না, বড় কিছু নয়। মহাকালের কাছেতো কিছুই নয়, মহা জীবনের কাছেও সে শিশিরবিন্দুর মত অতি ক্ষুদ্র। অথচ এই বিন্দু বিন্দু শিশির মিলেই তৈরি হয় জলের বিন্দু- আর জলই জীবন। সেই জলজ জীবনে প্রতিদিন কত ঘটনাই যে ঘটছে, একবার চোখ খুলে একটু দেখলেই দৃষ্টির বাইরে আর এক জগৎ দেখা যায়। শিশির বিন্দুর জগৎ। সেই অজানা অদেখা জগৎ মাঝে মধ্যে এমন ঢেউ তোলে, একেবারে নাড়িয়ে দেয় সবকিছু। যদিও মানুষের সব অনুভুতিই ক্ষণস্থায়ী- কিছুদিন পরে ঢেউ মিলিয়ে যায়, মানুষ তার নিজের বৃত্তে ফিরে আসে। আবার সব কিছু চলে স্বাভাবিক ভাবে। স্বাভাবিক বলা কি ঠিক হল? কোনটা স্বাভাবিক? বরং বোধ হয় বলা ভাল, গতানুগতিকতায়।
মানুষ বোধহয় সৃষ্টির সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় প্রাণী। আর আমরা এমন একটি পেশায় আছি, যেখানে এদের নিয়েই আমাদের কারবার। মানুষ না হলে আমাদের চলে না, আমাদের না হলে মানুষের চলে না। তবে আমি কি মানুষের থেকে আলাদা কিছু? না, ‘আমি’ বলতে আমাদের এই চিকিৎসক সম্প্রদায়ের কথা বলছি। চব্বিশ ঘন্টাই মানুষের সঙ্গ, সুখ, দুঃখের গল্প শুনে আমাদের জীবন কাটে। মাঝে মাঝে তাই অনেকের গালাগালি খেয়েও মনে হয় আমি ভাগ্যবান, কারণ এই পেশা বা এই লাইনে আসতে পেরেছি তাই মানুষের মনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে পারি অনায়াসেই। আর সেখানেই মণি-মুক্তো-মদের বিরাট ভান্ডার। হ্যা, মদ। সেই সমরেশ বসু বলেছিল, ‘মানুষ নামের মদে বড় তৃষ্ণা, খেয়ে গড়াগড়ি যাই, তবু খোঁয়ারি কাটে না’। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমারও সেই নেশা ধরে যায়, যত দেখি, তত অবাক হই, বিষ্মিত হই, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই, হেসে উঠি, কেঁদে উঠি। এত যে বৈচিত্র্য লুকিয়ে থাকে তাদের মনে, মননে, জীবনযাপনে! কিন্তু সেখানে উঁকি মারার সময় নেই। তবু মাঝে মাঝেই জীবন তার স্বরূপ নিয়ে হাজির হয়।
হাসপাতালের ইমারজেন্সি এক বিচিত্র জায়গা। এক্কেবারে ‘হট সিট’। ‘কোন বনেগা ক্রোড়পতি’র চেয়েও অনেক গুণে ‘হট’। একটা সময় ছিল, যখন শুধু রোগীর চিকিৎসা করলেই চলত, এখন চলে না। এখন মারমুখী পার্টি আর পাড়ার লোক আগে দেখে নিতে হয়, বেঁচে তো থাকতে হবে, তাই তাদের আগে সামলানো দরকার। তারপরে রোগী। তাই কাজটা শতগুণে কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এই সব কোনও ম্যানেজমেন্টের স্কুলের বইতেও লেখাও নেই যে কি করে উপস্থিত আগ্রাসী জনগণকে সামাল দিতে হবে, কারণ অবস্থা যে কোনও মুহূর্তে খারাপ হতে পারে। ‘হট’ থেকে একেবারে আগ্নেয়গিরির লাভা বেরিয়ে আসতে পারে। তাই সদা সতর্ক থেকে চলতে হয়- পান থেকে চুন খসল না তো! তবুও এর মধ্যে কখনও কখনও চোখ পড়ে যায়, অভিজ্ঞতা বলে দেয়, না এখানে অন্য কিছু আছে।
এমনই এক দিনের ঘটনা আজকে জানাব।
বসে আছি সেই ‘হট’ সিটে। হঠাৎ করেই একটি বছর পনেরোর রোগা ছেলে আরেকটি বছর আটেকের ছেলেকে পাঁজাকোলে করে এমারজেন্সিতে ঢুকে গেল। দু’জনেরই মলিন পোষাক, এক নজর তাকালেই বোঝা যায়, বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। যাকে কোলে করে নিয়ে এসেছে, তার হাত ভেঙ্গেছে পড়ে গিয়ে।
কি করে পড়ল? রেল লাইনের পশে খেলা করছিল, তাই সেখানে কোথাও পড়ে গিয়ে বাম হাতের কনুইতে বড় চোট পেয়েছে। ফুলে গেছে, যন্ত্রণায় কুঁকড়োচ্ছে। এক নজর দেখেই বোঝা যায়, ভেঙ্গেছে ওখানে।
যার হাতে লেগেছে, তার বয়স আট নয় হবে, তারও রোগা চেহারা। মাথার চুল উস্কো খুস্কো। পরনের পোষাকও পুরানো ও মলিন। কালো গায়ের রঙ। সারা মুখে যন্ত্রণা ও অবসন্নতার ছাপ। মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতেও যেন কষ্ট।
বড়ো ছেলেটিকে বললাম, ‘ওকে টুলে বসিয়ে দে’। তারপরে বললাম, ‘কি রে, কি করে তোর হাত ভাঙ্গলো?
কষ্ট করে ছেলেটি বলল, ‘পড়ে গিয়ে’।
‘কি করে পড়লি?’
‘পাথরে পায়ে হোঁচট খেয়ে’।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, শুকনো, ক্লান্ত মুখ। যন্ত্রণা তো আছে, তার সাথে অযত্নের চিহ্ন তার সর্বত্র। একবার তাকালেই বোঝা যায়।
কি মনে হ’ল, বললাম- ‘সকালে কি খেয়েছিস?’
‘কিছু খাইনি’
দেওয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিকেল চারটে। এতক্ষণ কিছু খায়নি? কেন? বললাম, ‘তোর মা কোথায়? আসেনি?’।
বড় ছেলেটি জবাব দিল- ‘ওর মা জেলে’।
ধাক্কা খেলাম। বললাম, ‘বাবা?’ ।
‘বাবা নেই। মারা গেছে’।
হঠাৎ একটা ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাবা নেই, মা জেলে- মানে বাড়ি নেই। অসহায় একটি ছেলে সারাদিন না খেয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোথায়, কি করছে, খেলো কি না খেলো- দেখার বা খোঁজ নেবার কেউ নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বড় ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে যা জানা গেল, তার মোদ্দা কথা, ওরা রেল বস্তিতে থাকে। বাবাকে কে বা কারা মেরে ফেলেছে। বাড়িতেই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ তাই ওর মাকে নিয়ে গিয়ে জেলে দিয়েছে। হতে পারে ঘটনার সাথে ওর মাও জড়িত আছে। তাই ও এখন পিতৃ-মাতৃহীন। থাকে মাসির কাছে। সেই মাসির ছেলে, মানে বড় ছেলেটি তাই তাকে নিয়ে এসেছে।
অনেক অনুভুতি ভোতা হয়ে গেছে ঠিকই, তবু মনটার ভিতর কেমন করে উঠল, ‘আহারে!’
আবারও ভাল করে তাকালাম ছেলেটির দিকে। রোগা, মলিন প্যান্ট আর অপরিস্কার জামা গায় তার। হাতে পায়ে ধুলো-বালি লেগে আছে। মুখে যন্ত্রণা ও ক্লান্তির ছাপ। ক্লান্তি ও অবসন্নতায় চোখ বুঁজে আসছে যেন!
কিন্তু আমি কি করব? এর জন্যে কতটা কি করতে পারি? ওকে বড়জোর ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে পারি। ভর্তি করে দিলেও দিলেও রাতের আগে তো কিছু খাবার পাবে না হাসপাতাল থেকে! এই চারটে পর্যন্ত ওর মুখে কোন খাবার পড়েনি। হয়তো জলও খায়নি। তাই ঠোঁট, জিভ শুকিয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। ওকে কিছু খাওয়ানো দরকার। মনে পড়ে গেল, আমার ব্যাগে তো একটি কেক আছে! রাত ন’টা পর্যন্ত ডিউটি, তাই বিকেলের টিফিনের জন্যে এনেছিলাম।
রেষ্ট রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে কেকটি বের করে ওদের দু’জনকে ডেকে নিয়ে একটু দূরে একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসালাম। কেকটা বড় জনের হাতে দিয়ে বললাম, আগে ওকে এটা খাইয়ে দে। তার পরে যা করার তা করব। ছেলেটি সে কেকও খাবে না। শুধু চোখ বুঁজে মাথা দুলিয়ে না, না করে যাচ্ছে। এতক্ষণে না খেয়ে বা না খেতে খেতে খিদের অনুভুতিটাই তার কমে গেছে হয়ত! আর জলও না খাওয়ায় মুখে লালা পর্যন্ত নেই। খাবে কি করে। এখন খাওয়াটাই ওর কাছে কষ্টের- তার চেয়ে সহজ ঝিম মেরে পড়ে থাকে।
জল এনে দিলাম। আগে কয়েক চুমুক জল খাওয়ালাম ধমকে। তারপর বড় ছেলেটিকে বললাম, একটু একটু করে কেক ওর মুখে দে। তাই দিল, এবার মুখে নিল । তাও না, না, খাব না করতে করতে। সিস্টারদের ভয় দেখিয়ে, ইঞ্জেকশানের ভয় দেখিয়ে, সিকিউরিটির ভয় দেখিয়ে এক দু’ টুকরো মুখে দেওয়াতেই ধীরে ধীরে পুরোটাই নিজে খেয়ে নিল। মনে হল কেকের কেক জন্ম আজ সার্থক হল।
কিছুক্ষণ পরে বছর চল্লিশের রুগ্ন, মলিন শাড়ি পরিহিত এক মহিলা এসে দাঁড়াল সামানে। ইনি ছেলেটির মাসি। জানালেন, তিনি অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করেন। তাঁরও স্বামী নেই, কয়েকমাস আগে স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। এই মাসিকেই এখন সংসার চালাতে হয়। দু’বেলা অন্য লোকের বাড়ি কাজ করে পাঁচটি প্রাণীর ভরন-পোষণের ব্যবস্থা করতে হয়। তার মধ্যে নিজের দুই ছেলে, বোনের দুই ছেলে, আর বৃদ্ধা অসুস্থ শাশুড়ী- এবং নিজে। কোন স্থায়ী কাজকর্ম নেই, লোকের বাড়িতে বাসন মাজা আর ঘর মোছাই কাজ। বাড়িতে নিয়মিত রান্না বা খাওয়ার কোন সময় বা পরিস্থিতি নেই। এক বাড়িতে কাজ করছিল, খবর পেয়ে চলে এসেছে। নিজেদের বাড়ি বা জমি নেই, বাসস্থান রেল লাইনের পাশের জবর-দখল কলোনি। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের এক পরিবার, এক প্রতিনিধি।
সব কিছু আমার কাছে ছবির মত স্পষ্ট হয়ে গেল। যেন আমি ওই ‘হট’ সিটে বসেই আর এক পথের পাঁচালি দেখছি। কিংবা তার থেকেও আরও করুণ কোন চিত্রনাট্যের চলচ্ছবি। ভাগ্যবিড়ম্বিত, দেশত্যাগী, সহায় সম্বলহীন এক পরিবার- তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কিন্তু এখানে বসে মন খারাপের বিলাসিতা করার সময় হয় না। ঢেউয়ের মত রোগী আসতে থাকে। একটার পর একটা। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওকে ভর্তি তো করব, কিন্তু এক্স-রে না হলে হাড়ের ডাক্তার কিছুই করতে পারবে না। এই সময়ে হাসপাতালের এক্স-রে বন্ধ হয়ে গেছে। হাড়ের ডাক্তার আজ আছে আবার তিনদিন পরে তাকে পাওয়া যাবে। যা করার আজই করা দরকার। বাইরে থেকে এক্স-রে করাতে হবে। কিন্ত টাকা?
মহিলাকে বললাম, টাকা আছে?
তিনি নীরব। কিছুক্ষণ পরে আমতা আমতা করে বললেন- কিছু আছে, আরও জোগাড় করতে হবে।
বুঝলাম, আসলে নেই। আমার সাথে ডিউটিতে আছে ডাঃ অচিন্ত্য। আমরা দু’জনে কিছু টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করলাম। এক্সরে -তে দেখা গেল কনুইয়ের হাড় টুকরো হয়ে গেছে। ভর্তি করে দিলাম হাড়ের ডিপার্টমেন্টে। হাড়ের ডাক্তারকেও বলে দেওয়া হল, যতোটা সম্ভব করে দিতে।
না, আমার আর খিদে পায়নি। ডিউটি শেষ করে কিছুটা প্রশান্তি, অনেকখানি দুশ্চিন্তা এবং আরো অনেক রাগ নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। প্রশান্তি ওই অভুক্ত ছেলেটার মুখে এক টুকরো খাবার তুলে দিতে পেরে, দুশ্চিন্তা ওদের ভবিষ্যত ভেবে। আর রাগ? আমাদের পুর্বপুরুষেরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিল, যে স্বাধীনতা অনাথ করে, উদ্বাস্তু করে, ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে দেশ ছাড়া করে! জীবনকে অনিশ্চিত, অস্তিত্বহীন করে দেয়!
—-?—-
২/১১/২১