পারস্পরিক দোষারোপ নয়,ডেঙ্গি প্রতিরোধে প্রশাসন,চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী
,সাধারণ মানুষ..সবার একসাথে লড়াই করা দরকার, বললেন ডাঃ সৌম্যকান্তি পন্ডা।
১.
ডেঙ্গি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। এডিস মশকীর কামড়ে এই রোগ ছড়ায়। ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি সাব-টাইপ আছে।
২.
বর্ষার পরে পরিষ্কার জমা জলে (বাতিল টব,ড্রাম,বালতি,নর্দমা,ছেঁড়া জুতো ইত্যাদি যেখানে জল জমতে পারে) এডিস মশকী ডিম পাড়ে। তাই বর্ষার পরে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর অব্দি ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব বেশি। ১৬°-৩০° সেলসিয়াস তাপমাত্রা ডেঙ্গি ভাইরাসের জন্য আদর্শ। তাই খুব গরমে বা খুব ঠান্ডার মরশুমে ডেঙ্গি দেখা যায় না।
৩.
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাইরাল জ্বরের মত লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত দু-তিনদিনের মধ্যে জ্বর কেটে যায়। উচ্চ তাপমাত্রা,গা-ম্যাজম্যাজের সঙ্গে চোখের পেছনে, হাড়ে, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, হামের মত গোটা গায়ে র্যাশ থাকতে পারে।
৪.
আশঙ্কাজনক ডেঙ্গিতে বারবার বমি, পেটে ব্যথা, পেটে-বুকে জল জমা, লিভার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অণুচক্রিকা কমে গিয়ে চামড়া,মু খের ভেতরে বা অন্য মিউকাস পর্দা কিংবা শরীরের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। অণুচক্রিকা কমে যাওয়ার সাথে রক্ততঞ্চন তন্ত্রের গন্ডগোল, অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। লিভার,হৃৎযন্ত্র কিংবা মস্তিষ্কের প্রদাহও দেখা দিতে পারে।
৫.
আলাদাভাবে এই পয়েন্টটা লক্ষ্য করুন। প্রচলিত মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম যতই ‘প্লেটলেট-প্লেটলেট’ বলে আপনাকে বিচলিত করতে শুরু করে আপনারাও ততই নিলাম হাঁকার মত ‘আমার পিসতুতো দাদার প্লেটলেট ৬৭০০০ হয়ে গেছিলো’, ‘বাপনের ছোট শালার ৫৭০০০’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে দেন। যতই হোক,চিকিৎসকের মিনমিনে গলার চেয়ে মিডিয়ার গলার জোর বেশি। আর ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’। যাক গে, সত্যি কথাটা হ’ল রক্তক্ষরণ না হ’লে প্লেটলেট ১০০০০ অব্দি নামলেও ক্ষতি নেই। আর রক্তক্ষরণ শুরু হলে কোনও প্লেটলেট কাউন্টই নিরাপদ নয়। বরং আশঙ্কাজনক ডেঙ্গিতে অধিকাংশ সময় ক্ষতি হয় রক্তবাহ থেকে জল বেরিয়ে যাওয়ার ফলে। এইভাবে রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হয়ে ও রক্তচাপ কমে গিয়ে যে মারণ-অবস্থা তৈরি হয় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় শক বা অভিঘাত বলে। অদ্ভুত ব্যাপার হ’ল ডেঙ্গির যাবতীয় কমপ্লিকেশন সাধারণত জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরেই শুরু হয়। অতএব শুধু প্লেটলেট নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা এবার বন্ধ করুন। অনেক সময় এমনও দেখা যায় আপনার অত্যধিক দুশ্চিন্তা পরোক্ষে চিকিৎসককে অপ্রয়োজনীয় প্লেটলেট ট্রান্সফিউশনে বাধ্য করে।
ডেঙ্গি জ্বর সনাক্ত করার জন্য জ্বরের প্রথম ৪-৫ দিনের মধ্যে NS1 এবং ৫ দিনের পরে IgM (MAC ELISA) টেস্ট করা হয়। রোগনির্ণয়ে IgG পরীক্ষার গুরুত্ব তুলনায় কম। এরদ্বারা মূলত পূর্ববর্তী ডেঙ্গি সংক্রমণের আভাস পাওয়া যায়।
৬.
ডেঙ্গি ভাইরাস মারার কোনও ওষুধ হয়না। বাজারে পেঁপে পাতা থেকে শুরু করে হাবিজাবি অন্যান্য যা কিছু দিয়ে ডেঙ্গির চিকিৎসা করার কথা বলা হয় সেসবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জ্বরের জন্য শুধুই প্যারাসিটামল, সঙ্গে পর্যাপ্ত জল খেলেই অধিকাংশ ডেঙ্গি থেকে সেরে ওঠা যায়। আশঙ্কাজনক ডেঙ্গিতে হাসপাতালে ভর্তি করে শিরার মধ্যে স্যালাইন ও অন্যান্য চিকিৎসার প্রয়োজন।
৭.
ডেঙ্গির কোনও একটি সাব-টাইপ দ্বারা একবার আক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে সারাজীবনের জন্য অনাক্রম্যতা গড়ে ওঠে কিন্তু দ্বিতীয়বার অন্য কোনও সাব-টাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে সেই ডেঙ্গি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
৮.
ভারতে এখনও ডেঙ্গির কোনও ভ্যাক্সিন নেই। একটি ভ্যাক্সিন শেষ পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে আছে। সেটি বাজারে এলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ডেঙ্গির ভয় অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যাবে।
৯.
বাড়ির চারদিক পরিষ্কার রাখা, জল জমতে না দেওয়া, মশা নিধনকারী স্প্রে ও অন্যান্য রাসায়নিক, রেপেল্যান্ট জেল ব্যবহার, নর্দমায় নিয়মিত রাসায়নিক প্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে ডেঙ্গির ভয়াবহতা প্রতিরোধ করা যায়।
১০.
সরকারও যেমন ডেঙ্গি নিয়ে নিজেদের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করতে পারেন না তেমনি ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের সবারই ডেঙ্গি প্রতিরোধে একটি দায়িত্ব আছে। ডেঙ্গির প্রকৃত সংখ্যা কিংবা ডেঙ্গিমৃত্যু লুকিয়ে রাখা সমস্যার সমাধান নয়। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে,একজন ডাক্তার রোগের কারণ ডেঙ্গি লিখতে ভয় পান কারণ যে কোনও সময় ঘাড়ের ওপর প্রশাসনিক খাঁড়া নেমে আসতে পারে। তাই ডায়াগনোসিসের জায়গায় লিখতে হয় ‘অণুচক্রিকা হ্রাস সহ অজানা জ্বর’। পারস্পরিক দোষারোপ নয়, ডেঙ্গি প্রতিরোধে প্রশাসন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী,সাধারণ মানুষ.. সবার একসাথে লড়াই করা দরকার।
Very informative post. Thanks for making us enriched.
Khub dorkari lekha… Emon aro onek kichu janar opekkhay roilam…
খুব ভাল লাগল। উদ্যোগ মহৎ ।