ভারতে তীর্থস্থানগুলির বেশিরভাগই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত কেন? কেনই বা শতকের পর শতক ধরে মানুষ এত কষ্ট করে যেতো পুণ্য অর্জনে? আসলে অতি দুরূহ দুর্গম পথের শেষে মানুষ নিজের অন্তরে যে অদ্ভুৎ তৃপ্তি বা প্রশান্তি অনুভব করতো সেটাই হলো পুণ্য, হয়তোবা বাকি সারা জীবনের পাথেয়! “তীর্থের পথে চলার বড় কথাটা তীর্থ নয়, পথ ও চলা”.. সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল (পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার) অতি বিস্মিত হয়েছিলেন তীর্থস্থানের দেবালয়গুলির অসাধারণ অবস্থান এবং সেখানে পৌঁছানোর অসামান্য পাকদণ্ডী পথের পরিকল্পনাকে যা তাঁর মতে “সহস্রাব্দিপর বৃদ্ধ মহাপথ”।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ছোটভাই উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বহুবার গেছেন হিমালয়ের পথে। ১৯২৮ সাল নাগাদ উনি ওনার মা মানে আশুতোষ মুখার্জীর স্ত্রীকে নিয়ে কেদার বদ্রীর পথে গিয়েছিলেন মাসাধিক কাল ধরে। ওনার ভাষ্যেই,”তখনো বাসের রাজপথ হিমালয়ের অন্দরমহলে পৌঁছয়নি”। তীর্থযাত্রীদের ভরসাস্থল ছিল কয়েক মাইল অন্তর ‘চটি’ ও স্থানীয় মানুষের অকুণ্ঠ সহায়তা। যখন এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হলো, উনি আক্ষেপ করেছিলেন যে এতে স্থানীয় মানুষদের অনেক ক্ষতি হবে। যাত্রাপথে প্রতি পদক্ষেপে স্থানীয় মানুষের সহায়তার স্থান ক্রমশঃ অধিগ্রহণ করবে সমতলভূমির ব্যবসায়ীরা। আর, ঘটনা হলো বর্তমানে হোটেল ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার মূল চাবিকাঠিটাই চলে গেছে অস্থানীয়দের হাতে।
অমরনাথ, কেদারনাথ যাওয়া তো এখন কোনও ব্যাপারই নয় ; হেলিকপটারে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাচ্ছে, পকেটে পয়সা থাকলেই হলো!! দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়! তাহলে আর এতো খরচ করে ৮৮৯ কিমি এর ‘চার ধাম প্রকল্প’ এর প্রয়োজনটা কোথায়?? আবার শুধু সড়ক যোগাযোগ নয়, ৩২৭ কিমি এর ব্রডগেজ রেলওয়ে লাইন তৈরি হচ্ছে সড়কপথের প্রায় চারগুণ খরচে! এই রেলওয়ে লাইনের একটা বড় অংশই যাবে টানেলের মাধ্যমে। পরিবেশের প্রসঙ্গ ছেড়ে দিন, কারণ এটা নাকি কারুর স্বপ্নের প্রকল্প!! হ্যাঁ, এটা ঠিক এক সময়ে অনেক নব্য বা হঠাৎ ধনী ভদ্রলোকেরা এরকম স্বপ্নাদেশ পেতেন দেবালয় নির্মাণ বা প্রতিষ্ঠার জন্য ; লোকগাথায় তাদের নাম বহুকাল স্থায়ী হতো!! এরকম স্বপ্নাদেশ যে এযুগেও পাওয়া যাবে না সেকি আর হলফ করে বলা সম্ভব??
যাহোক, সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে রায় দিয়েছিল, রাস্তা ৫•৫ মিটার এর বেশি চওড়া করা যাবে না। কিন্তু, তাহলে কী লাভ হবে? তাই এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করা হলো, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে একে ন্যূনতম ১০ মিটার করতেই হবে। এতদিন সুপ্রীম কোর্টে বিভিন্ন শুনানিতে দেশরক্ষার কথাটা অনুক্তই ছিল! এর আগে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ২১ জনের HPC (High Power Committee) গঠিত হয়, যাদের অধিকাংশই সরকারি আধিকারিক হলেও কমিটির প্রধান ছিলেন বরিষ্ঠ পরিবেশবিজ্ঞানী প্রফেসর রবি চোপড়া। প্যানেল ২ টি রিপোর্ট দাখিল করে, যুক্তির দিক থেকে সুপ্রীম কোর্ট সংখ্যালঘু মতামতকেই মান্যতা দেয় আর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে। দেশের নিরাপত্তা কিন্তু এতদিন আলোচ্যসূচীর বাইরেই ছিল!
যাহোক দেশের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করার কথা তো সুপ্রীম কোর্টের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। তাই, DLPS (Double Lane Paved Shoulder) road project with minimum width of 10 metres অনায়াসে অনুমতি প্রাপ্ত হলো।
পরিবেশবিদ মল্লিকা ভানোতের মতে, “….It is only talking about the defence needs of the country. It is not talking about the food and water security we are dependent upon, it is not talking about the safety of the residents, it is not talking about security of the tourists and the pilgrims………………
……. It is preposterous to say that tourist related projects have suddenly become defence projects.”
SADRP( South Asia Dam River People)এর কোঅর্ডিনেটর হিমাংশু থক্করের মতে, “The Supreme Court had earlier already gone through the whole process and directed that the project cannot happen. After that they(the Centre) brought in the security issue, and now they are saying that we require it for the security. This is very unfortunate.”
প্রফেসর রবি চোপড়া অবশ্য HPC থেকে এর আগেই বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ করেছেন।
তাহলে, আর তো কোনও বাধাই রইলো না; চীন সীমান্ত পর্যন্ত সব কিছু মসৃণ সম্পূর্ণ বাধাহীন………………………
………………………………………
সিল্কিয়ারা টানেল বিপর্যয় নিশ্চিতভাবে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
তবে, সমস্ত ঘটনাবলীর মধ্যে আশার আলো (Silver lining) একটাই আটক শ্রমিকদের সফল উদ্ধারকার্য এবং পরিশেষে ‘Rat miner’দের অসাধারণ ভূমিকা ও মাত্র সাতাশ ঘন্টার মধ্যে অসাধ্যসাধন। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে শ্রমিকদের কাছে প্রথম পৌঁছোন ফিরোজ কুরেশি ও মনু কুমার।উল্লাসে উদ্বেল আটক শ্রমিকেরা তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করলে তারা বলেন,”ভগবান নেহি, হাম আপকো মাফিক মজদুর হুঁ”। পরবর্তী কালেও তারা বলেন তাদের কোনও পুরস্কার লাগবে না, এই কাজটা করতে পারাটাই বিরাট পুরস্কার!! কথাটা কিন্তু শুধু বলার জন্য বলা নয়। তাদের কাজেরও যে বিরাট মূল্য আছে, সেখানেও যে অভ্যাস ও দক্ষতার পরিসর বিশাল, এই স্বীকৃতিটাই তো তাদের কাছে সত্যিই অনেক, প্রায় অকল্পনীয়! সারা দেশ তাদের তারিফ করছে, অন্ধকার গহ্বর থেকে অতি অনায়াস দক্ষতায় যন্ত্রকে পরাস্ত করে বার করে আনতে পেরেছে আটক শ্রমিকদের.., সমস্ত জীবনে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!!! কাজের এই অভাবনীয় অনন্য সন্তুষ্টি বা পরিতৃপ্তি যদি পুণ্য না হয়, তাহলে পুণ্যের সংজ্ঞা কি?? দেবস্থান থেকে দেবস্থানে ঘুরে বেড়িয়েও এর ধারে কাছে কোনও প্রাপ্তি কি আদৌ সম্ভব?? কোনোদিন??………….