ডঃ দিলীপ মহলানবিসের মৃত্যু উপলক্ষে সামাজিক মাধ্যমে যে আলোচনা শুরু হয়েছে সেগুলি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু বরাবরের মতো বাঙালি আবেগের আতিশয্যে কিছু ভুল তথ্য তত্ব প্রচার করে ফেলেছে।
সঠিক তথ্য ও তত্ত্বের দু একটি দিক
ভারতীয় উপমহাদেশে কলেরা তথা একিউট ওয়াটরি ডায়রিয়া নিয়ে দুটি গবেষণা কেন্দ্রে সমান্তরাল ভাবে গবেষণা চলেছিল। একটির নাম জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং, যেটি কলকাতায় আর আরেকটি সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের সহায়তায় ঢাকা বাংলাদেশের পাকিস্থান সিয়েটো কলেরা রিসার্চ ল্যাব, যার ফিল্ড স্টাডি এরিয়া ছিল মতলব।
ডঃ দিলীপ মহলানবিস কলকাতার গবেষণা কেন্দ্রটির সাথে যুক্ত ছিলেন। যে ভাবে ওঁকে বর্ণনা করা হচ্ছে, সে ভাবে উনি ওআরএস এর আবিষ্কর্তা ছিলেন না, বলতে পারেন ওআরএস ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তোলার ওনার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওঁর অনেক আগে ১৯৪০ এর দশকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল দ্যারো মুখে খাওয়ায় ওআরএস নিয়ে গবেষণা করেন। রিচার্ড ক্যাশ ও ডেভিড নলিন প্রথমে চিটাগং ও পরে ঢাকা (মতলব) প্রটোকল প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় শরণার্থীদের ওপর ওআর এস ব্যবহার নিয়ে ডঃ মহলানবিশ ল্যানসেটে যে পেপারটি লিখেছিলেন তাতে অনেক খামতি ছিল, যেমন ওটি কেস কন্ট্রোল স্টাডি ছিল না, ইন্ডিভিজুয়াল পেসেন্ট ধরে ধরে ইনটেক আউটপুট চার্ট ছিল না, কনসেন্ট ফর্ম ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই ভাবে নোবেল পাওয়া যায় না।
ওনার অবদান খুব বড় মাপের ছিল যার জন্য উনি রয়াল সুইডিশ একাডেমির সভ্য পদ লাভ করেন ও ইউ এস এ-র পলিন প্রাইজ পান। কিন্তু নোবেল ইজ সামথিং এলস।
এই প্রসঙ্গে আরো দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানী, ডঃ হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জি ও ডঃ ধীমান বড়ুয়ার নামও স্মরণযোগ্য। প্রথমজন ১৯৫০ সালে গ্লুকোজ – সোডিয়াম ইলেকট্রো লাইট সল্যুশন নিয়ে কাজ করেন। আর দ্বিতীয় জন মহালনবীশের গুরু ছিলেন।
আধুনিক গবেষণার স্বীকৃত পদ্ধতি নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকায় ফলে সাধারণ পাঠকদের মনে বিভ্রান্তি জন্মায় যার জন্য পাঠক তো বটেই, লেখকরাও কিছুটা দায়ী। অরণ্যদেব স্টাইলে ইন্ডিভিজুয়াল গবেষকের একার অবদানে বিরাট কিছু আবিষ্কার করার পদ্ধতি প্রায় অচল হয়ে গেছে। এখন সবই প্রায় টিম গেম। যেমন ধরুন, ডঃ ক্যাশ ও নলিন যে কলকাতায় এসে সেখানকার গবেষকদের সাথে রীতিমত তথ্য বিনিময় করেছেন, আলোচনা করেছেন সে সব উল্লেখই করা হল না। মহলানবিশ একা দুম করে কিছু করে ফেলেন নি। উনি যে পরিস্থিতিতে বনগাঁ হাসপাতালের দুটো ঘরে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন দু জন মাত্র পাশ করা নার্স নিয়ে, সে সময় সম্ভব ছিল না প্রপার মেটিকুলাস ডকুমেন্ট মেনটেন করার। মানুষের জীবন বাঁচানোই প্রধান লক্ষ্য ছিল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের দাবি তার চেয়ে কিঞ্চিত বেশি, সে ডিটেইল ডকুমেন্টেশন চায়।
কি আর করা যাবে? নোবেল এলো না বাঙালির ঘরে!