সকালে হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ল। কেন মনে পড়ল সে আমার এখন আর মনে নেই – সঙ্গে শার্লক হোমস-ও ছিলেন না, যে তিনি আমার চোখে কখন কোথায় গেছিল দেখে বলে দেবেন আমার চিন্তার ধারা কোনদিকে বইছিল। তবে একটা ঘটনার চিন্তা মাথায় এলে তা থেকে নানা চিন্তা বেরিয়ে আসে সেটাও হলো – অনেকটা রঙিন সোয়েটারের বুনোট খুললে যেমন নানা রঙের উলের সুতো বেরিয়ে আসে, সেরকম। লিখতে গিয়ে সেগুলোও লিখে ফেলছি – ফলে কাহিনির গতি একমুখী হবে না…
ক্লাস নাইনে আমাদের সেক্সন নির্ধারণ হয়েছিল অ্যাডিশনাল সাব্জেক্ট দিয়ে। এবং কোন ছাত্র কী অ্যাডিশনাল নেবে ঠিক করে দিয়েছিল স্কুলই। অভিভাবকদের কানাঘুষোয় শুনতাম বটে যে আমাদের স্কুল নাকি ভালো ছাত্র আর খারাপ ছাত্রদের আলাদা করে দেয় এবং ভালো ছাত্রদের ভালো করে পড়ায় – কিন্তু সে সব আমরা বিশ্বাস করতাম না। কেন, আমাদের সেক্সনেই এমন অনেকে ছিল যারা অল-সেক্সন র্যাঙ্ক করত – তার বেলা?
ক্লাস নাইনে উঠে জানলাম যে যারা ভালো ছাত্র, তাদের অঙ্ক, ফিজিক্স, মেকানিক্স, কেমিস্ট্রি জাতীয় বিষয় অ্যাডিশনাল নিতে দেওয়া হবে। আর আমরা যারা খারাপ ছাত্র, তাদের নিতে হবে হিউম্যানিটিজ-এর কিছু বিষয়, নয়ত বুক-কিপিং। আমাকে বলা হলো আমার জন্য উৎকৃষ্ট হবে বুক কিপিং।
বাড়িতে বুক কিপিং শুনে হাহাকার পড়ে গেল! ছেলেকে কমার্স পড়াতে হবে! অবশ্য এই হাহাকারের কারণ আমি আজও জানি না। আমার বাবা এবং মামাবাড়ির পরিবারে সবাই সায়েন্স পড়া এমনও নয়। কেবল বাবা-ই ইঞ্জিনিয়ার। আমার জ্যেঠু মেডেলধারী কমার্স স্টুডেন্ট এবং তখন শিলচরে নামকরা কমার্স অধ্যাপক, আমার দুই পিসি-ই হিউম্যানিটিজের ছাত্রী। আমার ছোটোমামা বাংলা অধ্যাপক। তাহলে?
‘তাহলে’ জানতে চাওয়ার অধিকার দিয়ে আমাদের বড়ো করা হয়নি। তাই কাউকেই জিজ্ঞেস করা গেল না। একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল ছোটোমামা – ভাগ্নেকে বুক কিপিং পড়তে হবে শুনে মামার মুখ হলো সেই সেদিনের মতো, যেদিন বন্ধুস্থানীয় প্রিয় সহকর্মীকে দাহ করে এসে বাড়ি ঢুকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “শ্মশান থেকে আসছি,” ফলে ছোটোমামাকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না।
স্কুলে গিয়ে বললাম, “শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং অ্যাডিশনাল নেব।” দেখলাম তাঁরা খুশিই হলেন।
শর্টহ্যান্ড শিখতে গিয়ে দেখলাম, যে পদ্ধতিটা কেবলমাত্র সহজ আঁকিবুঁকি দিয়ে সৃষ্ট নয় – আর একটা ব্যাপার আছে। লেখার সময় কমানোর জন্য যারা পটু, তাঁরা স্বরবর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যঞ্জনবর্ণ বাদ দিয়ে লেখেন। ফলে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম হয় – queue লেখা হয় কেবল q! আমরা কয়েকজন ক্লাসে শর্টহ্যান্ড টাইপিঙে এমনই পারদর্শী হয়ে গেছিলাম, যে সত্যিই ক্লাসে শর্টহ্যান্ডে নোট নেবার মতো ক্ষমতা রাখতাম। অবশ্য শর্টহ্যান্ডেই নোট নিতাম এমন নয় – আমি নিজে অনেক সময়েই কুঁড়েমি করে শর্টহ্যান্ডের ছোটো করার ক্ষমতা ব্যবহার করে ভাওয়েল আর অপ্রয়োজনীয় কনসোন্যান্ট বাদ দিয়ে লং-হ্যান্ডেই লিখতাম। ফলে breadকে লিখতাম brd, crowকে crw, বা assassinationকে asasntn। একটা লম্বা উদাহরণ দিই, জিওগ্রাফি থেকে – “T Hmlys, or Hmly, s a mntn rng n Asia sprtng t plns f t Indn sbcntnt frm t Tbtn Pltu. T rng hs mny f Erth’s hyst pks, ncldng t hyst, Mt Evrst, t t brdr btwn Npl nd Chn.” এরকম করে আমি জানি অনেকেই লিখেছি – আজকাল তো লোকে সারাক্ষণ লিখছে, সুতরাং কাজটাও আমার যে খুব একার পেটেন্ট নেওয়া, তা-ও নয়।
ঘটনাটা ঘটল ক্লাস টেন-এ। ইংরিজি টিচার ছিলেন – আচ্ছা নাম-টা উহ্য থাক, এটুকু জানলেই চলবে যে সেটা বিষ্ণুর কোনও একটা অবতারের নাম। ক্লাসে একদিন একটা কী লিখতে দিয়েছেন, সেটা পরীক্ষার জন্য জরুরী, তাই সবাই খুব হাত চালিয়ে লিখছে, এমন সময় উনি বললেন, “একটা হোমওয়ার্ক দিচ্ছি – লিখে নাও – রচনা লিখবে Discipline is a Continuous Process.”
তখন তেড়ে লিখছি, তাই ওই পাতার ওপরেই চট করে নোট করে নিলাম, তারপরে নজর দিলাম লেখায়।
লেখা শেষ করে খাতা জমা দিয়েছি। কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে নিজের মতো নিজের জায়গায় বসে কী অকাজ করছি – আর খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হলো, ক্লাসের সামনে কিসের যেন একটা গোলমাল হচ্ছে, আর তার মধ্যমণি আমাদের ইংরিজি শিক্ষক, অবতার স্যার।
তাকিয়ে দেখি স্যার, যাকে বলে frothing at the mouth, এবং চারিদিকে ছাত্ররা যারা খাতা জমা দিতে গেছে, তারা সব আমার দিকে তাকিয়ে, তাদের সবার মুখ, বাচস্পতি হলে বলতেন, চাপা হাসিতে ফুসকায়িত।
স্যার-ও আমার দিকে তাকিয়ে। রোষকষায়িত নেত্রে আমার খাতা ফেরত দিয়ে বললেন, “এই ইংরিজি শিখেছ এতদিনে? এগারো বছর এই ইশকুলে পড়ে এই তোমার দুর্দশা?”
আমি অবাক হয়ে খাতা হাতে নিয়ে দেখি, ক্লাস-ওয়ার্কে কিছুই কারেকশন নেই, কিন্তু পাতার ওপরে, মার্জিনের বাইরে যেখানে আমি হোমওয়ার্কটা লিখেছিলাম, Dspln s a cntns prcs, সেখানে মোটা মোটা করে বানান শুদ্ধ করা। ততক্ষণে স্যার এসে গেছেন আমার বসার জায়গার কাছেই, চিৎকার করে বকছেন, একটা বানানও ঠিক করে লিখতে পারি না বলে – a বানানটাই বা ঠিক করলাম কেন? ওটাও ভুল লিখলাম না কেন?
আমি থতমত এবং ভ্যাবাচ্যাকা, দুই-ই। প্রথমত, যদিও ওই পাতাতেই ছিল, ওটা তো স্যারের দেখার কথা ছিল না। তাছাড়া, এত দিন ধরে আমাকে পড়িয়ে, সপ্তাহে চারটে করে আমার খাতা কারেকশন করে স্যার এই বুঝেছেন, যে আমি ডিসিপ্লিন, কন্টিনিউয়াস এবং প্রোসেস বানান জানি না?
সে কথা বলা যায় না, তাই বললাম, “না, মানে এটা তো শর্ট হ্যান্ডের প্রিনসিপ্ল্ অবলম্বনে লেখা…”
অগ্নিতে ঘৃতাহূতি। “শর্ট হ্যান্ড লিখছ? শর্ট হ্যান্ড লিখছ তুমি ইংরিজি ক্লাসে…” দিয়ে শুরু করে (অবশ্য শর্ট হ্যান্ড তো ইংরিজিতেই লেখা শিখেছি। স্প্যানিশ, পোর্তুগিজ বা বাংলায় নয় কিন্তু সে কথা কে বোঝাবে?) “তোমাদের এই বিখ্যাত স্কুলের এম.এ. (অক্সন) প্রিনসিপ্যাল…” (আমাদের প্রিনসিপ্যাল সত্যিই অক্সফোর্ড থেকে ইংরিজিতে এম.এ. পাশ, সে কথা আমাদের প্রায়ই শুনতে হত – অনেকটা তোমার বাবা (বা দাদা) পড়াশোনায় এত ভালো কিন্তু তুমি এত অগা কেন স্টাইলে। শুধু তাই না, এই অবতার স্যারের সেটা নিয়ে একটা চিপ্ অন দ্য শোল্ডার টাইপ ছিল। কথায় কথায় শোনাতেন – এর একবছর পরে উনি আমাদের টেক্সট বইয়ে শেক্সপিয়র, বা মিল্টন, বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কোনও একটা কবিতায় একটা বিরাট ছাপার ভুল ধরে ফেলেছিলেন, যে কবিতা আমাদের প্রিনসিপ্যাল তার আগেই আমাদের পড়িয়ে দিয়েছিলেন ছাপার-ভুল সহ – ফলে প্রিনসিপ্যালকে আবার সব ক্লাসে গিয়ে নতুন করে পড়াতে হয়েছিল, তারপর থেকে তো পায়া-ভারি হয়ে মাটিতে পা পড়ত না – মিক্সড মেটাফর, কিন্তু তাতে কী, শেক্সপিয়র পারেন আমি পারি না?), ইত্যাদি।
অবতার স্যার আমাকে পছন্দ করতেন না। আমি জানতাম না সেটা, পরে বুঝেছিলাম, যখন প্রি-টেস্টে ইংরিজিতে চল্লিশের কোঠায় নম্বর পেয়েছি বলে গার্জেন কল করে মা-কে বলার চেষ্টা করেছিলেন, আমি যদি ইংরিজি টিউশন না নিই, তাহলে মাধ্যমিকে পাশ করার সম্ভাবনা অত্যল্প খুব। তখন নানা কথার মধ্যে বলেছিলেন, আমি নাকি মিচ্কে শয়তান। মা খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। নানা লোককে জিজ্ঞেস করেছিল মিচ্কে শয়তান মানে কী (এবং সে শুনে আমি হেসে গড়াগড়ি দিয়েছি কেন)! (অবশ্য তার অনেক পরে আমার বয়স যখন চল্লিশের কোঠায়, তখন এই উপাধী ফিরে এসেছিল আমার জীবনে। কোনও এক লরেটো স্কুলের প্রিনসিপ্যাল বলেছিলেন, “ইউ আর, হোয়াট উই কল ইন বেঙ্গলি, আ মিচ্কে শয়তান।” এবারেও আমি হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। এত বছরের ব্যবধানে, দুই জেনারেশনের দুজন শিক্ষক আমাকে একই উপাধী দিয়েছেন বলে।) পছন্দ করতেন না বলে বকতেনও বেশি। শেষ বকেছিলেন টেস্ট পরীক্ষার নম্বর বলতে গিয়ে। যখন দেখলেন ষাট পেয়েছি, তখন তো আর সুযোগ পাবেন না, তাই একটা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় কারণে বকে দিয়েছিলেন খুব জোরে।
তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে কয়েক দশক পরে একহাত নিতে পেরেছিলাম আর একজনকে।
শঙ্খ তখন কমান্ড মোবাইল কম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট। মোবাইল কম্পানিরা তখন ছোটো লিখিত বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করে চতুর্দিক হোর্ডিঙে ভরিয়ে দিয়েছে – এই আমাদের শর্ট মেসেজ সার্ভিস, ছোটো করে বলতে গেলে এস.এম.এস. – তিরিশটি “ক্যারেকটারে” একটা মেসেজ, ফলে এস.এম.এস. করতে শিখিয়ে চারিদিকে দেখছি লেখা আছে – “R u cmng?” “Hw fr r u?” ইত্যাদি।
শঙ্খকে লিখলাম, “Dspln s a cntns prcs নিয়ে যখন বকুনি খেয়েছিলাম, তখন খুব হ্যা হ্যা করে হেসেছিলি। এখন শালা লাখ লাখ টাকা খরচা করে হোর্ডিঙে হোর্ডিঙে চারিদিক ছেয়ে ফেলেছিস, কেমন?”
শঙ্খ লিখল, “আমি তখনই জানতাম, দ্যাট ইউ ওয়্যার বর্ন মাচ বিফোর ইওর টাইম।”
আমি আর ঘাঁটালাম না। পাছে তারপরে লেখে – লাইক মহম্মদ বিন তুঘলক!