুঁড়ি আটকে যাওয়া-টাওয়া… সেসব হাজার ফিরিস্তি। আমি দৌড়ে গিয়ে কোনোরকমে একঝলক দেখে টুকটাক ওষুধ দিয়ে আবার ওপিডিতে পেশেন্ট দেখতে শুরু করলাম। এদিকে আবার আধঘন্টা বাদে ডাক। বাচ্চার বমি থামছে না। এবার ভালো করে না দেখলেই নয়। গিয়ে পৌঁছোতেই বাচ্চার দিদা পান খাওয়া কালচে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো, “বমি বন্দ হবে কিগরা বল ত? ইয়ার ত পঁদের ফুটাই নাই। হাগা না হলে বমি বন্দ হবে নি।” আবার একবার শিখলাম, ভালো করে ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশনের কোনও বিকল্প নেই। বেমালুম গোল খেয়ে খেলাম। বাচ্চাকে সার্জারিতে রেফার করতে সেদিনই ওটি হয়ে যায়।
গল্পে গল্পে বেলা বাড়ছে। বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মুখ বাড়িয়ে স্যারকে সময়টা জানিয়ে দিলাম। এরপরে আর দেরি হ’লে পেশেন্ট দেখে দুপুরের খাবার খেতে অন্তত তিনটে বাজবে।
– এই গল্পটা বলেই আজকের মতো শেষ। তিন বছরের হাড় জিরজিরে নাতনিকে নিয়ে আদিবাসী বুড়ি ওপিডিতে এসেছে। বাচ্চার মুখভর্তি ঘা। গোটা শরীরে পুষ্টির অভাবের ছাপ স্পষ্ট। সহজ সমীকরণ মনে করে কন্যাসন্তানের প্রতি অবহেলা বিষয়ে বড়সড় বক্তৃতা ঝেড়ে দিলাম। কিছু তাজা শাকসব্জী আর ফলমূল খাওয়ালেই মুখের ঘা-গুলো সেরে যাওয়ার কথা। সেখানে এরকম অযত্নে রাখার জন্য বেশ কড়া ভাষায় বকে দিলাম। তারপর, বুড়ি যে কথাগুলো বলেছিল সেটা আমার আজও মনে আছে…
“উরকম লয় গো বাবু। উ মোদের লক্কি। সাতটা প্যাট চালাইতে হয়। মোদের পয়সা থাকলে কি খাবাইতিনি?”
জীবনে এত বড় ‘গোল’ কোনোদিন খাই নি।
ছবিঃ গুগল
নিদারুণ