শিক্ষক দিবসে আমার অন্যতম প্রিয় জনস্বাস্থ্য শিক্ষক কিছু না বলে কয়েই চলে গেলেন।
প্রথম পরিচয়ের ক্ষণটা এখনো জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে।
অধ্যাপক অশোকেন্দু সেনগুপ্ত নিয়ে গেছিলেন জাস্টিস শৈলেন তালুকদারের বাড়ি। সেখানেই এসেছিলেন তিনি। তালুকদার পরিবারের পারিবারিক বন্ধু এবং গৃহকর্ত্রী তথা বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী সুতপা তালুকদারের চিকিৎসকও।
পরিচয়ের গোড়াতেই একটা সিগারেট বাড়ালেন আমার দিকে, “চলে তো?”
কৃতজ্ঞমুখে নিয়ে ওঁর সামনেই জামার বুকপকেটে রেখে ছিলাম সিগারেটটা।
জিজ্ঞেস করলেন, “খাবেন না?”
বললাম, “খাবো, কিন্তু এটা নয়। এই প্রথম কোনো অঙ্কোলজিস্ট আমাকে সিগারেট অফার করলেন। আপনার নাম আর সাল তারিখ লিখে এটা গ্লাস কেসে রেখে দেব ফর পাবলিক এডুকেশন।”
হেসে দ্বিতীয় সিগারেটটি বাড়িয়েছিলেন তিনি, সানন্দে এবং সোৎসাহে ধরিয়েছিলাম।
নানা কারণেই ডাঃ স্থবির দাশগুপ্তের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম।
ডাক্তারী পেশাটি নিয়ে আমার একটা নিজস্ব ক্ল্যাসিফিকেশন আছে, ‘বড় ডাক্তার’ আর ‘ভাল ডাক্তার’।
বড় ডাক্তার মানে যাঁদের বিশাল নাম ডাক, অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে বহুদিন হত্যে দিতে হয়। আমি এঁদের প্রায় কাউকেই চিনি না। আজ অবধি দেখিয়েছে বলে মনে পড়ে না। সরকারি চাকরি করার সময়ে হয়তো পদাধিকারবলে দু একবার কথা বলেছি। ওই পর্যন্ত।
ভাল ডাক্তার তিনি যিনি মিথ্যা ভয় দেখান না, মিথ্যা আশাও দেন না, চেষ্টা করেন কেউ অসুস্থ হলে তাঁর পরিবারটি যেন ধনে মারা না যায়।
একাধিকবার আমার নিজের আত্মীয় স্বজনদের ক্ষেত্র দেখেছি, ডাঃ স্থবির দাশগুপ্ত, চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন ভালদের চেয়েও ভাল।
কিন্তু সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। আমার সমকালে স্থবিরদার মতো স্বাদু ঋজু বাংলা গদ্য লেখক খুব বেশী পাই নি। খুব উঁচু মানের ছড়াও লিখতেন।
তিনি ছিলেন ‘মিথ -বাস্টার এক্সট্রাঅর্ডিনারী’। চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক সব বইতে নানা তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক’ মিথ ভেঙে চলেছিলেন নিরন্তর। ক্যান্সার নিয়ে তাঁর দু খণ্ডের বই দুটি বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যের অল টাইম ক্ল্যাসিক রূপে গণ্য হওয়া উচিত।
স্থবিরদার সঙ্গে আমার গল্পগাছার বেশীর ভাগটাই হতো হোয়াটসঅ্যাপে, লিখে লিখে।
কাল দুঃসংবাদটা পাওয়ার পর থেকে স্ক্রোল ব্যাক করে দেখছিলাম সে সব কথোপকথন গুলো। ভাগ্যিস ফোনে স্পেস বাঁচাতে ফেলি নি সেগুলো।
মেসেজগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ল সন্তোষদার মৃত্যুর খবরটা আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন স্থবিরদা।
কয়েক বছর আগে ওঁর একটা বইয়ের রিভিউ করেছিলাম আনন্দবাজারে।https://www.anandabazar.com/editorial/why-public-health-service-is-out-of-reach-of-common-people-1.1167983
পড়ে খুশীই হয়েছিলেন মনে হচ্ছিল।
যা কিছু লিখতেন স্থবিরদা সবেরই ভাগ দিতেন অকৃপণ করে, মায় প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচ্ছদ অবধি। পাঠক হিসেবে এই গুরুত্ব পেতে ভাল লাগতো বই কি।
এ বছর সরস্বতীপুজোর দিন আপন খেয়ালে লেখা একটা পোস্টের এক জায়গায় লিখেছিলাম,
“একখান শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের ‘সরস্বতী পূজা পদ্ধতি” কিনে পুরুত মশাইদের পেছনে বসে বোঝার চেষ্টা করেছি কী কী বাদ দিয়ে তাঁরা আড়াই ঘন্টার প্রক্রিয়াটা নামিয়ে আনেন পনেরো মিনিটে।
– কী দেখলেন। কী কী বাদ দেন?
– টুকরা টুকরা এলিমেন্ট অনেকেই অনেক কিছু বাদ দেন, তবে সবে চেয়ে কমন যে পর্বটা বাদ দেন সবাই, সেটা হলো ‘অধিবাস’। পুজোর সবচেয়ে মেটেরিয়ালিস্ট পর্ব।
– ‘মেটিরিয়ালিস্ট’ কেন?
– অধিবাস শুরু হয় “মাটি” র উপাসনা দিয়ে। তারপর গন্ধ, শিলা, ধান, দূর্বা, ফুল, ফল, কাজল, সর্ষে, সোনা, রুপো, তামা, আয়না, প্রদীপ, চামর….. একটিও কাল্পনিক চরিত্র আসে না এই পর্বের মন্ত্রগুলোয়। আর মাটি, জল, গন্ধের কথা যে কতো সুন্দর ভাবে বলা যায়, তার উজ্জ্বল প্রমাণ অধিবাসের মন্ত্রগুলো। অনেকটা বিনয় মজুমদারের কবিতার মতো, গভীর এবং সহজ। মনে হয় প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদী দিকটা সাবভার্শন করে ঢুকে পড়েছে আমাদের নানা ধর্মীয় আচারে।
– কেন বাদ দেয় বলুনতো?
– আমার মনে হয়একটা কারণ এই যে আলাদা করে কোনো দেবদেবীর উল্লেখ নেই এই পর্বে। শুধু কয়েকবার সরস্বতীর নাম উচ্চারণ করে তাঁকে বলা হয় গেট কনেক্টেড উইদ দিজ অবজেক্টস। অতএব এগুলো যজমানকে ইম্প্রেস করে না তেমন।
আর একটা কারণ হতে পারে, মার্ক্স যাকে বলেন, ‘এলিয়েনেশন’। আমাদের কলোনির স্কুলের পুজোর মাটি, ফুল,দুর্বা সব কিছুর সঙ্গে আমাদের পরিশ্রম মিশে থাকতো।
হেডমাস্টারসাই যখন আমাদের যোগাড় করা পুজোর জিনিষপত্তরএকটা একটা করে ছুঁয়ে বলতেন, ওঁ অনয়া মহ্যা অস্যা শ্রী সরস্বতী দেব্যা শুভাধিবাসিন মস্তু”, কিম্বা ” অনয়া দুর্বয়া অস্যা শ্রী সরস্বতী দেব্যা শুভাধিবাসন মস্তু” তখন আমাদের মনে হতো ঠাকুর কে বলা হচ্ছে এত্তো খেটেছে ছেলেপুলেরা সেটা স্বীকার করো। ।
শহুরে পুজোর সরঞ্জাম সব কেনা। যাঁদের শ্রমের বদলে পাওয়া গেছে এসব, তাঁরা কেউ নেই এ তল্লাটে……তাই এই শহুরে ঠাকুর আমাদের শ্রমের সঙ্গে কনেক্টেড নন। আর কনেক্টেড যখন নন, তখন তিনি হ্যাপেন্স টু বি জাস্ট অ্যানাদার এক্সকিউজ ফর হুল্লোড়।
দ্বিতীয় বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে পড়লেন, “অদ্ভুত লোক মশাই আপনি; মার্ক্স সরস্বতী সব কিছু বিশ্বাস করেন দেখছি!”
প্রথম বৃদ্ধ কেমন যেন রেডি ছিলেন, চটলেন না তেমন, বললেন, “মার্কসবাদ ঠিক বিশ্বাস অবিশ্বাসের বিষয় নয়, সমাজ সংসারকে বোঝার টুল, আর ঠাকুর দেবতারাও মানু্ষের আদলে গড়া। একটা ছাড়া কি আরেকটাকে বোঝা যায়?”
এটা পড়ে মেসেজ করেছিলেন স্থবিরদা।
“সরস্বতী পুজো আর দুই বৃদ্ধের কথোপকথন নিয়ে আজ যা লিখলে, আমি আমার ঝুলিতে রেখে দিলাম। টোকাটুকি করেই তো জীবন কাটলো, কবে কোথায় ঝোলা থেকে বার করে আনবো, দেখো!”
কাল রাতে ঘুম আসবে না জানতাম।
অনেক রাত অবধি স্থবিরদার সঙ্গে আমার হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন স্ক্রোল করে দেখছিলাম। এই ফোনে ধরা আছে ২০১৮ সাল থেকে।
সবচেয়ে বেশী কথা হয়েছিল প্যাণ্ডেমিকের সময়। আমি সদাই সন্দিগ্ধ এক প্রাণ, কোনো নির্দিষ্ট স্ট্যাণ্ড নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে তাই।
স্থবিরদা বকাবকি করলে বলতাম, “এমনিতেই আমার কিছু হওয়ার নয়, দাদা। গীতা বলেছেন, ‘সংশয়াত্মা বিনশ্যতি’, আমায় বাঁচায় কার সাধ্যি?”
শেষ রাতে একটু তন্দ্রা এলো, স্থবিরদাও এলেন তখন।
সেটা অন্য গল্প।