ডাক্তারবাবু কি খাব আর কি খাব না —–রোগটা কি, ওষুধ কিভাবে খেতে হবে, রোগের পরিণতি ও নিরাময় — এসব গুরুতর কথার চাইতেও সবাই বেশি জানতে চান –কি খাব আর কি খাব না। সেই জানতে চাওয়াটা — কোন পাত্রে জল ফোটাব সসপ্যান, কড়াই না হাড়ি –এ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় প্রায়ই। আমরা যতটা পারি ধৈর্য্য ধরে উত্তর দিই।
রোজই অনেক মনখারাপের গল্প জমা হচ্ছে চেম্বার কড়চায় –তার ফাঁকে এই পুরোনো ঘটনাটা সেরে নিই।
আমাদের সরকারি হাসপাতালের টানাটানির সংসারে একটা ছোট্ট ‘টি রুম’ বরাদ্দ ছিল। কাজের ফাঁকে ডাক্তাররা একটু মন খুলে চায়ের কাপে সুনামি আমফান তুলতাম আর কি। পৃথক ঘরের অভাবে মাঝে মাঝে ওটা কখনো হয়ে যেত পেশেন্ট পার্টি মিটের জায়গা। রোগীর বাড়ির লোকেরা জানতেন ওখানে দুটোর পর ডাক্তারবাবুদের পাওয়া যায়। এইরকম এক চাঁদিফাটা রোদে আমরা মধ্যাহ্নভাতের বিকল্প হিসেবে চায়ের সঙ্গে মুঠো মুঠো সপ্তদীপা চানাচুর সাবাড় করছি।
সদ্য ছুটি হওয়া এক পেশেন্টের বাবা এলেন টি রুমে তাঁর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে। –ডাক্তারবাবু, ছেলে কি খাবে তা তো ছুটির কাগজে লেখেন নি!
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ গোটা পঞ্চাশেক রুগী দেখে এসে সবে চায়ে চুমুক দিয়েছেন। ছুটির কাগজটা নিয়ে দেখলেন সাধারণ সর্দিকাশি জ্বর নিয়ে ভর্তি ছিল দুদিন। বাইশ বছরের ছেলে। শান্ত ভাবে বললেন –অখাদ্য কুখাদ্য ছাড়া সব খাবে।
–স্যর, অখাদ্য কুখাদ্য বলতে কি বলছেন ঠিক বুঝলাম না তো —
–আরে, ওই রাস্তার তেলেভাজা টাজা খাবে না
–আচ্ছা ডাক্তারবাবু, ঘরের তেলেভাজা খেতে পারবে?
–হ্যাঁ পারবে।
–রোজ?
–না রোজ না, মাঝেমধ্যে
–মানে ঠিক বুঝলাম না ডাক্তারবাবু, সপ্তাহের মাঝেমধ্যে না বছরের?
–রবিবার আর ছুটির দিন, মুড়ি দিয়ে। যাও এবার বাড়ি যাও।
–কি তেল ডাক্তারবাবু?
–কেরোসিন ছাড়া যে কোনো তেল
–তবু বলুন একটু ডাক্তারবাবু, আপনারা কত পড়ালেখা করেছেন –সর্ষের তেল না সাদা তেল?
–সাদা তেল –সয়াবিন বা সূর্যমুখী
–কোন কোম্পানির ডাক্তারবাবু? আজকাল এত লোক ঠকানো কোম্পানি বেরিয়েছে যে ভয় হয়
–তোমার পাড়ার দোকানে যেটা পাবে। যাও এবার, রোদ বেশি হলে ছেলের কষ্ট হবে
–আচ্ছা আর একটা কথা শুধোই, কি ফল খাবে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু আর ঝামেলায় না গিয়ে এবার স্পেসিফিক্যালি বলে দিলেন –আপেল, মোসাম্বি, আঙুর, কলা, বেদানা, পেয়ারা।
–আর সবেদা ডাক্তারবাবু? আমাদের উঠোনে যে একটা সবেদা গাছ আছে, অনেক ফল দেয় –ছেলেটা ভালোবাসে
–হ্যাঁ হ্যাঁ পারবে
–দিনে কটা ?
–দুটো
–দুটোর বেশি হলে কি কিছু ক্ষতি হবে ডাক্তারবাবু?
–হ্যাঁ, পেটখারাপ হতে পারে
–দেখুন, ভাগ্যে জেনে নিলাম, ছেলেটাতো চার পাঁচটা খেয়ে নেয়
‐-ডিম খাবে ডাক্তারবাবু?
–হ্যাঁ, মুরগীর–দেশি পোলট্রি যাই হোক চলবে, দিনে দুটোর বেশি নয়।
ডাক্তারবাবু ভাবলেন সবটাই এবার বুঝিয়ে দিয়েছেন ।
ছেলের বাবা শুধোল–ডিম সেদ্ধ, পোচ না অমলেট ডাক্তারবাবু? ছেলেটা অমলেট ভালোবাসে।
–যা হোক চলবে
–ডিম হাফ বয়েল না ফুল বয়েল?
–ফুল বয়েল। হাফ বয়েলে খোসার গায়ের জীবাণু মরে না
–এই দেখুন , ভাগ্যে জেনে নিলাম। মাছের ব্যাপারটা একটু বলে দিন ডাক্তারবাবু, আমরা তো অত বুঝি না, আপনি কত পড়েছেন।
–পচামাছ ছাড়া সব খাওয়ার মাছ চলবে।
–জিওল মাছ একটু বেশি ভালো নয়? আমার ঠাকুমা টাইফয়েডের পরে মাগুর মাছের ঝোল দিতেন।
–হ্যাঁ ভালো। চলবে
–ডাক্তারবাবু আমার ঠাকুমা বলতেন ছোট মাগুরে উপকার বেশি। কত বড় জিওল মাছ দেব ডাক্তারবাবু?
–এই পাঁচসপ্তাহ বয়সের। পুকুরে চারা ছেড়ে বসে থাকুন।
–পুকুর আর কোথায় ডাক্তারবাবু, বাজারেই বলে রাখতে হবে। আচ্ছা কি দিয়ে রাঁধবে? ঠাকুমা গোলমরিচ দিয়ে রাঁধতেন –গোলমরিচ না কাঁচামরিচ?
–আমি রান্না জানিনা ভাই, আপনার স্ত্রীকে বলবেন একটু হালকা করে রাঁধতে।
— আসি , আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। একটাই তো ছেলে, বুঝতেই পারছেন।
উনি পেছন ফিরতে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ডাক্তারবাবু সবে এক মুঠো চানাচুর তুলেছেন, অমনি আবার –ডাক্তারবাবু, মাংস কি খাবে? প্রোটিনেই তো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে শুনেছি।
–সব সব , মুরগী, পাঁঠা , খাসি —
–আর দুধ?
–দুধ খাবে।
–খাবে তো বুঝলাম, কিসের দুধ ডাক্তারবাবু –গোরু , মোষ না ছাগল?
এবার ডাক্তারবাবুর কিঞ্চিৎ ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটল। সিগারেটের একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে গম্ভীরভাবে তাকে কাছে ডাকলেন। বললেন –শুনুন। আপনাকে একটা কথা বলি। খুব সিরিয়াস কথা। সবাইকে এসব গুপ্তকথা বলি না। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, তাই আপনাকে বলছি। সত্যি সত্যি পথ্যি দ্বারা ছেলের স্বাস্থ্যের উন্নতি চান তো? আর ইউ রিয়ালি সিরিয়াস? তাহলে একটা ছাগল কিনুন –সারা গা কুচকুচে কালো, শুধু কপালে একটু সাদা ছোপ। এই রকম ছাগলের দুধে খুব পুষ্টি। রোজ দু পোয়া এর দুধ খাওয়াবেন। যান বাজারে গিয়ে আগে এটা খুঁজুন, তারপর অন্যকথা।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন –আর শাকসব্জি কি দেব?
ডাক্তারবাবু বললেন –ওই যে বললাম –আগে ওইরকম ছাগল খুঁজুন তারপর অন্যকথা।
–ডালের ব্যাপারটা একটু যদি বলে দেন –মুগ, মুসুর, ছোলা, মটর না কলাই?
–আগে ছাগল কেনা তারপরে ডাল
–ভাত না রুটি ডাক্তারবাবু ?
–আগে কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ,তারপরে ডাল
–ডাক্তারবাবু চা কফি এগুলো?
–নো । কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ
–চিঁড়ে ভাজা না মুড়ি?
–কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ
–চা বিনা চিনি না চিনি দিয়ে?
–কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ
–দই ,ছানা খাবে?
–কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ
ছোটবেলায় শোনা সেই ‘একটা পাখি উড়ল ফুড়ুৎ –আর একটা পাখি ফুড়ুৎ –ফুড়ুৎ –” এর মতো, এরপর রুগীর বাবা যাই বলেন, ডাক্তারবাবু চোখ কপালে তুলে বলেন –কালো ছাগল কপালে সাদা ছোপ —
আমরা বসে নাটক দেখে যাচ্ছি ।
এক সময়ে উভয়েই ক্ষান্ত হলেন ।
পরদিন আমরা সেই টি রুমে চা চানাচুর খাচ্ছি। সেই মেডিসিনের ডাক্তারবাবু আছেন। হঠাৎ দরজার কাছে কথা কাটাকাটি হট্টগোল। গেটকিপার গ্রুপ ডি ভাইয়ের চীৎকার। ঠেলাঠেলি করে ঘরে ঢুকল আগেরদিনের সেই “কি খাবে কি খাবে না” বাবা। সঙ্গে দুটো কালো ছাগল গলায় দড়ি বাঁধা –মাথায় বেশি কম সাদা ছোপ। দড়ির একপ্রান্ত হাতে ধরে তার ডাক্তারবাবুর কাছে এসে বললেন –‘কাল হাট থেকে আনলাম। দেখুন তো ডাক্তারবাবু,কোনটার দুধে প্রোটিন সবচেয়ে বেশি?’
দুটো ছাগলই একসঙ্গে বলতে লাগল –আমার আমার , ব্যাআআআ ব্যাআআআ ব্যা ব্যা —
(অণুগল্প নয়, সত্যি ঘটনা।।
কিন্তু এ লেখা খাদ্য সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো বার্তা বহন করে না।)
ছবি -..-চটজলদি চেম্বারে বসে আঁকা
Replica of memory