।।আমি দেখি তাই এই মহাবিশ্ব আছে।।
আমাদের আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস বলতে গেলে দেখা যায় তা অধিকাংশই বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত। বিশেষভাবে আমরা যদি বিগত দু’শ বছরের ইতিহাসের কথা বিচার করি। এই বিরাট বিপুল মহাবিশ্ব নিয়ে আগে আমাদের ধারণা ছিল স্থিতিশীল। নিউটনের মহাকর্ষ বলের আবিষ্কারের পরেও সেই ধারণা বদলালো না উল্টে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংহত হল। এরপর আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব তার চারমাত্রার ধারনায় আমাদের কাছে আপেক্ষিকতার বোধ নিয়ে এল। আমরা বুঝলাম স্থান ও কাল আলাদা নয়। তারা একই। স্থান-কালের এক নিরবচ্ছিন্ন ফ্যাব্রিকের মধ্যে এই মহাবিশ্ব তার সকল অভিনয় মঞ্চস্থ করে বেড়াচ্ছে।
১৯৬০ সালে বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণ ও ১৯৭০ সালের দিকে মহাবিশ্বের ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে নিয়ে এলেন ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধাঁধাঁর জগতে বিচরণ করে তারা বললেন, মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ তারা জেনে গেছেন। আমরা যারা অজ্ঞ তারা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের মহাবিশ্ব কোথা থেকে এসেছে’? তারা বললেন, ‘ইট জাস্ট পপড্ আপ ফ্রম নাথিংনেস’। মানে শূন্যতা থেকে হঠাৎ করেই একদিন এই বিপুল মহাবিশ্ব জেগে উঠল।
আমরা মুগ্ধ। আবার বোকার মত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে কোনো শূন্যতা থেকে এতওওও কিছু কিভাবে হতে পারে’? তারা বললেন, ‘পারে। এসবই ‘কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের’ খেলা’। আমরা আবার নির্বাক। আমরা আবার বোকা ছেলের মত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই যে ১৩.৭ বিলিওন বছর আগে বিগ ব্যাং হল তার আগে কি ছিল’? তারা বললেন, ‘ওরে মূর্খ, তার আগে কিছুই ছিল না। সময়ের হিসেব করাই শুরু হল বিগ ব্যাং-এর পর থেকে’। আমরা এবার সত্যিই চমৎকৃত। কিন্তু অজ্ঞানের প্রশ্নের শেষ নেই। আমরা বললাম, ‘আচ্ছা এই যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েই চলেছে, এটা কি চিরকাল এমনই প্রসারিত হয়ে চলবে? তার প্রসারণ কি কখনও বন্ধ হবে না’? তারা এবার একটু অপ্রস্তুত। তবে বললেন, ‘সম্ভবত এটা প্রসারিত হয়েই চলবে। সঠিক জানা নেই’।
আমাদের সবার মধ্যেই এক দুষ্টু ছেলে থাকে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা আপনারা বলছেন, এই মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৪% আমাদের এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব। বাকি ৯৬% ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার। আপনারা কি এদের সম্পর্কে কিছু জানেন’? তারা এবার গম্ভীর। বললেন, ‘না আমরা এদের ব্যাপারে কিছুই জানি না’। ছেলেটি বলল, ‘আপনারা এই মহাবিশ্বের ৯৬% বিষয়ে কিচ্ছু না জেনে কিভাবে বলছেন যে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির রহস্য আপনারা সমাধান করে ফেলেছেন’? তারা নিরুত্তর।
আমাদের মধ্যে আরেকটু পড়াশুনো করা অজ্ঞ এক লোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা আপনারা বলছেন যে এই মহাবিশ্বের সকল বস্তুকণা স্ট্রিং-এর মত, তাদের কম্পাঙ্ক আলাদা। এদের রহস্য জানলেই আপনারা ‘গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি’ বা ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ জেনে যাবেন, এটা কি সত্যি’? তারা এবার একটু উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তাই ভাবছি। আমরা তার খুব কাছে চলে এসেছি’। তিনি এবার বললেন, ‘আপনাদের যাঁরা নিন্দুক আছে তাঁরা বলছেন আপনারা গত চল্লিশ বছর ধরেই বলছেন, এই তো হয়ে এল। এবারই জেনে যাব কিন্তু সেই ‘জানা’ আর হচ্ছে না। এটা কি ঠিক’? ‘অনেকে অনেক কিছু বলেন তাতে কিছু এসে যায় না। আমাদের গণিত অভ্রান্ত, সুন্দর। তাই আমাদের থিওরি সঠিক হতে বাধ্য’।
আপনারা বলছেন, ‘আপনাদের থিওরি প্রমাণ করতে অন্তত আটটি ডায়মেনশন লাগবে। আমরা যারা তিন মাত্রার জগতে থাকি তাদের পক্ষে স্পেস-টাইমের চারমাত্রার ধারণা করাই অসম্ভব। আটমাত্রা আপনারা আমাদের কিভাবে ধারণা করাবেন’? ‘আপনি কি ধারণা করছেন তার ওপর বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে নেই। বিজ্ঞানের নিয়ম বিজ্ঞানের কাছে, আপনার ‘কনশাসনেস’ বা ‘চেতনা’ আপনার কাছে’।
কথাবার্তা শেষ হল। কিন্তু আমাদের মনে ঘুরপাক খেতে থাকল সেই প্রশ্নঃ সত্যিই কি বিজ্ঞানের কাছে চেতনার কোনো দায় নেই? আমরা যা অনুভব করি তার কি কোনো গুরুত্ব নেই বিজ্ঞানের কাছে? এবার আমরা যদি একটু কূট প্রশ্ন করি, আচ্ছা বিজ্ঞান কি জানে ‘চেতনা’ কি? কিভাবে তার উৎপত্তি? তার অভিমুখই বা কি? একবাক্যে স্বীকার করতে হয়, ‘না। চেতনা কী বিজ্ঞানের তাই নিয়ে কোনো ধারণাই নেই। কোনো থিওরিও নেই। যা আছে তাকে সামান্য কিছু ‘কনজেকচার’ বলা যেতে পারে মাত্র। বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত চেতনা নিয়ে তেমন কিছু ভাবেই নি। গবেষণা যা হয়েছে তা খুবই নগণ্য। সেই গবেষণা চেতনার ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারে নি’।
এবার যদি শেষ প্রশ্ন করি, বিজ্ঞান কি কখনো চেতনা কি তা জানতে পারবে? সে প্রশ্নের উত্তরও এক কথায় দেওয়া যায়। এর উত্তর আমিই আপনাদের দিতে পারব। এর জন্য আপনার কোনো মহাবিজ্ঞানীর কাছে যাবার দরকার নেই।
“বিজ্ঞান কোনোদিনই জানতে পারবে না ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ কি। সে কোনোদিনই জানতে পারবে না ‘চেতনা’ বা ‘কনশাসনেস’ কি? কারণ ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ ধারণাটাই ভুল। ওটা বলে কিছু হয় না বা বোঝায় না। এই মহাবিশ্বকে একটা সমীকরণে বাঁধা সম্ভব নয়।
চেতনা দিয়ে চেতনাকে জানা সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষককে নিরপেক্ষ হতে হবে। সেটা চেতনার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। আর যন্ত্র দিয়ে চেতনাকে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়। সেই কারণেই ইলন মাস্ক যাই বলুন না কেন, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এ.আই. বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কখনই আমাদের মত চেতনার অধিকারী হতে পারবে না। সেটা সম্ভব নয় বলেই পারবে না। তারা বুদ্ধিতে আইনস্টাইন বা শয়তানিতে হিটলার হতে পারবে কিন্তু আমার আপনার মত অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকের মতও ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর রামধনু দেখে চমকে উঠে বলতে পারবে না, আহা কি অপূর্ব”!
আমাদের একটা ধারণার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তাই এবার আমরা আমাদের মূল আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। চেতনা কি? কোথায় তার উৎপত্তি? আমরা তার সম্পর্কে কতটাই বা জানি? কিভাবে আমরা জানতে পারব? আমাদের জানার প্রতিবন্ধকতাই বা কোথায়?
আজ পর্যন্ত চেতনা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে তার বেশিরভাগই দার্শনিক। আমরা বিজ্ঞানকে আশ্রয় করেছি তাই সে পথে আমরা বেশিদূর পা বাড়াব না। কিন্তু দার্শনিক আলোচনার কথা উঠেছেই যখন যার কথা না বললেই নয় তিনি রেনে দেকার্তে। তার সেই অমর কথা, cogito ergo sum ( I think, so I am) । আমি ভাবি, তাই আমি আছি। আমি দেকার্তে পড়ি নি। পাশ্চাত্য দার্শনিকদের প্রায় কাউকেই পড়ি নি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এই কথা নানান লোকের লেখার কথার আলাপে-প্রলাপে আমার মতই আপনাদেরও নিশ্চই ‘চেতনার’ সাথে জড়িয়ে-মিশিয়ে গেছে।
আজ জেনেছি শোপেনহাওয়ার, বার্কলে থেকে শুরু করে অনেক আধুনিক দার্শনিকই এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাতে সেই বাক্যের জৌলুস বিন্দুমাত্র ক্ষয়িত হয় নি। উল্টে বেড়েছে। কিন্তু আজ যদি আমরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই বাক্যের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে আমরা কী বলব? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, কোনো বস্তুর অস্তিত্ব পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তাই আমি যখন দেখছি আমার পোষা কুকুর বাড়িতে আছে তখন সে আছে। যে মুহূর্তে আমি তাকে দেখছি না, সে আছে কি নেই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। হয়ত সে নেই। তাই দেকার্তের কথাকে কোয়ান্টাম দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, ‘আমি দেখছি তাই সবকিছু আছে এমনকি আমি নিজেও আছি। আমি না দেখলে কিছুই নেই’। এই জগত এক বিরাট বড় মায়া। এক অন্তহীন ইলিউশন।
যে মহাবিজ্ঞানী সারা জীবন ধরে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরোধিতা করে এসেছেন একদিন প্রিন্সটনে নিজের বাড়ির দিকে হেঁটে যাবার সময় আব্রাহাম পাইসকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা তুমি কি বিশ্বাস কর যে আমি আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি তাই সেটি আছে, আমি না তাকালেই সেটি নেই’? তিনি আসলে বলতে চাইলেন এই দৃশ্যমান পৃথিবীতে পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না এটা হতে পারে না। তিনি আজীবন তাই বিশ্বাস করে গেছেন। অথচ আজ বিজ্ঞানীরা একবার নয় বারবার পরীক্ষা করে তাই দেখছেন, আমরা দেখছি তাই সেটি আছে।
এই ধোঁয়াশা ধারণার মধ্যে ততোধিক কুয়াশাময় চেতনা নিয়ে আমরা কিছু কথা বলব। আমাদের আলোচনায় তাই শারীরবিদ্যার সাথে সাথে পদার্থবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ও দর্শনও কিছু কিছু চলে আসবে। আমাদের চেতনা নিয়ে কথা বলতে হলে আমরা কিছুতেই আমাদের চারপাশের প্রধান দুটো অবলম্বন স্থান ও কালকে অবজ্ঞা করতে পারি না কারণ এই স্থান ও কাল নিয়েই আমাদের চেতনার উন্মেষ। ‘আমি’ যেহেতু চেতনার ‘কেন্দ্র’ তাই আমার অবস্থান সবার আগে নির্দিষ্ট করতে হবে। আর তা করতে হলে স্থান-কালের ঘেরাটোপে না জড়িয়ে আমার উপায় নেই।
(চলবে)
ভাল লাগল। অপেক্ষায় রইলাম।