পশ্চিমবাংলার সরকার তথা রাষ্ট্রের তরফ থেকে আবার নতুন তেজে পুঁজিবাদী আগ্রাসন শুরু হয়েছে বীরভূমের দেউচা-পাচামি অঞ্চলে। ‘বিশ্ববাংলা গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০২৫’ মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, “জমি অধিগ্রহণ থেকে আদিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সবকিছুই তৈরি। আগামী কাল (বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি) থেকেই দেউচা-পাচামিতে কয়লাখনির কাজ শুরু হবে।” তার পরেই রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের দাপট বেড়েছে।
এই প্রকল্পের শিকার প্রধানত আদিবাসী সমাজ। এখানে বসবাসকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিপীড়িত মানুষরাই এই রাষ্ট্রীয় হামলার মুখে পড়ছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, কয়লা খনি তৈরির নামে উদ্ভট মিথ্যাচারের কারবার চলছে এখানে। দেড়শো-দুশো বছরের পুরানো গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে “আগামী একশো বছর বিদ্যুৎশক্তির আর কোনো ঘাটতি থাকবে না!” তবে আগামীদিনে যখন চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়ে যাবে – এসব নেহাতই চরম মিথ্যা প্রচারের কারবার ছিলো, – ততদিনে সমাজের ও প্রকৃতির যা সর্বনাশ হবার হয়ে যাবে! পুঁজির সঙ্কটে জেরবার কোনও কর্পোরেট গোষ্ঠীর মালিকানাতেই হয়তো চলে যাবে সব জমি! বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ‘জমি দখল’ সর্বত্রই পুঁজিপতিদের অন্যতম লুঠের কারবার। ‘কয়লা’, ‘কর্মসংস্থান’, ‘বিদ্যুৎশক্তি’ ইত্যাদি বিভিন্ন বাহানার পিছনে ‘জমি’-ই হয়তো আসল পণ্য এখানে। দুবছর আগেই আন্দোলনে শ্লোগান উঠেছিলো, “দেউচা-পাচামি কয়লা খনি রুখে দাও: জল-জঙ্গল-জমি থেকে কর্পোরেট লুঠ হঠাও।”
খনি, ড্যাম, জলাধার, পার্ক, কারখানা, নগর ইত্যাদি নানা কিছু ‘উন্নয়ন’-এর জন্য পশ্চিমবাংলা তথা ভারতবর্ষ জুড়ে কতো লক্ষ / কোটি আদিবাসী এবং অন্যান্য মানুষ তাঁদের বাসভূমি থেকে বারবার ছিন্নমূল হয়েছেন, তার সঠিক কোনও হিসেব নেই রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে! কতো লক্ষ পরিবার দু’বার, তিনবার, এমনকি চারবারও উচ্ছেদ হয়েছেন তাঁদের বাসস্থান থেকে, তার সঠিক হদিসও অজানা! এঁরা ‘উন্নয়ন’-এর বলি। পাশাপাশি, আদিবাসী সমাজের গর্ব তাঁদের শত-সহস্র বছরের প্রথাগত ও নিজস্ব মানবহিতৈষী পরম্পরা। এঁদের আচার-অনুষ্ঠানে আজও মন্ত্রোচ্চারিত হয় সমগ্র মানবসমাজের সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের জন্য। স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিয়ে, বৃহত্তর মানবকল্যাণের লক্ষ্যে চলাই এঁদের অন্যতম সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কয়লা ব্লক নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে এখানে। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় দু’শো দশ কোটি কুড়ি লক্ষ টন কয়লা মজুত রয়েছে মহম্মদবাজার এলাকার দেউচা-পাচামি অঞ্চলের ভূগর্ভে। বারো হাজার কোটি টাকা খরচের কেন্দ্রীয় বরাদ্দও নাকি হয়ে গেছে এখানকার প্রস্তাবিত খনির জন্য।
মহম্মদবাজার অঞ্চলে চুনাপাথর ও পাথর খাদানের যে লাভজনক কারবার চলে, তা-ও প্রধানত আদিবাসীদের (সাঁওতাল, লোহার, অসুর, কোরা ইত্যাদিদের) নিবিড় শ্রম-নির্ভর। রাজনৈতিক দলের কেষ্টবিষ্টুদেরও কেউকেউ সরাসরি মালিক হিসাবে যুক্ত রয়েছে এইসব ব্যবসায়।
এই এলাকার যে তিনহাজার একর জুড়ে রয়েছে কয়লার ভান্ডার, তার মধ্যে একহাজার একর জমির মালিক খোদ সরকার; বাকি দু’হাজার একর সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হবে। অঞ্চলে হাজার হাজার তফসিলি আদিবাসী এবং তফসিলি জাতের মানুষ বাস করেন।
ভারতবর্ষীয় সরকারি নিয়মকানুনের দৌলতে, এঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা হয়তো ‘তফসিলি জাত’ হিসাবে নথিভুক্ত (যেমন লোহার), তাঁরাই আবার বিহারে ও ঝাড়খন্ডে ‘তফসিলি আদিবাসী’! এঁদের কীভাবে এবং কীসের লোভ দেখিয়ে উচ্ছেদ করা যাবে, তাই এখন সরকারি মাতব্বরদের মাথাব্যথার বিষয়। আর বংশপরম্পরায়ের বাসভূমি থেকে উৎপাটিত হবার মুখে আদিবাসী সমাজের দুশ্চিন্তা, তাঁদের প্রথাগত, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের কী হবে! তাঁরা কীভাবে জীবনযাপন করবেন, তা ঠিক করার পূরো অধিকার ন্যায়সঙ্গতভাবে তাঁদেরই আছে। আগ্রাসী রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বৈরাচারী মোড়লি এব্যাপারে নৈতিকভাবে একেবারেই অচল।
দেউচা-পাচামিতে ‘উন্নয়ন’-এর মিথ্যা প্রচার অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছে। ভয় দেখানোও চলছে প্রথম থেকেই। এই দুইয়ে আশানুরূপ ফল না মেলায়, শুরু হয়েছে লাঠির দাওয়াই। নিরস্ত্র নারীদের উপর পুলিশ বাহিনী যথেচ্ছ লাঠিপেটা ক’রে ইতিমধ্যেই তাদের নির্লজ্জ ‘বীরত্ব’ প্রদর্শন করেছে তিন বছর আগেই। গঠিত হয়েছিলো ‘বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’। তখন ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ দৈনিক কাগজে খবর বেরিয়েছিল, ধরনার জায়গা থেকে আদিবাসীরা দাবি তুলেছিলেন – “মমতা এসে কথা বলুন।” কিন্তু মোড়লির রাজনীতিতে অভ্যস্ত নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই তাতে সাড়া দেয়নি।
সবচেয়ে মজার বিষয় হ’লো, কেন্দ্রীয় সরকার দেউচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিঙ্ঘা কয়লা ব্লকের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও কখনোই তা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। চৌদ্দ বছর আগেই (মার্চ ২০১১) কয়লা মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, কোল ইন্ডিয়া এ’ব্যাপারে মাথা গলাবে না। ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু সরকারকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই খনি লাভজনক হবেনা ব’লে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু সরকারও রাজি হয়নি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারই তখন, ১৯১৮ সালে, তথাকথিত “পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন”-এর স্বার্থে রাজি হয় এই কয়লা খনি তৈরির দায়িত্ব নিতে। মনে হয়, ‘এগিয়ে বাংলা’ প্রমাণের তাগিদে!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, মাটির নিচে এতো কালো সোনা থাকলেও, কেউই কেনো আগ্রহ দেখালো না? আসলে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে বসলে দেখা যাচ্ছে ‘লাভ’ কিছুই নেই, সবটাই ‘ক্ষতি’। বিভিন্ন ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশবিদদের মতামতও তা-ই। তাঁদের মতে, নানা কারণে এখানে ‘কয়লা তোলা’র ভাবনা একেবারেই বাস্তবসম্মত না।
সরকারি পক্ষ থেকে “এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান” নিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। এ-ও কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবি মিথ্যাচারের ফানুস। এই বিশাল ও গভীর খোলামুখ কয়লা খনি যদি আদৌ কোনোদিন চালু হয়-ও, তবে তা অত্যাধুনিক যন্ত্রনির্ভর হ’তে বাধ্য। মোট ‘মানুষ’ আদৌ কতজন লাগবে, সেটাই প্রশ্ন। এই বিষয়গুলো সরকারি মাতব্বরগণ ১০০% বোঝেন। মনে হয়, বিধানসভা নির্বাচন (২০২৬) আপাতত মিথ্যা প্রচারের একটা বড়ো বালাই!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী যেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কয়লা খনির কাজ শুরু হবে, তখনই দেউচার চান্দা গ্রামের মহিলারা সেই ঘোষণার প্রতিবাদ করেছিলেন। দেউচার চারটি গ্রামের প্রধাণত মহিলা আদিবাসীরা মাটিতে ‘চরকা’ পুঁতে খনির কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এক তরুণী সুরমা টুডু বলেছিলেন, “কোনও চাপের কারণেই আমরা জমি দেবো না। খোলামুখ খনি তৈরির জন্য সমস্ত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, প্রচুর গাছ কাটা চলছে। এরপর সরকার আমাদের জমি নিয়ে নেবে।” তবে পুরুষ আদিবাসীদের মধ্যে কিছুকিছু দোদুল্যমানতা দেখা গেলেও, মহিলারা যেমন দৃঢ়চেতা তেমনি ঐক্যবদ্ধ। পুলিশী অত্যাচারের পরেও মহিলারা বারবার সভা করছেন, মিছিল করছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, “কয়লা খনি নিয়ে যারাই দালালি করতে আসবে, তাদের আলাদা ব্যবস্থা হবে।” তীর-ধনুক, টাঙ্গি, কাস্তে, ডান্ডা, ঝাঁটা হাতে মহিলারা সংঘবদ্ধভাবে আজও প্রতিরোধের সামনের সারিতে রয়েছেন। দেউচা-পাচামি থেকে একদল মহিলা আদিবাসী এবং তিনজন পুরুষ আদিবাসী, আর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও ঝাড়খণ্ড থেকে আসা আদিবাসী প্রতিনিধিরা যখন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সহযোগীদের সহায়তায় সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন কলকাতায়, রাষ্ট্র-সেবী সংবাদমাধ্যমগুলো সে সংবাদ চেপে গেছে। বাঁকুড়া থেকে আসার পথে, সম্মেলনের অন্যতম সংগঠক লক্ষ্মীকান্ত হাঁসদাকে পুলিশ সারাদিন হরিপাল থানায় আটকে রাখে।
সাংবাদিক সম্মেলনে মুখিয়া আদিবাসী নেতানেত্রীরা বলিষ্ঠভাবে বলেন: প্রায় পঞ্চাশটা গ্রামের হাজার পঁয়ত্রিশ মানুষ এখান থেকে উচ্ছেদ হবেন; মুখ্যমন্ত্রীর ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ হতে পারে এটা, কিন্তু আদিবাসীদের কাছে ‘সর্বনাশের প্রকল্প’; আদিবাসী উচ্ছেদ করে আজও পর্যন্ত কোনও প্রকল্পেই আদিবাসীদের ‘উন্নয়ন’ হয়নি, তাঁদের সর্বনাশই হয়েছে।
ভারতীয় সংবিধানে ও আইনে, বনাঞ্চল ও আদিবাসী সমাজ সম্পর্কে যেটুকু সুরক্ষার বিধি আছে, দেউচা-পাচামিতে ধারাবাহিকভাবে সরকার তা লঙ্ঘন করে চলেছে। ১) বনবাসীদের অজান্তে, বনাঞ্চলের চরিত্র বদলিয়ে ‘খাসজমি’ করে নেওয়া হয়েছে। ২) আদিবাসীদের মতামতকে উপেক্ষা করে, তাঁদের বাসভূমি সম্পর্কে যা-খুশি তাই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে! আইনের তিলমাত্র শাসন এখানে নেই; প্রশাসনিক মাতব্বরদের মর্জিমাফিক ‘আইন’ চালানো হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ উচ্ছেদ হবে। মাঝরাত্তিরে, ব্রাহ্মণ ডেকে লুকিয়ে ভূমিপূজাও করা হয়েছে, আদিবাসীদের বাসভূমির জমি অধিগ্রহণের জন্য! এসব সরকারি স্বৈরাচারের খবর যাতে চট করে বাইরের মানুষ জানতে না পারে, তাই ইন্টারনেট-ও বন্ধ রাখা হয়েছে।
আদিবাসী সংস্কৃতিতে বাধা দেবার প্রথা অনুযায়ী মহিলারা ‘চরকা’ পুঁতেছেন রাস্তায়। উদ্ধত পুলিশ কর্তার চোখে চোখ রেখে তাঁরা বলেছেন, “বাড়াবাড়ি করলে সিউড়ি পর্যন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবো।” ‘চরকা’ এখনও পোঁতা রয়েছে, সরানোর হিম্মৎ দেখায়নি পুলিশ বা গুণ্ডার দল। কারণ আদিবাসী (সাঁওতাল) ঐক্য ও বিদ্রোহের ইতিহাস তাঁদের জানা। শেষপর্যন্ত কী হবে, তা পরে বোঝা যাবে। তবে সরকারের তরফ থেকে লোভ ও হুমকি দেখানো সমানতালে চলছে। তৃণমূল কংগ্রেসের আঞ্চলিক নেতৃত্ব সরকারি অফিসে ডেকে পাঠিয়ে সভা করেছেন পুরুষ আদিবাসীদের একাংশের সঙ্গে; পুলিশের একাধিক বড়কর্তাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আদিবাসী ঐক্যে ভাঙন ধরানোর তীব্র চেষ্টা চলছে।
ঘটনাবলী আগামীর জন্য খুব ‘অহিংস’ ও সুস্থ ‘গণতান্ত্রিক’ পথের ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এইমুহুর্তে এটুকু অন্তত বলাই যায়।।
‘শ্রমজীবী ভাষা’, ১ এপ্রিল ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত।











