এই যে লিঙ্গ শিথিলতার সমস্যার কথা বললাম এতে আক্রান্ত রুগির সংখ্যা তাও কম। যে রোগে গঙ্গা-যমুনা ভেসে গেছে তা হল ধাতুরোগ। সব বয়সের সব ধরনের মানুষ এই রোগের শিকার। বহুযুগের এ এক কল্পিত ধারণা যে হিসি বা পটি করার সময় তাদের পেচ্ছাপের সাথে সাদা বীর্য বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ভুল পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। এর ফলে ঘুম খিদে কমে আসা, ওজন কমে যাওয়া, হীনমন্যতা, মানসিক অবসাদ কত কী যে হয় তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কাঞ্চনমার্কা চেহারার ছেলে থেকে শুরু করে হাত-কাটা-দিলীপমার্কা মস্তান কেউই এই লিস্ট থেকে বাদ যায় না। মনোবিদরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত প্রচলিত এই অসুখের নামও দিয়েছেন ‘ধাত সিন্ড্রোম’।
অল্প বয়েসি অবিবাহিত ছেলে হলেও না হয় ঠিক ছিল। বিবাহিত দুই ছেলের বাবা, কর্পোরেট স্যারেরও এই একই সমস্যা। আসলে বীর্যপাতের সাথে জড়িয়ে যাওয়া ট্যাবু, মিথ, কল্পনা ও অপপ্রচার এমন জড়িয়ে গেছে যে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়।
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রই বলুন কি গ্রিক পান্ডিত্য সব জায়গাতেই বীর্যকে মহামূল্যবান সামগ্রী বলে দেখানো হয়েছে। অ্যারিস্টটল বলে গেছেন শরীরের রক্ত গরম হয়ে তা বীর্যে পরিণত হয়। অন্য গ্রিকরা আরও এগিয়ে বলে গেছেন মেয়েদের মাসিকের রক্ত আসলে অব্যবহার্য বীর্য থেকেই তৈরি হয়। প্লেটো বলেছেন আমাদের তিন ইঞ্চি আসলে অন্য এক পরজীবী প্রাণী, যার বোধবুদ্ধি খুব বেশি নেই। চীনারা বীর্যস্খলনকে পাপ বলে মনে করত। তাওবাদীরা এখনও বিশ্বাস করেন বীর্যপাত আমাদের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। তাই প্রত্যেকের উচিত স্বমেহন থেকে বিরত থাকা। আমাদের হিন্দুধর্মেও তো ব্রহ্মার বীর্য নিয়ে কতই না কান্ড। এইসব প্রাচীন বিশ্বাস অবচেতন মনে পল্লবিত বা অবদমিত হতে হতে আজ এইরকম বিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে। এই ট্যাবুগুলোও তাই মনে হয় ইয়ুং-এর মতবাদ অনুসারে এক ধরনের ‘আর্কিটাইপ’ যা পূর্বস্মৃতি থেকে আমাদের জেনেটিক স্মৃতিতে ঢুকে পড়েছে।
এই পল্লবিত লতাপাতার গোড়ায় যে নির্ভিক মানুষটি নিয়মিত জলসেচন করে চলেছেন তিনি বি. কে. লোধ। ট্রেন-বাস, সুলভ শৌচাগার, রিক্সার গ্রাফিতি, কাগজের হ্যান্ডবিল সর্বত্রই তার অমোঘ উপস্থিতি। সিলডেনাফিল বা ভায়াগ্রার আবিষ্কারের পরও তার নায়গ্রার শীতকালীন বরফের মত জমাটি প্র্যাকটিস উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ওনার ছবি আমি কখনও দেখি নি কিন্তু ই.টি. এবং ইয়েতির পরে যার আসল ছবি আমার দেখার অসম্ভব ইচ্ছে তিনি এই লোধবাবু। আজ আমাদের বাংলায় যতই ‘সেক্সোলজিস্ট’-দের বাড়বাড়ন্ত হোক না কেন সবার গুরুদেব এই বি.কে.। ছোটবেলায় দেখা হিন্দি সিনেমার ভিলেনদের নাম হত ডি.কে, জে.কে., আর.কে.। মনে হয় এদেরই কোনো বংশধর হিন্দুকুশ ও অযোধ্যা পাহাড় অতিক্রম করে বাংলায় ঢুকে বি.কে. লোধে পরিণত হয়েছেন।
লিঙ্গের আকার নিয়েও আমার পুরুষ রুগিদের মধ্যে জিজ্ঞাসা অন্তহীন। অল্পবয়েসি ছেলেরা এই নিয়ে বিয়ের আগে অসম্ভব চাপে থাকে। সবারই কিছু পেছনপাকা বন্ধু থাকে। তারা মাঠের অন্ধকারে সন্ধ্যেবেলায় মোবাইল জ্বালিয়ে ক্লিনিক্যাল একজামিনেশন করে এবং মতামত জানায়। তাদের বেশিরভাগ মন্তব্যই বুক কাঁপানো। এই পোলাপানরাই চেম্বারে এসে তিন ইঞ্চিকে ছয় ইঞ্চি লম্বা করার ওষুধ চায়। এরপর পর্নোগ্রাফি দেখে প্রস্থেসিস লাগানো বা প্লাস্টিক সার্জারি করা দশ ইঞ্চি দেখে এরা আরও হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। এর সাথে এই সময়ই অবধারিতভাবে ধাতুরোগ যুক্ত হয় এবং কেসটা অবধারিতভাবেই হাইলি সাশপিশাস জায়গায় চলে যায়।
এদের কিছু বলতে গেলেই আমাদের সময় সার্জারির এক ফ্যাকাল্টি প্রফেসরের কথা মনে পড়ে। স্যার খুব বেশি হাসতেন না। দেহাতি টাইপের ছিলেন, সবসময় ছটফট ছটফট করতেন। আমরা ডাকতাম ‘চাষীভাই’। আজ স্যার কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল। স্যার পড়াতে গিয়ে বলতেন, ‘ছেলেদের পেনিস ফুল ইরেকশানের পর ২/৩ ভাগ লম্বায় ও আকারে বেড়ে যায়। এই বাড়তি অংশ স্বাভাবিক অবস্থায় পেলভিসে ঢুকে থাকে’। বলে স্যার তার ছোট সৌখিন গোঁফের নীচ দিয়ে মিটিমিটি হাসতেন।
যারা খুশবন্ত সিং পড়েছেন তারা জানেন তিনি এক জায়গায় বলেছেন বিশ্বের প্রায় সব প্রধান দেশের মেয়েদের সাথে তার সঙ্গম করে মনে হয়েছে যৌন পরিতৃপ্তি কিছুতেই তিন ইঞ্চির আকার বা জাতের ওপর নির্ভর করে না বরং বেশিটাই মিলনেচ্ছু নরনারীর প্রেম ও আকুতির ওপর নির্ভর করে। সে যাই হোক, এসব নিয়ে জ্ঞান দিতে গেলে অনেক কথা চলে আসে। ওসব এখন থাক। চেম্বারে আসা বাচ্চা ছেলেদের অতশত জ্ঞান দেবার সময় তো আমার থাকে না তাই এসব অল্প করে এখানেই বলে রাখলুম। যারা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন তারা এটা পড়ে যদি আমার ভিড় ঠাসা চেম্বারে আমার সাথে আর ছোট-বড় নিয়ে চর্বিত-চর্বন না করেন তবে বাধিত হই।
পুরুষেরা তাদের তিন ইঞ্চির সাথে সাথে অন্ডকোষ নিয়েও বিস্তর চিন্তায় থাকে। ‘’অন্ডকোষ’ বললাম বটে ‘বীচি’ শব্দটা ব্যবহার করাই সঙ্গত ছিল। মেডিসিন ওয়ার্ডে ডক্টর নীলাদ্রি সরকারের ইভনিং রাউন্ড চলছে। স্যারের রাউন্ডকে আমরা বলতাম ‘মা-মাসি রাউন্ড’। সবার মাথায় হাত রেখে ‘কি মা ভালো?’ ‘কি বাবা ভালো?’ – এই বলতেন। স্যারই প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের পড়াতেন। হাতে ধরে ক্লিনিক্স শিখিয়েছিলেন। এমনই একদিন রাউন্ডে এক যুবক ছেলে যার পেটে জল এসেছে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি গো বীচি ফুলেছে?’ স্যার খুব ভদ্র, সাত্তিক লোক ছিলেন। জপ তপ করতেন বলে শুনেছি। সবসময় সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা অ্যাপ্রন পরতেন। স্যারের মুখে ওই কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। পরে বুঝলাম হেঁটো, গ্রামের লোকেরা ওই ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। তারা সেটাই ভাল বোঝে। কিন্তু এই যে আমার কানে কথাটা কেমনতর লাগল সেটা আমার ট্যাবু। আমার রুগিরা যদিও বীচি বলে না। তারা ‘প্যানিস’, ‘বল’ এসব বলে। অনেককে ‘টেস্টিস’ বলে দেখেছি বুঝতে পারে না।
সেই বলস্ বা বীচিদুটিকে পুরুষেরা তাদের জীবনীশক্তির আধার বলে মনে করে। ইউরোলজিতে হাউসস্টাফশিপ চলছে। প্রস্টেট ক্যানসারের রুগিকে ‘অর্কিডেকটমি’ বা অন্ডকোষ বাদ দেবার অপারেশন করা হয়েছে। অপারেশনের পরদিন সেই ভদ্রলোক বাড়ির লোকের সামনে এমন কান্নাকাটি শুরু করলেন এতটা মনে হয় তিনি ক্যানসার হয়েছে জানার পরও কাঁদেন নি। সত্তরের বৃদ্ধও মনে করছেন কি না কি যেন একটা তার শরীর থেকে চলে গেছে।
অথচ মহিলারা কিন্তু কম বয়সে তাদের জরায়ু বাদ গেলেও এমনটা করেন না। অনেকে বলেন বটে যে ডাক্তারবাবু পেটের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে, ব্যাস ওইটুকুই। মহিলাদের ভ্যাজাইনাল হিস্টেরেকটমি অর্থাৎ ভ্যাজাইনা দিয়ে জরায়ু কেটে বাদ দেবার অপারেশন করার পর ভ্যাজাইনা ও কিছুটা সারভিক্স অক্ষত রাখা হয়। সেটা পরে সঙ্গমের কথা মাথায় রেখেই করা হয়। অপারেশনের পর অ্যানেস্থেসিয়া হালকা কেটে যাবার সময় গাইনির সার্জেনকে বলতে শুনেছিলাম, ‘বল, তোমারটা মাধুরী দীক্ষিতের মত করে দেব নাকি হেমা মালিনী?’ অপারেশন থিয়েটারে অনেক নোংরা কথার চালাচালি হয়। তার এক কারণ রুগিরা সংজ্ঞাহীন থাকেন। আরেক কারণ সার্জেনরা ওটিতে প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকেন। তাই সেই অন্তরমহলে ‘গন্ধী কথাবার্তার’ আদান-প্রদান হয় কিছুটা পরিবেশ হালকা করার জন্য। সিস্টাররা এতে অভ্যস্ত। কিছু মনে করেন না।
তবে কখনও কখনও সার্জেনদের কথা কানে এসে লাগে। তখন বাচ্চা ইন্টার্ন। ইউরোলজির স্যার রুগিদের কাছে শিক্ষায় ও সততায় সাক্ষাৎ ভগবান। কিন্তু তিনিও যখন অপারেশন টেবিলে সাকশান মেশিন দিয়ে পেটের ভেতর রক্ত পরিষ্কার করার জন্য অ্যাসিস্ট করা সিস্টারকে ‘সাক্, সাক্ সিস্টার’ বলে ওঠেন তখন তার বিকৃতভাবে বলা কথা আমার কানে এসে লাগত। হতে পারে সেটাও আমার ট্যাবু কিন্তু আমরা ডাক্তারেরা আমাদের অন্তর্নিহিত হাসপাতাল পরিমন্ডলে মাঝে মাঝেই দৃষ্টিকটুভাবে আমাদের ‘ফেটিশ’ প্রবণতা প্রকাশ করে ফেলি। ভাগ্য ভাল এসব আমাদের রুগিদের কানে ওঠে না কিংবা উঠবে না বলেই আমরা হয়ত বলতে পারি। ভেবে দেখলে দেখা যাবে এসব আমরা সবাই বলি যার যার নিরাপদ পরিবেশে।
এই সব গালাগালি সম্ভবত সেই মহান সমাজসংস্কারককে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত হয় যিনিই প্রথম পলিগ্যামাস মানুষকে জোর করে মনোগ্যামিতে পরিণত করেছেন।
(চলবে)
চালিয়ে যান ডাক্তারবাবু