প্রতি বছর ২১ শে সেপ্টেম্বর ‘অ্যালজেইমার দিবস’ পালিত হয়। অ্যালজেইমার ডিজিস (Alzheimer’s Disease) হল ডিমেনসিয়ার(Dementia) একটি প্রধানতম কারণ! খুব সহজে ডিমেনসিয়াকে বলা যায় বয়সকালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলার রোগ! বিজ্ঞানী অ্যালজেইমার ১৯০৬ সালে ডিমেনসিয়ার একটা বিশেষ কারণ হিসেবে ‘অ্যালজেইমার ডিজিস’ কে বর্ণনা করেছিলেন। এবং আজকেও ডিমেনসিয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অ্যালজেইমারস ডিজিস’ কেই ধরা হয়। ১৯৯৪ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর অ্যালজেইমার ডিজিস ইন্টারন্যাশনালের ১০তম পূর্তি উপলক্ষে ‘অ্যালজেইমার দিবস’ প্রথম পালিত হয়।
দেখা গেছে আমাদের সমাজের প্রায় ৮০% লোকজন ডিমেনসিয়া সম্বন্ধে অবগত নয়! প্রায় ৯০% এর উপরে চিকিৎসার ব্যবধান(Treatment Gap)। যার মানে হল আমাদের দেশে যদি ১০০ জন ডিমেনসিয়ার রোগী থাকে তার মধ্যে ৯০ জন রোগীই কোনও চিকিৎসা পায় না! এবং সমস্ত জায়গায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবার অপ্রতুলতা এর বোঝাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সাধারণত ডিমেনসিয়া বয়স্ক লোকেদের মধ্যে প্রভাব ফেলে! ভারতবর্ষে প্রায় ৫০ লাখ এর উপরে বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ডিমেনসিয়াতে আক্রান্ত! তার মধ্যে ৬০% এর কারণ হল ‘অ্যালজেইমারস ডিজিস’। এটা খুব পরিষ্কার যে আজ এই বয়স্ক মানুষদের কাছে আমাদের চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে! শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে তার ‘অ্যালজেইমারস ডিজিস’ এ ভুগছেন, তাঁদের আর্থিক দুর্বলতা, তাঁদের পারিবারিক অবস্থা ও সামাজিক যোগাযোগও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়! কেননা অনেক সময়ই তাঁদের অবহেলা করা হয়, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়! তাই তাঁদের সমস্ত দিক থেকে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আজ প্রয়োজনীয় ও জরুরি। এই বছরের থিম হল- Know Dementia, Know Alzheimer’s। অর্থাৎ ‘ডিমেনসিয়া কে জানুন, অ্যালজেইমারকে বুঝুন,’ এই বছরের প্রচারের মূল লক্ষ্য হল ডিমেনসিয়ার বিপদজনক ও প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্বন্ধে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা আনা ও আগে ভাগে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া!
ডিমেনসিয়া কী??
ICD (International Classification Disorder) 10 বলছে- ডিমেনসিয়া হল বয়সকালে শুরু হওয়া দুরারোগ্য অসুখ, যেখানে আপনার সমস্ত কগনিটিভ(Cognitive) ফাংশান কমে যায়, মানে আপনার মনে রাখার ক্ষমতা (Memory), আপানর ভাবনা চিন্তার দ্রুততা, স্বচ্ছতা, আপানার মনোযোগ রাখার ক্ষমতা,ভাষাগত জ্ঞান,সিধান্ত নেওয়ায় ক্ষমতা আগের চেয়ে কমতে শুরু করে মস্তিষ্কের এই ক্রমাগত স্নায়ুক্ষয়জনিত (Neuro-degenerative) রোগের কারণে। DSM-5(Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorder) একে মেজর নিউরোকগনিটিভ ডিসঅর্ডার (Major Neurocognitive Disorder) বলে চিনহিত করে! ডিমেনসিয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সমস্ত পৃথিবী জুড়েই প্রধানতম কারণ হিসেবে উঠে এসছে ‘অ্যালজেইমারস ডিজিস’। এটি একটি ক্রমাগত বাড়তে থাকা রোগ, যার কোনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই একমাত্র চিকিৎসা বলতে এই রোগের বাড়তে থাকাকে আমরা বন্ধ করতে পারি বা কমাতে পারি মাত্র!
আমাদের ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কেমন??
ভারতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটির কাছাকাছি। ১৩ থেকে ১৪ কোটি মানুষ হল সিনিয়র সিটিজেন অর্থাৎ ৬০ এর উপরে বয়স। তার মধ্যে ৫% বয়স্করা ভুগছেন ডিমেনসিয়াতে। অর্থাৎ ৫০ লাখ মানুষ এই ডিমেনসিয়াতে ভুগছেন, যার মধ্যে প্রায় ৬০% ‘অ্যালজেইমারস ডিজিসে’ আক্রান্ত।
পরিষ্কার করে বলে রাখা ভালো শুধুমাত্র এই ৫০ লাখ লোক ডিমেনসিয়াতে ভুগছেন এমন নয়, তাঁদের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক একটা গোটা পরিবার! যা কিনা সেই পরিবারের কাছে এবং সমাজের কাছে ধীরে ধীরে বোঝা হয়ে ওঠে! ৬০-৭০% ডিমেনসিয়ার রোগীদের নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাতে একজন এর সহায়তা সবসময় প্রয়োজন। এবং একজন মানুষকে দিনের ২৪ ঘণ্টাই তার সাথে তার দেখভালের জন্যে থাকতে হয়!
অ্যালজেইমার ডিমেনসিয়ার কী কী লক্ষণ??
মনে রাখতে না পারা (Memory Loss) নতুন জিনিস শিখতে না পারা ( Implicit Learning Impairment)- সদ্য ঘটনাগুলোকে ভুলে যাওয়া, সকালে খাবার খেয়ে ভুলে যাওয়া, জিনিসপত্রের নাম, শব্দ মনে করতে না পারা, নিজের জীবনের পুরনো ঘটনা একদম মনে করতে পারা।
ভাষাগত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, ব্যাকরণজাত ভুল, বাক্য তৈরি করতে না পারা। কথাবার্তা বলার দক্ষতা, যোগাযোগ রাখার ইচ্ছে ও ক্ষমতা কমে আসা। লিখতে, পড়তে ও গুনতে ক্রমাগত অসুবিধার মধ্যে পড়া!
মানুষজন, নিজের চেনা পরিচিত জায়গা চিনতে না পারা যেমন-ঘরের বাথরুম এর পথ কোথায় চিনতে না পারা, পরিবারের লোকজনকে চিনতে না পারা, জিনিস পত্রের ব্যবহার ভুলে যাওয়া, অনুকরন করার ক্ষমতা চলে যাওয়া।
মনোযোগ না রাখতে পারা, টিভি দেখতে দেখতে কথা ও ছবির সাথে তাল রাখতে না পারা, খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়া, চিন্তা ভাবনার দ্রুততা কমে আসা।
সময়জ্ঞান নিয়ে ধন্দে থাকা, কোন মাস, কোন ঋতু ভুলে যাওয়া। মাঝে মাঝে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হওয়া, অকারণে সন্দেহ করা, মন-মেজাজ খিঁচড়ে থাকা,, সামাজিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলা, স্বতঃস্ফূর্ততা ও কাজে উদ্যোগ নেওয়া হারিয়ে ফেলা!
কী কারণে অ্যালজেইমার ডিজিস হয়?
অ্যালজেইমার ডিজিস এর কারণ হিসেবে আজ অবধি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি! যদিও বর্তমানের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ সুনিশ্চিতভাবে বলছে মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষ (Neuron) গুলো ক্ষয়ে যেতে থাকে, এক স্নায়ুর সাথে আর এক স্নায়ুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং কোষ গুলো মারা যায়! এইভাবে মস্তিষ্কের সমস্ত অংশের আয়তন হ্রাস পেতে থাকে! শুকিয়ে যেতে থাকে!
দেখা গেছে এনাদের মাথার মধ্যে কিছু সাদা থকথকে হলদে পদার্থ পাওয়া যাচ্ছে যা প্রধানত দুরকমের একটা হল- নিউরোফাইব্রিলারি ট্যাঙ্গেল(Neurofibrillary Tangles) যা স্নায়ু কোষ মারা যাওয়ার পর তৈরি হয় আর একটা হল অ্যামাইলয়েড প্লাক(Amyloid Plaques) যা কোষের বাইরে নিউরোটক্সিক পদার্থ হিসেবে জমা হয়! এই দুই প্রোটিন জাতীয় পদার্থই মূলত নিউরন ধ্বংসের জন্যে দায়ী।
অ্যালজেইমার অনেকাংশেই জিন বাহিত। বিশেষত APO E4 অর্থাৎ APO E জিনের E4 ভার্সান অ্যাপোলাইপো-প্রোটিন E4 প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। যা কিনা পরবর্তীতে নিউরোফাইব্রিলারি ট্যাঙ্গেল ও অ্যামাইলয়েড প্লাক জমা করে যা কিনা ডিমেনসিয়ার লক্ষণ গুলো নিয়ে আসে। এছাড়া ক্রোমোসোম নাম্বার ২১ এ APP (Amyloid Precursor Gene ) এবং PSEN-1 (ক্রোমোসোম ১৪ ) এবং PSEN-2(ক্রোমোসোম ১) জিন অ্যালজেইমার ডিজিস এর জিন্যে দায়ী। কিন্ত ঠিক কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এটি সম্পন্ন হয় তা এইমুহুরতে দাঁড়িয়ে গবেষণা সাপেক্ষ! তবে কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার নতুন ভাবনাচিন্তার জন্ম দিচ্ছে।
কাদের ক্ষেত্রে অ্যালজেইমার ডিজিস হবার সম্ভাবনা বেশি??
বেশি বয়সকাল, পারাবারিক রোগের ইতিহাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ওবেসিটি(ওজন বৃদ্ধি), নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার, মাথায় কোনও বড় ধরণের আঘাত, খুব বিশৃঙ্খল জীবন, বাজে ঘুমের অভ্যাস তাঁদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়লে ডিমেনসিয়া হতে পারে।সাধারণত ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগ এর লক্ষণ গুলো বাড়ির লোক ও রোগী নিজেও বুঝতে শুরু করে।
ডায়াগনোসিস করব কীভাবে?
অ্যালজেইমারের ডায়াগনোসিস খুব সহজে করা যায় না! টেক্সট বই বলে- অন্য কোনও কারণ না থাকলে তবেই এক ডায়াগনোসিস করা হবে (Diagnosis of exclusion)।
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে একজনের শারীরিক ও মানসিক রোগ সম্বন্ধে জানা ও পরীক্ষা করা, শারীরিক ও নিউরোলজিকাল পরীক্ষা খুঁটিয়ে করা, বিভিন্ন রক্ত ও মুত্রের পরীক্ষা করে, মাথার স্ক্যান করে, মনের অবস্থা পরীক্ষা করে, কগনিটিভ টেস্ট (মস্তিষ্কের বিভিন্ন কাজ করার ক্ষমতা) করে অর্থাৎ ডিমেনসিয়ার সম্ভাব্য অন্যান্য কারণগুলোকে বাদ দিতে হবে। যেমন কেউ যদি অনেকদিন ধরে নেশা করেন প্রধানত অ্যালকোহল, মদ খেয়ে থাকেন তাহলে তা থেকে ডিমেনসিয়া হতে পারে, কেউ যদি অনেকদিন ধরে অপুষ্টিতে ভোগেন, কারও যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাহলে স্ট্রোক অনেক গুলো ছোট ছোট স্ট্রোক এই ডিমেনসিয়া করতে পারে, কোনও টিউমার, কোনও ইনফেকশান, মৃগী রোগ, হরমোনের গণ্ডগোল, এইসব কারণেও ডিমেনসিয়া হতে পারে। তাই এগুলোকে বাদ দিয়ে অ্যালজেইমার এর কথা আমাদের ভাবতে হবে।
অ্যালজেইমার ডিমেনসিয়ার চিকিৎসা কী??
এই মুহূর্তে অ্যালজেইমার ডিমেনসিয়ার কোনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই!
শুধুমাত্র ডিজিস এগোনোর প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অর্থাৎ মস্তিষ্কের মধ্যে দ্রুতগতিতে নিউরনের যে ক্ষয় চলছে তাকে কমিয়ে আনা!
ডিমেনসিয়া রোগীর যত্ন নেওয়া, যে সাহায্য করছে- কেয়ার গিভার তার কাজ কে ভাগ করে নেওয়া, তাকে উপযুক্ত ট্রেইং এর ব্যবস্থা করে দেওয়া, যাতে বাড়িতে রেখেও একজন অ্যালজেইমার রোগীর চিকিৎসা কর যায়!
পাশাপাশি পূর্বোক্ত কোনও রকম আলাদা অসুখ আছে কিনা যেমন মৃগী, অপুষ্টি, নেশা করা, উচ্চ রক্তচাপ, এগুলো থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে।
কীভাবে রোগের প্রক্রিয়াকে হ্রাস করা যায়?
বিভিন্ন মেডিসিন যেমন ডোনেপেজিল(Donepezil) ও মেমানটিন(Memantine) অ্যালজেইমার ডিজিস এর ক্ষেত্রে খুব ব্যবহৃত হয় যা কিনা রোগের লক্ষণ কিছুটা হলেও কমায়!
খুব সম্প্রতি অ্যাডুকানুমাব (Aducanumab) নামে একটি ড্রাগ যা মূলত অ্যান্টিবডি FDA থেকে সম্মতি পেয়ে জনসাধারনের মধ্যে ব্যবহারের জন্যে বাজারে এসছে! যা কিনা অ্যামাইলয়েড প্লাক এর বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের পরিমাণ কমিয়ে আনবে। যদিও অনেক দেশেই এটি এখনও পাওয়া যায় না, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ ডিমেনসিয়ার লক্ষণ অনেকাংশে কমিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে!
পাশাপাশি যদি অন্য-কোনও মানসিক সমস্যা থাকে, যেমন ডিপ্রেশান এ থাকলে অনেক সময়ই চিন্তা ভাবনা হ্রাস পেয়ে যায়, মনোযোগ কমে যায় যা অনেক সময় ডিমেনসিয়ার সাথে গুলিয়ে যেতে পারে! তাই খুব যত্ন সহকারে মূল্যায়ন দরকার। অনেকসময় দেখা গেছে ডিমেনসিয়ার রোগীরা প্রচণ্ড রেগে গিয়েছেন, কান্নাকাটি করছেন, কিম্বা হ্যালুশিনেশান হচ্ছে, ভাঙচুর করছেন, জামাকাপড় খুলে ফেলে দিচ্ছেন তখন তাদের BPSD (Behavioral and Psychological Symptoms of Dementia) বলা হয়। খুব অল্প ডোজে হলেও অ্যান্টিসাইকোটিক, মুড স্টেবিলাইসার, বেঞ্জোডায়াজেপিন দেওয়া হয়!
নন-ফার্মাকোলজিকাল পদ্ধতি অর্থাৎ ওষুধ ছাড়া আর কী কী করতে পারি আমরা?
মেডিসিন ছাড়াও অন্যান্য অনেক উপায় রয়েছে যা দিয়ে আমরা ডিমেনসিয়া রোগীদের সাহায্য করতে পারি, যত্ন নিতে পারি। যিনি রোগীর সাথে সবসময় রয়েছেন তার উপযুক্ত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে ডিমেনসিয়া রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা চালাতে পারি।
সমস্যা হল ভারতে এই ট্রেনিং দেওয়ার লোক এবং ব্যবস্থা দুটোই খুব কম।
উল্লেখযোগ্য উপায় হল Reminiscence Therapy (স্মৃতিচারণ পদ্ধতি) যেখানে রোগীর সামনে পুরনো ঘুড়তে যাওয়ার ছবি, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনের ছবি রেখে তার সঙ্গে গল্প করা হয়। যেখানে তারা পুরনো জিনিস মনে করে আনন্দ পায়, তাদের ভেতরের দুশ্চিন্তা অনেকটা কমে আসে, তাদের পছন্দের পুরনো গান বা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা তাদের সূত্র গুলো ধরিয়ে দেওয়া কে গেয়েছে, ছবিতে কে অভিনয় করেছে এইভাবে তাদের পুরনো স্মৃতির নাগাল পাইয়ে দেওয়া সম্ভব।
Validation Therapy (বৈধতা-দায়ক পদ্ধতি) এটা খুবই স্বাভাবিক যে ডিমেনসিয়া রোগীরা খুব আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন! নিজেদের ভুলে যাওয়ার জন্যে, বাড়ির পরিচিত লোকের নাম না মনে আসার জন্যে নিজেরাই কষ্টে ভোগেন, খুব তীব্রতর মানসিক টানাপোড়েন চলতে থাকে নিজের সাথে! ভ্যালিডেশান থেরাপি হল যেখানে তাদের এই আচরণগত সমস্যা গুলো কমিয়ে আনার জন্যে জোর দেওয়া হয়,বিশেষত বাড়ির লোককে কিছু বিষয়ের উপর ট্রেনিং দেওয়া হয়, অল্প কয়েকটি সেশান বা পর্বেই যা সম্ভব!
Reality Orientation Therapy (বাস্তবতা নির্ণায়ক পদ্ধতি) এখানে মূলত ডিমেনসিয়া রোগীদের যে বিভ্রান্তিকর অবস্থা, সময় স্থান নিয়ে তাদের যে ধাঁধার মধ্যে থাকেন সেইটা কমিয়ে আনা হয়। বারবার তাদেরকে টাইম, দিন, তারিখ বলে দেওয়া। ঘরের কোন জায়গায় কী রাখা আছে সেগুলো বুঝিয়ে দেওয়া, দরকারে ঘড়ি ক্যালেন্ডার হাতের কাছেই রেখে দেওয়া!
Cognitive Stimulation Therapy (চিন্তা-ভাবনা উদ্দীপক পদ্ধতি)- এখানে গ্রুপের মধ্যে কিম্বা কমিউনিটি সেটিং এ অথবা একা একা বিভিন্ন কগনিটিভ টাস্ক দেওয়া হয় যেমন দাবা খেলা, পাজল সল্ভ করা, ছবি সাজানো এতে মস্তিষ্কের সচল রাখার নেটওয়ার্ক গুলো সাবলীল থাকে।
কীভাবে একজন ডিমেনসিয়া রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করব??
আচ্ছা সত্যিই কী বাড়িতে রেখে চিকিৎসার দরকার আছে?? হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেই তো হয়! একবার ভাবুন তো ভারতে ৫০ লক্ষের উপর ডিমেনসিয়া রোগীদের ভর্তি করতে চাইলে অত সংখ্যক বেড কোথায় পাওয়া যাবে?? তার উপর একটা বিশাল অর্থের বোঝা তো আছেই।
বিভিন্ন স্টাডি বলছে শহরাঞ্চলে ডিমেনসিয়ার একজন রোগীর প্রতি প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা খরচ হয়, গ্রামের দিকে সেটা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। একটা পরিবারের কাছে এই আর্থিক বোঝা হয়ে ওঠে! ধরা যাক ভারতীয় স্টেট ঠিক করল ৫০ লাখ পরিবারের জন্যে মাসে ১০০০ টাকা করে দেওয়া হবে, তাহলে মাসে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে, বছরে হবে ৬০০০ কোটি টাকা! শুধু আর্থিক বোঝার কথা ভাবলেই সমস্যা যে অনেক দূর তা বোঝা যায়, পাশাপাশি রয়েছে স্টিগমা, মানসিক সমস্যা, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! তাই ঘরেই এই রোগের চিকিৎসা দরকার, বাড়ির লোকজনকে উপযুক্ত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা দরকার, কাজ ভাগ করে নেওয়ার কথা কমিউনিটিতে চালু হওয়া দরকার, বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য কর্মীরা দেখে আসবেন এই পরিষেবা চালু খুব গুরুত্বপূর্ণ! দিনের বেলায় অন্য একজায়গায় রেখে কিছু ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দেওয়া, খুব বাড়াবাড়ি হলে ডিমেনসিয়া ক্লিনিকের সাথে ফোনে কথা বলে, ডিমেনসিয়া হোমে কিছুদিনের জন্যে দেখভাল করা!
তবে ভারতের মতো দেশে সবচেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল একজন মানুষ যিনি যত্ন নিচ্ছেন (Care giver) নিজের পরিবারের আর একজন ডিমেনসিয়া রোগীর তাঁকে ট্রেনিং এর মাধ্যম্যে কীভাবে কতটা দক্ষ করে তুলতে পারছি! সেটাই আজকের কমিউনিটিতে অত্যধিক মাত্রায় জরুরি!
শুশ্রূষাকারী অর্থাৎ কেয়ার গিভারের বার্নআউট বা স্ট্রেস সামলাতে আমরা কী করতে পারি?
একজন ডিমেনসিয়ার রোগী সাধারণত প্রায় ৯-১৫ বছর বাঁচেন, একজন ডিমেনসিয়া রোগীকে দিনের ২৪ ঘণ্টা সময় ওনাকে দিতে হয় তার দেখভালের জন্যে! সুতরাং তার উপর কাজের বোঝা ও দায়িত্ব অনেক। তাই তাকে শুরুতেই ডিজিস সম্বন্ধে একটু বলে দেওয়া, পরিণতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে কী আশা করতে পারি আর কী আশা করব না তা বুঝে নেওয়া! তার নিজস্ব স্ট্রেস হচ্ছে কিনা হলে তার উপায় খুঁজে দেওয়া, কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া, সঠিক যথাযথ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা, বেশি বাড়াবাড়ি হলে প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া- এগুলো আমরা করতে পারি! একটু সময় পেলে স্টিগমা কাটিয়ে সামাজিক ভাবে যোগাযোগ গুলো বজায় রাখা! ক্রমাগত কাজ থেকে ব্রেক দেওয়া যাতে স্ট্রেস জাঁকিয়ে না বসে। যেকোনো সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এতে- একজন ডিমেনসিয়ার রোগীর সঠিক পরিচর্জার জন্যে একজন লোক কে সবসময় তেই থাকতে হয়! সেই কেয়ার গিভারের একটা বড় সময় এখানে কেটে যায়! তাই Care Giver Pension এখন চর্চিত একটা ইস্যু! যে আত্মীয় ছেলে বা মেয়ে নিজের বাবা বা মা কে দেখ-ভাল করার জন্যে নিজের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় দিয়ে দিলো স্টেট কে তার দায়িত্ব নিতে হবে! একে অবিলম্বে লাগু করা উচিত!অনেক সময় এনাদের খুব অপরাধবোধ হয়, নিজেদের দায়ী মনে হয়, তারা অনেক সময়ই নিজেদের বাবা মায়ের চিল্লিয়ে ওঠে, তাদের রোগের জন্যে! তাদেরকে বোঝানো যে তারা যা করছে তা খুবই যথাযথ ও ত্রুটিমুক্ত, এই বাবা-মায়ের খারাপ অবস্থার জন্যে তারা দায়ী নয়! অনেক সময় এনারা ডিপ্রেশান বা অবসাদ কিম্বা অ্যান্সাইটি বা দুশ্চিন্তা তে ভোগেন! তাই কেয়ার গিভারদের নিয়মিত অবসাদ ও দুশ্চিন্তার জন্যে পেশাদারদের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
আর শেষত জাতীয় ডিমেনসিয়া প্ল্যানের সঠিক মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন দরকার।
জাতীয় ডিমেনসিয়া প্ল্যানের ১০ টি দিক-
১) সচেতনতা ও শিক্ষা বাড়ানো
২) যত দ্রুত সম্ভব ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা শুরু করা
৩) প্রতিটি ঘরে উপযুক্ত পরিবেশ ও কাঠামো গড়ে তোলা
৪) প্রতিটি পরিবার ও তাদের লোকজনকে সাহায্য করা
৫) প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা আরও মজবুত করা- প্রতিটি জেলায় একটা সরকারি হাসপাতালে ডিমেনসিয়া রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে
৬) বাড়ি, পরিবার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য-কেন্দ্রের মধ্যে স্বচ্ছ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত
৭) ট্রেনিং এর যথাযথ ব্যবস্থা করা
৮) সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্টিং করা স্বচ্ছ ভাবে
৯) গবেষণার পথ খোলা রাখা!
১০) বাড়িতে বাড়িতে নতুন নতুন আবিষ্কারের ও টেকনলিজির সাহায্য নেওয়া! যেমন টেলিমিডিসিন!
শেষে এটাই বলার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে আমাদের আলাদারকম গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া কোনও স্বাস্থ্যই সম্পূর্ণ নয়! তাই অ্যালজেইমার ডিমেনসিয়ার রোগীকে বাড়িতেই উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য-কর্মী, বাড়ির লোক, কেয়ার গিভার, স্টেট সবার কাছেই যথাযথ সহযোগিতা এবং ট্রেনিং এই সময়ের দাবি!
খুব সুন্দর লেখা।তবে পোষা জন্তু(বিশেষতঃ কুকুর)রেখে কি কোনও লাভ হতে পারে?
কেননা সবাই কেয়ার গিভার হতে পারবেন না, সময়ও পাবেন না।