তথ্যের জাগলারি
নতুন কোনো প্রকল্প তৈরি করতে গেলে, পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ যেমন জরুরি তেমনই তথ্য পরিসংখ্যান অপরিহার্য। বাজারের নিয়মে, কোন উৎপাদনে লাভ হতে পারে, সেটা নির্ভর করে চাহিদা আর যোগানের উপর। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রায় শুনতে হয় রাজ্যে চিকিৎসকের বিপুল অভাব। যোগান নেই। আরও শুনতে হয় কেউ গ্রামে যেতে চায় না। তাই রাজ্য সরকার বিকল্প চিকিৎসক বানানোর বিবেচনা বিবর্জিত, অবৈজ্ঞানিক, বিবিধ কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছ। নানা ক্ষেত্র থেকে প্রতিবাদ হলেও শোনা হয়নি। ভিন্ন মত, ভিন্ন পথ থাকলেও উপেক্ষিত থেকেছে। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করাই নাকি সরকারের উদ্যেশ্য। কিন্তু গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্রের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা কেন তার উত্তর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি আবার একটি নতুন প্রকল্প চালু করতে উদ্যোগী রাজ্য। এবার মডার্ন মেডিসিনে ডিপ্লোমা ডাক্তার। নিন্দুকেরা!!!! বলছে সিভিক পুলিশ, সিভিক টিচারের পর সিভিক ডাক্তার। কেউ কেউ বলছে হাফ প্যান্ট ডাক্তার। নেট দুনিয়ায় স্বাস্থ্য নিয়ে এরকম নানা মিমের বন্যার মধ্যে স্বাস্থ্য দপ্তর কিন্তু একদিনও দেরি না করে কমিটি তৈরি করে দিয়েছে সিভিক ডাক্তার বানানোর পথ খোঁজার জন্যে। তাঁদেরও মাথা খোঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
তবে প্রচার যাই থাক, তথ্য পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই বোঝা যাবে, দু একটি রাজ্য বাদ দিলে, গোটা দেশে, বর্তমানে কোথাও,মডার্ন মেডিসিনে চিকিৎসকের অভাব নেই। আমাদের রাজ্যেও নেই। গ্রাম শহরের কিছু পার্থক্য অতীতেও ছিল। এখনো আছে। কিন্তু নয়ের দশক থেকে, উদারীকরণের হাত ধরে,অন্যান্য শিক্ষার মতো, চিকিৎসা-শিক্ষাও বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, ব্যাঙের ছাতার মতো মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হচ্ছে দেশ জুড়ে। কেন্দ্রীয় সরকার ও এনএমসির তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল ২০২৩সে, দেশে মডার্ন মেডিসিন পড়ানোর মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৬৮০। প্রতি বছর এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে ৩৭২টি সরকারি, আধা সরকারি অথবা কেন্দ্রীয়। বাকি বেসরকারি। সরকারি কলেজ গুলোতে এমবিবিএস পড়ানোর মোট সিটের সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজার। তবে সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক, আমাদের দেশে এক লাখের কাছাকাছি ডাক্তার তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর। এই মুহূর্তে দেশে মডার্ন মেডিসিনের রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশি। সঙ্গে সাড়ে সাত লাখ আয়ুষ ডাক্তার জুড়লে, ১৪০ কোটি ভারতবাসীর জন্যে চিকিৎসকের অভাব থাকার কথা নয়। কার্যত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১০০০ জনে একজন চিকিৎসক থাকার সুপারিশ আমরা ছুঁয়ে ফেলেছি। গ্রাম শহরের কিছু পার্থক্য থাকলেও,বর্তমানে দেশে এই অনুপাত ৮৩৪:১। ফলে দেশে বা রাজ্যে চিকিৎসকের অভাব নেই বললেই চলে।
কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের রাজ্য?
এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ২৫। ছাত্র সংখ্যা ৩৭২৫। বেসরকারি কলেজ ৭। ছাত্র সংখ্যা ১০৫০। সরকারি হাসপাতাল কার্যত বিনা পয়সায় ভাড়া দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে অবাধে। দুটো কলেজ চালু হয়ে গেছে। আরও কয়েকটি পাইপ লাইনে আছে বলে শোনা যাচ্ছে। ফাঁকা মাঠে কিছু ঘরবাড়ি বানিয়ে রমরমিয়ে ডাক্তারি পড়ানোর ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। চলছে মাছের তেলে মাছ ভাজা। কোনো ভাবে, একবার একটা ব্যাচ ভর্তি করতে পারলেই কেল্লা ফতে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু পার্থক্য থাকলেও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার খরচ মোটামুটি ৭০ লাখ থেকে কোটি পর্যন্ত। বিশেষ কিছু লগ্নি না করেই বিপুল লাভজনক এই ব্যবসা করা যাচ্ছে। পরিস্থিতি যা, তাতে কিছু দিনের মধ্যে খৈনি গুঠখা ব্যবসায়ীরাও ডাক্তারি পড়াতে নেমে পড়তে পারেন। যদিও চিকিৎসা শিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির অন্তর্নিহিত এজেন্ডাই হলো স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য-শিক্ষা থেকে সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়া, তাহলেও স্বাস্থ্যের দায় ঝেড়ে ফেলার সুযোগ নিতে, সবার আগে, স্বাস্থ্য নিয়ে বাগড়ম্বর করা আমাদের রাজ্যের ঝাঁপিয়ে পড়া আরও আশ্চর্যের।
সরকার দাবি করছে চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি ভাষ্য যদি সত্যি হয়, তাহলে কেন গত সাত বছর ডেন্টাল সার্ভিসে নিয়োগ হয়নি? কেন বছরে অন্তত একবার জেনেরাল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগ হয়না? কেন স্থায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বদলে, দাস শ্রমিকের মতো,বন্ড ডাক্তার দিয়ে চালানো হবে হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ? কেন শিক্ষক-চিকিৎসক নিয়োগও হবে চুক্তিতে? একদিকে সরকার বলছে নার্স নেই, অন্যদিকে চাকরির দাবিতে নার্সদের আন্দোলনে লাঠি চালাচ্ছে পুলিশ। গ্রামীন স্তর থেকে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত কোথায়,কতো চিকিৎসকের পদ খালি আছে কেন জানাচ্ছে না সরকার? তথ্য সামনে এলে প্রচার মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কাতে? তথ্যই বলছে আমাদের রাজ্যে চিকিৎসকেরর অভাব নেই। চাকরির দাবিতে বারবার রাস্তার আন্দোলন প্রমান করে রাজ্যে প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব নেই। দ্রুততার সঙ্গে নবীন,সদ্য পাস করা চিকিৎসক,প্যারামেডিক্স দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগের পরিকল্পনা না করে,ডাক্তার নেই বলে হল্লা হলে প্রশ্ন উঠবেই।
তাহলে উদ্যেশ্য কি স্থায়ী নিয়োগ না করা? দিন মুজুরির সিভিক পুলিশের মতো সিভিক ডাক্তার। অল্প মাইনে, ডিএ দিতে হবে না, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বাদ। পেনশনের দায় নেই। কোয়াটার গুলো মেরামত না করেও চলে যাবে। পরিকাঠামোর অভাবে কেউ চেঁচালে ছেঁটে ফেলা যাবে। জনগনের স্বাস্থ্য ক্রিটিক্যাল কেয়ারে চলে গেলেও, স্থায়ী নিয়োগ না করে, টাকা বাঁচিয়ে, খেলা মেলা উৎসবে আরও জৌলুস বাড়ানোর সুযোগ থাকবে। সরকার কি আদৌ চিকিৎসক নিয়োগে আন্তরিক? তাহলে যোগদান সুনিশ্চিত করতে কেন ইন্টার্নশিপ শেষের আগেই কলেজ ক্যাম্পাসিং হচ্ছে না? বাড়ির কাছাকাছি চাকরি পাওয়ার অফার থাকলে অনেকেই উৎসাহিত হবেন চাকরিতে যোগদান করতে। কেন হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড ঘুমাবে? নিয়োগ মেধা তালিকা প্রকাশ করতে কেন ১৮ মাস লাগবে?
কেন নিয়োগ, প্রমোশন, বদলিতে বারবার স্বজনপোষণ, রাজনীতি, দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে? ডাক্তার উদ্বৃত্ত হওয়ার বাতাবরণে, অভাবের যুক্তি নানা প্রশ্নের জন্ম দেবেই। প্রতিবাদ হবেই। সমালোচনা হবেই। সর্বোপরি দেশের আইন বাদ দিয়ে কোনো অঙ্গরাজ্যে, নিজের মতো ডাক্তারি পড়ানো যে সম্ভব নয় এটা বোধহয় অবোধেও বোঝে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, জেনে বুঝেও, সরকারি কমিটি গভীর আলোচনায় ব্যস্ত মুখ রক্ষার পথ বার করতে। কেউ বলছে না রাজা তোর কাপড় কোথায়।
লক্ষ্য কি বেসরকারি ক্ষেত্রে সস্তায় চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান যোগান সুনিশ্চিত করা?
বর্তমানে স্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরত চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ চুক্তি ভিত্তিক। বন্ড চিকিৎসক,স্থায়ী আরএমওর পরিবর্তে চুক্তির সিনিয়র রেসিডেন্ট যেমন আছে, তেমনিই ন্যাশনাল হেলথ মিশনের ডাক্তার, প্যারামেডিকস, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী প্রায় সবই চুক্তি ভিত্তিক। এজেন্সির মাধ্যমে মাত্র ৭/৮ হাজার টাকা বেতনের জিডিএ, স্ক্যাভেনজিং স্টাফ,সিকিউরিটি এই হিসেবের বাইরে। সংবাদে প্রকাশ সব দপ্তর মিলিয়ে নাকি প্রায় ৫ লক্ষ স্থায়ীপদ খালি। স্থায়ী নিয়োগ না হলে সরকারের দায় দায়িত্ব থাকে না। ৮ ঘন্টার নিয়ম ভেঙে দরকারে ১২ ঘন্টা খাটিয়ে নেওয়া যায়। দলীয় ক্যাডার তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ থাকে।
শত শত ডাক্তার, হাজার হাজার নার্স, টেকনিশিয়ান সরকারি চাকরি না পেয়ে, যেখানে অসম্মানজনক মাইনেতে বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেখানে অসত্য নির্মাণ ও বিভ্রান্তি যেমন নাগরিক সমানাধিকার, বিজ্ঞান চেতনার জন্যে বিপজ্জনক, তেমনই
প্রশ্ন উঠবেই লক্ষ্য কি তাহলে স্থায়ী নিয়োগ না করা, নাকি কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ মুনাফা।
ডিপ্লোমা ডাক্তার ও সরকারি কমিটির রিপোর্ট
কোভিডের সময় থেকে আমরা দেখে আসছি, স্বাস্থ্য বিষয়ে যে কমিটিই তৈরি হোক না কেন, সেটার মাথায় বিশেষ কয়েকজন ছাড়া স্বাস্থ্য দপ্তর অন্য কাউকে খুঁজে পায়না। কাউকে অসম্মান না করলেও, প্রশ্ন করতেই হয়, রাজ্যে কি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য বোঝেন আর কেউ নেই? একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে কেন দিনের পর দিন উত্তরবঙ্গের জনস্বাস্থ্যের হর্তা কর্তা বিধাতা করে রাখতে হবে দিনের পর দিন? সরকারি পয়সায় তাহলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বানানোর দরকার কি? গ্রামীন হাসপাতালের জন্যে প্রস্তাবিত ডিপ্লোমা ডাক্তার তৈরির কমিটিতেও একই মুখের সারি। তবে কমিটির প্রথম বৈঠক থেকে ডিপ্লোমা ডাক্তার তৈরির প্রস্তাব বাতিল হওয়ায় অন্তত চিকিৎসক মহল আশ্চর্য হয়নি। যারা দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার আইন কানুন একটু আধটু বোঝেন, তারা জানেন এটা করা সম্ভব নয়।
কোনো রাজ্য নিজের মতো করে, মডার্ন মেডিসিনের কোনো পাঠক্রম চালু করতে পারে না। স্বাস্থ্য-শিক্ষা যৌথ তালিকায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো নতুন কোর্স চালু করা সম্ভব নয়। তাই মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব যে বাতিল হবে এটা নিয়ে চিকিৎসকদের কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে নতুন বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে ওই কমিটি। তাঁরা গভীর আলোচনায় মগ্ন সরকারের মুখ রক্ষায় কিছু একটা দাঁড় করাতে। সেটা হাঁসজারু হোক বা বকচ্ছপ যাই হোক না কেন। এক্স-রে, ইসিজি, রেডিওথেরাপি,ল্যাবরেটরি,ওটি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার টেকনিশিয়ান, ফিজিসিআন অ্যাসিস্টান্ট, পারফিউসনিস্ট সমেত অসংখ্য প্যারামেডিক্যাল কোর্স যেখানে চলছে, এবং তারা পাশ করে দিনের পর দিন চাকরি না পেয়ে বসে আছেন, সেখানে নতুন কোর্স চালু করার দরকার কি? যারা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় আছেন, তাদের প্রশিক্ষণ,প্রমোশন দিয়ে কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না? কেন মানুষের স্বাস্থ্য গ্রাম শহরে বিভাজিত হবে? কেন গরিব আর ধনীদের জন্যে আলাদা প্রকল্প থাকবে? জীবনের মূল্য,জনস্বাস্থ্য কি ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরে আলাদা হতে পারে? কেন গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলির পরিকাঠামো অবহেলিত থাকবে? কেন জীবনদায়ী ওষুধের সরবরাহ নিরিবীচ্ছিন্ন হবে না? কেন গ্রামীন হাসপাতালের কোয়াটারগুলো ভূতের বাড়ি, সাপের আখড়া হয়ে থাকবে? কেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে সুরক্ষা, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে না? সরকারের কাছে এই সব বেয়াড়া প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশা না থাকলেও, কমিটির সদস্যরা যেন ভুলে না যায় মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে বা মানুষ প্রতারিত হতে পারেন, এমন সুপারিশ তাঁদের রিপোর্টে থাকলে,তার দায় কিন্তু ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না কেউ।