ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি নিয়ে জানার আগে স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে সামান্য কিছু জেনে নেওয়া উচিৎ।
আমাদের দেহে মূলত তিনরকমের স্নায়ু বা নার্ভ আছে।
১. সেনসরি নার্ভঃ এটি স্পর্শ, ঠাণ্ডা, গরম, ব্যথা বিভিন্ন অনুভূতি ত্বক থেকে গ্রহণ করে আমাদের মেরুদণ্ড অথবা মস্তিষ্কের অনুভূতি কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়।
২. মোটর নার্ভঃ এটি মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্ক থেকে উদ্দীপনা শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয়। এই স্নায়ু আমাদের ইচ্ছেমতো হাত পা নাড়াতে ও দৈনন্দিন কাজ কর্ম করতে সাহায্য করে।
৩. অটোনোমিক নার্ভঃ এটি আমাদের দেহের ভিতরের বিভিন্ন গ্রন্থি ও হৃদপিণ্ড, পরিপাক তন্ত্র, শ্বাস তন্ত্র, রেচন ও জনন তন্ত্র গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই স্নায়ু যে কাজগুলি করে সেটা আমরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না বলে এর নাম অটোনমিক নার্ভ।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রায় ৫০% ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
কাদের ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
১ যে ডায়াবেটিস রোগীর দীর্ঘদিন ধরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নেই।
২ ধূমপায়ী।
৩ অতিরিক্ত স্থূলতা।
৪ অতিরিক্ত রক্তচাপ।
৫ রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের বৃদ্ধি ও হার্টের অসুখ।
পলিনিউরোপ্যাথিঃ
এক্ষেত্রে পা ও হাতের দূরবর্তী অংশ প্রথমে আক্রান্ত হয়। হাত, পা ঝিন ঝিন করে। অবশ হয়ে যায়। জ্বালা করে। অনেক সময় আক্রান্ত অংশে বিশেষত পায়ে ছুঁচ ফোটানোর মতো ব্যথা হয়। এই সমস্যা বাড়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময়, বিশেষত রাত্রে ঘুমের সময়। তবে এই ব্যথা সময়ের সাথে আরও বেড়ে যেতে পারে এবং সারাদিনই উপস্থিত থাকতে পারে। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে নার্ভ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথা কমে যায়। কিন্তু তার সাথে সাথে পায়ের ব্যথা, স্পর্শ ইত্যাদি অনুভূতিও চলে যায়।
অনুভূতি চলে যাওয়ায় পায়ে ক্ষত এবং তার থেকে ঘা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এমনিতেই ডায়াবেটিস রোগীদের জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক কমে যায়।
পলির্যাডিকুলোপ্যাথিঃ
এক্ষেত্রে স্নায়ুর উৎপত্তি স্থলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সেই ব্যথা স্নায়ুগুলি যেখানে যেখানে সরবরাহ করছে, সেখানে সেখানে ছড়িয়ে পরে। এর সাথে সাথে মাংস পেশীর দূর্বলতা দেখা যায়। যেমন লাম্বার প্লেক্সাস আক্রান্ত হলে উরু ও নিতম্বে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং আমাদের কোমরের মাংস পেশি দূর্বল হয়ে অনেকসময় হাঁটা চলা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সৌভাগ্যবশত ৬-১২ মাসের মধ্যে এই ব্যথা নিজে নিজে কমে যায়।
মনোনিউরোপ্যাথিঃ
এক্ষেত্রে একটি মাত্র নার্ভ আক্রান্ত হয়। সাধারণত মুখমণ্ডলের স্নায়ু (ক্রেনিয়াল নার্ভ) বেশি আক্রান্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ৩ নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভ বা অকিউলোমোটর নার্ভ। ফলে আক্রান্ত চোখের পাতা পড়ে যায় ও রোগী একই জিনিসকে দুটো দেখে। তাছাড়া ৪ (ট্রক্লিয়ার নার্ভ), ৬ (আবডুসেন্ট নার্ভ) ও ৭ (ফেসিয়াল নার্ভ- বেলস পলসি) নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভ আক্রান্ত হতে পারে।
অটোনমিক নিউরোপ্যাথিঃ
অটোনমিক নার্ভ আক্রান্ত হলে দেহের ভিতরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গণ্ডগোল হতে পারে। যেমন আমাদের হৃদপিণ্ড ও রক্ত পরিবহ তন্ত্র আক্রান্ত হলে হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। শোয়া বা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে রক্তচাপ কমে যায় ও মাথা ঘোরে। অনেকসময় পরিপাক তন্ত্রেরও সমস্যা হয়। ফলে মনে হয় পেটের মধ্যে খাবার জমে আছে।
তাছাড়াও যৌন ক্ষমতাও অনেক সময় কমে যায়। প্রস্রাব ও মল ত্যাগে নানারকম সমস্যা দেখা যায়। শরীরের নীচের অংশে ঘাম কম তৈরি হয়। ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এর ফলে পা ফেটে যায় ও পায়ে আলসার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার অনেক ক্ষেত্রে অটোনোমিক নিউরোপ্যাথি রোগী হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজ কমে গেলে বুঝতে পারে না। যার ফলে তার গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়।
চিকিৎসাঃ
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে নানারকম ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনো চিকিৎসাই তেমন সন্তোষজনক নয়।
এহেতু এই রোগে পায়ে আলসার বা ঘা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়ে, তাই নিয়মিত পায়ের পরিচর্যা করা উচিৎ।
১. পায়ের ত্বক শুকনো হলে লোশন লাগিয়ে ত্বক নরম ও মসৃণ রাখা উচিৎ।
২. পায়ের নখ ভালো করে কেটে প্রান্ত সীমা ঘষে রাখা উচিৎ।
৩. নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম করা উচিৎ। এর ফলে পা সহ দেহের সর্বত্র রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়।
৪. নরম ও আরামদায়ক জুতো পরা উচিৎ।
৫. পায়ের আঙুল্গুলো বারবার নাড়ানো এবং হাঁটু উপর নীচে করা ৫ মিনিট ধরে দিনে ২-৩ বার।
৬. ঘরের মধ্যেও খালি পায়ে হাঁটা যাবে না।
৭. পায়ে কোনও ক্ষত চিহ্ন আছে কিনা নিয়মিত দেখা উচিৎ।
এছাড়াও ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির অন্যান্য চিকিৎসাগুলি হলো
১. রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা। যদিও এক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকা উচিৎ, কারণ অনেক সময় নিউরোপ্যাথির রোগিরা হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তের গ্লুকোজ কমে গেলে বুঝতে পারেন না।
২. উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৩. ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে চলা।
৪. ভিটামিন-১২ (কোবালামিন) ও ফোলিক অ্যাসিড দেওয়া।
৫. এছাড়াও বিভিন্ন রকমের ওষুধ, যেমন আমিট্রিপটিলিন, প্রিগাবালিন, গাবাপেন্টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক উপসর্গ দেখে ঠিক করবেন ঠিক কোন ওষুধ দেওয়া উচিৎ। তবে সময়ের সাথে সাথে নার্ভের আরো ক্ষতি হলে অনেকসময় নিজের থেকেই নিউরোপ্যাথির ব্যথা কমে যায়।
অর্থাৎ নিউরোপ্যাথির ব্যথা কমে যাওয়া মানে কিন্তু নিউরোপ্যাথি ঠিক হয়ে যাওয়া নয়। বরঞ্চ এক্ষেত্রে স্নায়ু আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পায়ে ঘা হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়া। ফলে আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিৎ।