হাফসোল কথাটার মানে ওরা দু’জনের কেউই জানত না। জানার কথাও না। তমাল পরত হাওয়াই চটি। রনে বনে জঙ্গলে। সর্বত্র। আর অম্বার পায়ে? স্টিলেটো, কিম্বা পেন্সিল হিল নানা রকম। মোটমাট জুতোয় থাকা সোল বস্তুটা চিনত না ওরা।
★
বারাসতের উপকণ্ঠে এক স্টেট ইউনিভার্সিটি রয়েছে। সে’খানেই পড়ত ফিজিক্সের তমাল বরুয়া। আর অম্বা বসুর ডিপার্টমেন্ট ছিল ইংরেজি।
তমাল আসত সাইকেলে, নইলে ডিএন এইট বাই ওয়ান বাসে করে। অম্বাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির শোফার ড্রিভন কার অন্য কাজে চলে যায়। বর্ণনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই এই দু’জনের দেখা হবারই কথা না। কিন্তু হয়েছিল।
★
পাথরের সঙ্গে যেমন দেখা হয় বৃষ্টিফোঁটার।
কিম্বা মরুপথিকের সঙ্গে মরুদ্যান মতান্তরে মরীচিকার
কাব্য করে বললে এই রকমের বলা যেতে পারত।
কিন্তু জীবন তো আর কাব্যিক নয় ততটা। অবিশ্যি সে’দিন বৃষ্টিরই দিন ছিল। বলতে কী আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর মুখটায় যে চায়ের দোকানটা, শুধুমাত্র চায়েরই ঠিক না, রুটি আর ঝাল আলুভাজাও পাওয়া যায়, বৃষ্টির প্রবল তোড়ে সাইকেল নিয়ে বেরোতে না পেরে, বাধ্য হয়ে সে’খানে বসেছিল তমাল।
অম্বার সে’খানে ঢোকার কথাই না। তার বাড়ির গাড়ি এসে তাকে তুলবে। মায়ের সঙ্গে তার আজ শপিংয়ে যাবার কথা। হয় সিসি টু কিম্বা সেখানে পছন্দ না হলে গড়িয়াহাট। খুব তাড়া। তাই ও ভেবেছিল এগিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। যতটা সময় কমানো যায়।
এমন সময়ে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টিটা নামল। ও দৌড়ে গিয়ে দোকানে ঢুকবে এমন সময় মায়ের ফোন ঢুকল। গাড়ির টায়ার পাংচার। বড় রাস্তায়। এই ঘন বৃষ্টিতে নেমে টায়ার চেঞ্জের প্রশ্নই নেই। বৃষ্টি থামলে দেখা যাবে।
★
এই হঠাৎ নামা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ুতে গিয়ে, ওই পেনসিল হিলের কন্যা অসমান রাস্তায় পা মুচড়ে পড়ল। পা তো মচকালোই সাধের পেনসিল হিল জুতো থেকে বিযুক্ত হল। ফিতে টিতেও ছিঁড়ল। প্রবল ব্যথা সামলে কোনওক্রমে উঠে দাঁড়ালেও কন্যা চলতে সক্ষম হল না। দুই পায়ের দুই রকম উচ্চতার কারণে। বিরক্তির একশেষ। বিরক্তি আরও বাড়ল দোকানের মালিক ইয়াকুবের অযাচিত মন্তব্যে, – ভাগ্যি ভালো, জুতা ভাঙিসে! এই রকমের কেসে, পায়ের হাড় ভেঙি দুই টুকরা হতি দেখিসি কত! বসেন, ইখানে বসেন!
কন্যা কোনও রকমে রাগ সামলে জিজ্ঞেস করে, – এ’খানে মুচি পাওয়া যায়? বসে, আশে পাশে?
– মুচি? হ্যাঁ, গেরামের মদ্যি একটা আচে বটে। কিন্তু তারা হাতুড়ে। আপনার এই বিলিতি জুতো সারাতি বড় ডাক্তার লাগবে বোধ হচ্চে। কিন্তুক পোশ্নো হচ্চে, আপনি যাবেন কেমনে?
সত্যিই তো!
তমাল এই নাটকের খণ্ড দৃশ্যে বিপত্তারণ হয়ে আসরে নামে। – ও কোনও ব্যাপার না। আপনি আমার হাওয়াই চটিটা পড়ে যাবেন। আমি তো সাইকেল। ম্যানেজ করে নেব!
ও আপনি করে বললেও আধুনিকা অম্বা সরাসরি তুই করেই বলে একই ইয়ারের তমালকে, – তারপর তোকে ফেরত দেব কী করে?
তমাল তো তো করে বলে, – অসুবিধে হলে দরকার নেই। ভাববেন ইউজ অ্যান্ড থ্রো!
★
সেই শুরু। আলাপের। অম্বা দ্রুত বুঝে যায় এই ছেলেটি পায়ে হাওয়াই চটি হলেও গ্রে ম্যাটারে সরেস। বাজিয়ে দেখা যেতে পারে।
এরপরে নিয়ম মেনেই তাদের দেখা হতে থাকে। দেখা হবার জায়গা কিন্তু অম্বাই ঠিক করে।
আর মজার ব্যাপার হল নির্দেশ জানিয়ে দেয় ফোনে বা হোয়াটস্যাপে। কোনওদিনই বাড়ির গাড়িতে আসে না সেই সব অ্যাপোর জায়গায়। আসে অটোয় নইলে টোটোয় নইলে অন্য কোনও ভাবে।
★
তমাল অম্বাকে বলত, – তোমাকে পেয়ে জানো তো অম্বা আমি যেন নতুন একটা পৃথিবী পেয়ে গেছি। এর পরে যখন, ফিজিক্সের ইকোয়েশনগুলো লিখব, প্রত্যেকটায় ধ্রুবক হয়ে থাকবে তুমি।
অম্বা ওকে বলত…।
কী বলত? থাক সে’সব কথা। এই একই কথা যুগযুগান্ত ধরে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা হয়ে চলেছে।
★
একটু আগে বললাম বটে গাড়িতে আসত না। এসেছিল। একদিন। অম্বার পছন্দ করে বেছে দেওয়া সঙ্কেত হাতে নিয়ে। চেনা মানুষের আবার হাতে সঙ্কেত কেন? তমাল জিজ্ঞেস করেছিল।
অম্বা খুব মায়াবী গলায় বলল, – জানো, আমার খুব ইচ্ছে করে সেই কবেকার লোধ্ররেণু মাখা অভিসারিকার মত তোমাকে খুঁজে বার করব। সঙ্কেত দেখে চিনতে পারব আমার অদেখা নায়ককে।
সেইদিন তমাল অম্বার বলে দেওয়া জায়গায় এসে দেখে, আরও গোটা চারেক মক্কেল ওরই মত হাতে নীল রুমাল, দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
একটু অবাকই হল।
এই এতজনের একই সঙ্কেত?
অম্বা এল কিছুক্ষণ বাদে। গাড়ি করে। সঙ্গে আরও একজন। ক্লিন শেভড। টল, হ্যান্ডসাম।
অম্বা নীল রুমাল হাতে থাকা সব ক’জনকে বলল, – হাই, এ’ হচ্ছে অনুভব মিত্র। গ্রিন কার্ড হোল্ডার। ও দেশে ফিরতে দেরি করছিল বলে, ওরই অ্যাডভাইসে, তোমাদের সবার সঙ্গে ডেটিং করে ডিপ্রেশন কাটাচ্ছিলাম। ওরই অ্যাডভাইসে। ও ও’খানে মস্ত সাইকিয়াট্রিস্ট। নেক্সট উইকে আমাদের বিয়ে।
★
এই রকমের ঘটনাকে কেন কে জানে সাঁটে বলা হয় হাফসোল খাওয়া।
অন্যদের কথা জানি না। তমালের কিন্তু লাভ হয়েছিল এই হাফসোলে।
ফিজিক্সের ইকোয়েশনে ধ্রুবক বসায় লেখাপড়ার কার্ভ নীচের দিকে গেছিল। ধ্রুবক সরে যেতেই আবার ঊর্ধ্বমুখী। উপরন্তু লাভ, ওই দিনই সুদৃশ্য প্যাকেটে ফেরত পেল হাওয়াই চপ্পলটি।
★
কুড়ি বছর বাদের একটা সম্ভাব্য বিবৃতি,
আজও প্রফেসর টি বরুয়ার আলমারিতে তাঁর সম্মাননার নানান স্মারকের মাঝে যত্নে সাজিয়ে রাখা আছে সেই হাওয়াই চপ্পল মানে হাফসোলটি।
★