নির্বাচনী বন্ড নিয়ে তুমুল হইচইয়ের মধ্যে একটা কথা অনেকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে — রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে টাকা ঢালা শিল্প সংস্থাগুলোর মধ্যে একাধিক ঔষধি নির্মাতা সংস্থার উপস্থিতি, এবং এক্ষেত্রে সার্বিক ভাবে গোটা ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর বা ঔষধি ক্ষেত্রের স্থান একেবারে সামনের সারিতে। অন্য অনেক শিল্পের ক্ষেত্রে যেমন অজ্ঞাতকুলশীল কিছু সংস্থাও চমকপ্রদ পরিমাণে বন্ড কিনেছে, ঔষধি শিল্পের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। দেশের সর্ববৃহৎ ফার্মা কম্পানি বলতে যেগুলোকে ধরা হয়— শেয়ার বাজারের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা যে সব ঔষধি সংস্থার শেয়ারকে নিরাপদ বিনিয়োগ বলে মনে করেন— নির্বাচনী বন্ড কেনার তালিকায় মোটামুটি সেই সংস্থাগুলিরই ভিড়। ওষুধ-কম্পানির মধ্যে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডক্টর রেড্ডিজ়, দ্বিতীয় স্থানে টরেন্ট ফার্মা, তিনে ন্যাটকো ফার্মা। এ ছাড়া তালিকার প্রথম দশের মধ্যে সান ফার্মা, অরবিন্দ ফার্মা, অজন্তা ফার্মা, ডিভিস ল্যাব, সিপলা, জ়াইডাস ইত্যাদি সকলেই রয়েছে। মোট ৩৫টি ফার্মা সংস্থা নির্বাচনী বন্ড কিনেছে, মোট খরচ করেছে ৭৯৯.৬৬ কোটি টাকা। এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নকল্পে যত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, এই নির্বাচনী চাঁদার পরিমাণ তার অর্ধেকের বেশি।
ওষুধের ব্যবসার ক্ষেত্রে — বিশেষত অতিবৃহৎ ওষুধ-সংস্থার ক্ষেত্রে — লাভ-ক্ষতির অঙ্কের একটি বড় অংশ নির্ভর করে বিদেশে, বিশেষত পশ্চিমি দেশে ওষুধ রফতানির উপরে। কেননা, এ সব সংস্থার ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে বাজারটি মোটামুটি সুরক্ষিত এবং সেই বাজারে অংশীদারত্ব মোটামুটি স্থির— বিদেশে ব্যবসা প্রসারিত করা গেলে নতুন করে মুনাফা বাড়ে। খেয়াল করে দেখবেন, এধরনের কম্পানির ক্ষেত্রে আমেরিকার নজরদারি সংস্থা ইউএসএফডিএ কারখানা পরিদর্শনে এসে কিছু খুঁত খুঁজে পেলেই হইচই পড়ে যায়, সংস্থার শেয়ারমূল্যেও ধস নামে। দেশি নজরদারি সংস্থা কিছু আছে বটে, কিন্তু তাঁরা বড় সংস্থার কারখানায় গিয়ে ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে নজরদারি করেছে, বা কোনও প্রশ্ন তুলেছে বলে সচরাচর শোনা যায় না – বা, করলেও তাতে কম্পানি খুব বিচলিত হয়, এমন খবর নেই। সে ক্ষেত্রে দেশীয় নজরদারি সংস্থাকে তুষ্ট করতে নির্বাচনী বন্ড কিনতে হবে, এমন সম্ভাবনা নিতান্তই কম। আর, এ দেশে বন্ড কিনে ইউএসএফডিএ-র মতো আমেরিকার সংস্থাকে তুষ্ট করা যাবে, তেমনটিও ভাবা মুশকিল। তা হলে বন্ড কিনতে হল কেন?
ঠিক কারণটা কী, সে প্রশ্নের উত্তর এই সব সংস্থার কর্ণধাররাই দিতে পারবেন। একটা সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই — ওষুধের দাম বাড়ানোর ছাড়পত্র পাওয়া এই সংস্থাগুলোর কাছে জরুরি। ২০১৩ সালের ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডার অনুসারে, গত অর্থবর্ষের পাইকারি মূল্যসূচকের স্ফীতি বা হ্রাসের উপর নির্ভর করে শিডিউলড বা তফসিলভুক্ত ওষুধের দাম বাড়ে-কমে। সাধারণ দোকান থেকে যাঁদেরই নিয়মিত ওষুধ কিনতে হয়, তাঁরা জানবেন যে, সাম্প্রতিক কালে বহু জীবনদায়ী ওষুধের দাম চড়চড় করে বেড়েছে। এ মাসের ১২ তারিখ কেন্দ্রীয় সরকার নোটিফিকেশন জারি করে জানিয়েছে যে, ওষুধ এবং চিকিৎসা সামগ্রীর মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতির সংস্কারের জন্য নতুন কমিটি গঠন করা হবে। সে জল কোন দিকে গড়াবে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা যাবে না, এ কথা বুক ঠুকে বলা মুশকিল নয় কি? বন্ডের জন্য যে টাকা খরচ হল, সেটা ওষুধের বর্ধিত মূল্যের মাধ্যমে তুলে নেওয়া হবে, এই আশঙ্কা তো একেবারেই অমূলক নয়।
খরচ অবশ্য শুধু রাজনৈতিক দলের চাঁদা দিতেই হয় না। ডাক্তারদের পোষণ করতেও হয়। সরাসরি নগদ বা বহুমূল্য উপহারের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। ওষুধ কম্পানিগুলো যখন ডাক্তারদের সেমিনার স্পনসর করে, তখন তার প্রত্যাশাটুকু সহজেই অনুমান করা যায়— সেই বাড়তি খরচ তারা ডাক্তারবাবুদের কাছ থেকে বাড়তি প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে পুষিয়ে নিতে পারবে। ডাক্তারবাবুরা বাকি ব্র্যান্ড ছেড়ে তাদের ব্র্যান্ড লিখবেন বা কাছাকাছি আর একটি ওষুধ ছেড়ে নতুন ওষুধটি লিখবেন, প্রত্যাশা বলতে এ-ই। খরচ হলেও মুনাফা কোন পথে আসবে, সেটি বোঝা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পেছনে বিনিয়োগ করলে সেই বিনিয়োগের রিটার্ন কোন পথে আসবে? হয়ত তার উত্তর রয়েছে ইউনিফর্ম কোড অব ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং প্র্যাকটিস’-এ। ডাক্তারদের তুষ্ট করার জন্য ওষুধ সংস্থাগুলি যে সব খরচ করে, তার অনেকগুলিই এই বিধি বাধ্যতামূলক হলে নিষিদ্ধ হবে। দিনকয়েক আগে, ফার্মা সংস্থাগুলির নির্বাচনী বন্ড কেনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, এক সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, এই বিধি এখন আর ঐচ্ছিক নয়, সব সংস্থার জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু, সেটা কবে হল, কী ভাবে হল, কোনও সংস্থা তা না-মানায় আজ অবধি জরিমানা দিল কি না, কিছুই এখনও জানা নেই।
ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি চারিদিকে পয়সা ছেটাতে থাকলে শেষমেশ সেই বাড়তি খরচের দায়ভার বহন করেন ক্রেতা, কেননা এই বাড়তি খরচটা যুক্ত হয় ওষুধের বিক্রয়মূল্যে। সরাসরি বা বিভিন্ন ‘শিক্ষামূলক আলোচনাসভা’-য় অংশগ্রহণের জন্য স্পনসর করার মাধ্যমে বা আর পাঁচটা উপায়ে ডাক্তারদের উৎকোচপ্রদানই হোক বা রাজনৈতিক দলকে তুষ্ট করতে নির্বাচনী বন্ড ক্রয়, সংস্থা যেটুকু যা খরচা করে, তা সুদে-আসলে পুষিয়ে নেয় ওষুধের দাম বাড়িয়ে – কেননা সেটাই তার ব্যবসা। অর্থ বিভিন্ন দিকে ছড়ালেও ফেরতের পথ একটিই – রোগীর পকেট। ওষুধ-ব্যবসার এই রোগ সারবে কোন উপায়ে, কে জানে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৫শে মার্চ, ২০২৪ প্রকাশিত।