১১ বছরেরও বেশী সময় আগেকার এই লেখা। আলোচ্য বিষয়গুলো এখনও প্রাসঙ্গিক, তাই পুনঃপ্রকাশ।
২৭শে মে, ২০১২ অনেকগুলি টিভি চ্যানেলে এক সঙ্গে আমির খানের অনুষ্ঠান ‘সত্যমেব জয়তে’ প্রচারিত হওয়ার পর চিকিৎসকদের একাংশ আমিরের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছেন। স্ত্রী-ভ্রূণ হত্যা, পণপ্রথা বা শিশুদের যৌন-শোষণের বিরোধিতা পর— আমির খান এবার প্রশ্ন তুলেছেন—‘Does Healthcare Need Healing?’— চিকিৎসা ব্যবস্থারই কি চিকিৎসা দরকার? আক্রমণের বর্শামুখ এবার চিকিৎসকদের দুর্নীতির দিকে।
অনেকে বলছেন আমির কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তারদের আক্রমণ করেছেন এমন নয়, সত্যমেব জয়তে সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসককুলকেই অপমান করেছে। ইন্ডিয়ান মেডিকাল এসোসিয়েশন ২রা জুন দাবী করেছে—চিকিৎসকদের দুর্নাম রটানোর জন্য আমির খানকে ক্ষমা চাইতে হবে, না হলে আইনের আশ্রয় নেবে তারা।
আবার অনেকের বক্তব্য— আইএমএ কি বলল তাতে কিছু আসে যায় না, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার ডাক্তারদের এক-তৃতীয়াংশেরও কম সংখ্যক ভারতীয় ডাক্তার আইএমএ-র সদস্য, আইএমএ সব ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্ব করে না।
সাধারণ মানুষ কিন্তু এই অনুষ্ঠানটাকে একই চোখে দেখেননি। তাঁরা বরং অনুষ্ঠানে বর্ণিত ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন নিজেদের জীবনের চিকিৎসা-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে। অনেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা মিলে গেছে।
আসলে চিকিৎসকের পেশাটা অন্যরকম। এখানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে পারেন একজন পেশাদার। রোগীর রোগ-নির্ণয় করতে পারেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগ সারাতে পারেন, না পারলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর কষ্ট কমাতে পারেন। ডাক্তারদের সাধারণ মানুষ ভগবানের আসনে বসান তাই যুগ-যুগান্ত ধরে। (যদিও ভগবান আছেন কিনা, বা থাকলেও তিনি মানুষের ভাল করেন কিনা, সে প্রশ্ন একেবারে স্বতন্ত্র।)। ভগবানের পদস্খলন কি মেনে নেওয়া যায়!
চিকিৎসাকে যদি পণ্য হিসেবে দেখেন তাহলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে এ পণ্যের ফারাক আছে। দোকানে গিয়ে কোন ব্র্যান্ডের গায়ে মাখার সাবান বা টুথপেস্ট কিনবেন তা আপনি নিজে ঠিক করেন, কিন্তু চিকিৎসা করাতে গিয়ে আপনি কোন কোন পরীক্ষা করাবেন বা কোন কোন ওষুধ খাবেন তা আপনার হয়ে ঠিক করে দেন অন্য কেউ—আপনার চিকিৎসক। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাই মুশকিল।
একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি জোরের সঙ্গেই বলবো— সত্যমেব জয়তে-তে যেসব দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, সেরকম হয়। যে সমাজব্যবস্থায় সাংসদ বা বিধায়ক হওয়ার পর অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা কোটিপতি হয়ে যান, যেখানে উৎকোচ দিয়ে বিচারের রায়কে প্রভাবিত করা যায়, পুলিশ যেখানে পয়সার বশ, যেখানে ঘুষ না দিলে সরকারী দপ্তরের ফাইল নড়ে না, সেখানে ডাক্তাররাই কেবল দুর্নীতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলবেন—এমনটা ভাবা অযৌক্তিক। ডাক্তারী পড়তে যাঁরা ভর্তি হন, মেধা-তালিকায় তাঁরা থাকেন প্রথম দিকে (অবশ্য ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে বেসরকারী মেডিকাল কলেজে যাঁরা ভর্তি হন, তাঁদের কথা বলছি না), তা ছাড়া তাঁরাতো এই সমাজেই উদ্ভূত, সমাজের অন্য পেশার মানুষদের মতোই দোষ-গুণে ভরা মানুষ তাঁরা।
যদিও ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, চিকিৎসা পেশার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের জন্য এই পেশার মানুষদের অন্যরকম হওয়া উচিত। মহান শল্যচিকিৎসক ডা নর্মান বেথুন যেমন বলেছিলেন তেমন হওয়া উচিত তাঁদের পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি– The function of medicine is greater than the maintenance of the doctor’s position; the security of the people’s health is our primary duty; we are the servants not the masters of the people, human rights are above professional privileges. কিন্তু বাস্তবে এ দৃষ্টিভঙ্গি কজনের দেখা যায়?!
ডাক্তারী পাস করার পর মেডিকাল কাউন্সিলে নথিভুক্ত হওয়ার সময় ডাক্তারদের নীতি-নৈতিকতার শপথ নিতে হয়, সে শপথ আধুনিক চিকিৎসা-বিদ্যার জনক হিপোক্রেটিসের নামে নামাঙ্কিত। ডাক্তাররা যদি অন্তত সে শপথ মেনে চলতেন বা চলতে পারতেন তাহলেও সমস্যা হত না।
সত্যমেব জয়তে-তে আমির খান যে ঘটনাগুলো দেখিয়েছেন সেগুলোর দিকে নজর ফেরানো যাক।
- একজন ডায়াবেটিস রোগীকে দেখানো হয়েছে, যাঁর পায়ের এক ঘায়ের জন্য একজন ডাক্তার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেন, পায়ের একটা আঙ্গুল কেটে বাদ দেওয়া হয়। পরে আরেকজন ডাক্তার তাঁকে বলেন তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিক দিলেই হত, আঙ্গুল কাটার দরকার ছিল না। চিকিৎসা-বিজ্ঞান সমন্ধে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে তাঁরা ভাল করেই জানেন যে হাতের আঙ্গুল-পায়ের আঙ্গুল, এমনকি হাত-পা কেটে বাদ দিতে হতে পারে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে জীবাণু-সংক্রমণকে প্রতিহত করার জন্যই।
- মেজর পঙ্কজ রাই ও তাঁর মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছে। মেজর রাই-এর স্ত্রী কিডনী ও অগ্ন্যাশয় প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে মারা যান। আমির খানের এই অনুষ্ঠানের বিরোধীরা ব্যঙ্গ করছেন যে টি ভি-র পর্দায় মেজর রাই নাটক করেছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। কিন্তু তাঁর সাক্ষাৎকারে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়— মৃতদেহ থেকে কিডনী ও অগ্ন্যাশয় নিয়ে শ্রীমতী রাই-এর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, এ সব ক্ষেত্রে সব সময়ই অনুমতি নিয়ে রাখা হয় অনেক আগে থেকেই, সুতরাং অনুমতি না নিয়ে শ্রীমতী রাই-এর অপারেশন করা হয়েছিল এমনটা হতে পারে না। শ্রীমতী রাইকে যত বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল বলা হয়েছে সে হিসেব মিলছে না চিকিৎসক দলের নেফ্রোলজিস্টের হিসেবের সঙ্গে। নেফ্রোলজিস্টের কথা অনুযায়ী শ্রীমতী রাই-এর DIC (disseminated intravascular coagulation) হয়েছিল। কার এই সমস্যা হবে তা আগে থেকে বোঝা বা বলা যায় না আর এমনটা হলে রক্ত-সঞ্চালন ছাড়া চিকিৎসা নেই তেমন কিছু।
- অন্ধ্রপ্রদেশের এক গ্রামাঞ্চলের কাহিনী দেখানো হয়েছে, যেখানকার অধিকাংশ মহিলাকে নাকি অপ্রয়োজনে জরায়ুকর্তন করা হয়েছে। সমস্ত জরায়ুকর্তন (hysterectomy) –ই প্রয়োজনীয় এমনটা বলা যায় না, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে জরায়ুকর্তন প্রথম পছন্দের চিকিৎসা না হলেও তা করতে হয় উন্নততর চিকিৎসা-পদ্ধতির সুযোগ বা ব্যবস্থা না থাকায়। রোগী নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নিয়ে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেছেন, না হলে ডাক্তার অপারেশনের সুযোগ পাবেন কেমন করে। আমির যে মহিলাদের দেখিয়েছেন, তাঁরা ডাক্তারের কাছে কোন সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের রেকর্ডে কোন রোগের জন্য অপারেশনের কথা বলা আছে সে সব পরিষ্কার হয়নি আমিরের অনুষ্ঠানে।
- একজন প্যাথোলজিস্ট কমিশন প্রথা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কেবল প্যাথোলজি পরীক্ষাতেই নয়, সমস্ত ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই ব্যাপক ভাবে কমিশন চলে। প্যাথোলজিতে ৫০% অবধি, আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ২৫%, সিটি স্ক্যানে ৩৩%, এক্স-রেতে প্লেট-পিছু প্রায় ২০-২৫ টাকা পাওয়া যেতে পারে কমিশন হিসেবে। অনেক ডাক্তার কমিশন নেন এটা যেমন সত্যি, তেমনই অনেকে কমিশন নেন না, ল্যাবরেটরীকে বাধ্য করেন রোগীর খরচ থেকে কমিশনের অংশটা বাদ দিতে—সে কথাটাও সত্যি, সে কথা বলা হয়নি আমির খানের অনুষ্ঠানে।
- একজন অতি-বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসককে দেখানো হয়, যিনি রেফারিং ডাক্তারদের কমিশন দিতে নারাজ হয়ে বিদেশে ফিরে যান। রেফারিং ডাক্তাররা কেউ কেউ কমিশন চান এমনটা ঘটনা, কিন্তু এটাও ঘটনা যে বিশাল সংখ্যক ডাক্তার কিন্তু পরস্পরের কাছ থেকে কমিশন না নিয়ে-না দিয়ে এ দেশেই ডাক্তারী করে চলেছেন।
- আমির খানের টক-শোতে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা-চিকিৎসক যিনি মেডিকাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন, মেডিকাল কাউন্সিলের নানা দুর্নীতি নিয়ে, বিশেষত প্রাইভেট মেডিকাল কলেজগুলোকে অনুমোদন-সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে বলেছেন। খবরের কাগজ পড়ে আগে থেকেই আমরা জানি যে এমন দুর্নীতি করতে গিয়ে এমসিআই-এর পূর্বতন প্রধান দন্ডিত।
- এমসিআই-এর স্থান নেওয়া বর্তমান কমিটির প্রধানও আমিরের প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকদের দুর্নীতি ও দুর্নীতি-দমনে এমসিআই-এর নিষ্ক্রিয়তার কথা স্বীকার করেছেন।
- MIMS (মান্থলি ইন্ডেক্স অফ মেডিকাল স্পেশালিটি)-র সম্পাদক ডা চন্দ্র মোহন গুলাটি ভারতের ওষুধ-কোম্পানীগুলোর দুর্নীতি, নিজ কোম্পানীর ওষুধ লেখাতে ডাক্তারদের যে ঘুষ দেওয়া হয়—সেসবের কথা বলেছেন। ভারতে ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের আন্দোলনে এক পুরোধা পুরুষ ডা গুলাটি। তাঁর বক্তব্যে কিন্তু এ বিষয়ে সরকারী নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারে আরও সরব হওয়া উচিত ছিল।
অনুষ্ঠানের শেষপর্বে আমির খান সমস্যার সমাধান হিসেবে কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন—
- রাজস্থানের এক চিকিৎসক আইএএস-এর কথা আমরা আগেই জানতাম। তিনি এক জেলার জেলা-শাসক থাকার সময় সরকারী উদ্যোগে জেনেরিক নামের ওষুধের দোকান খুলেছিলেন। তামিলনাড়ুতেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯ শে জুন এক সংসদীয় কমিটির আহ্বানে গিয়ে আমির খান সারা দেশে জেনেরিক নামের ওষুধের দোকান খোলার প্রস্তাব দিয়েছেন।
- আমির খানের আরেক সমাধান চিকিৎসাবীমা। নারায়ণ হৃদয়ালয় ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে দক্ষিণের কোনো কোনো রাজ্যে চিকিৎসা-বীমা চালু করা হয়েছে। এক শিশু হৃৎরোগী কন্যার কাহিনী শুনিয়ে আমির সেই চিকিৎসা বীমা ব্যবস্থার গুণগান গেয়েছেন। ডা শেঠি নিঃসন্দেহে এক দক্ষ-উদ্যমী হৃৎ-শল্যচিকিৎসক। এমসিআই-এর স্থান নিয়েছে যে কমিটি সেই কমিটির অন্যতম সদস্যও তিনি। একই সাথে তিনি এক সফল চিকিৎসা-ব্যবসায়ী, প্যারামেডিকাল শিক্ষা (ভবিষ্যতে হয়ত মেডিকাল শিক্ষা)-ব্যবসায়ী। তাঁর হাসপাতালে চিকিৎসার মান বেশ ভালো, চিকিৎসার খরচ কম কিছু নয়, অনেক রোগীর কাছ থেকে মুনাফা করার পর মাঝে-সাঝে একটা- দুটো অপারেশন তাঁরা কম খরচে বা বিনা খরচে করেন। তবে ডা শেঠির নাম-মাহাত্ম্য এমনই যে সেই একটা-দুটোই সংবাদ-মাধ্যমে প্রচার পায়। পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের সরকারের সাথে প্রাইভেট-পাব্লিক পার্টনারশিপে শীঘ্রই আমরা তাঁকে নতুন ভূমিকায় দেখব, যেখানে সরকারী জমিতে, সরকারী পরিকাঠামোয় হাসপাতাল বানিয়ে পরিষেবা দেবে, অবশ্যই মুনাফা করবে তাঁর সংস্থা।
আমিরের সমাধান সমাধান নয়—
সরকার ওষুধ-কোম্পানীগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর, বিদেশে নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ হওয়ার উপযুক্ত ওষুধ উৎপাদনে বাধা দেবে না, জেনেরিক নামের ওষুধ উৎপাদনে বাধ্য করবে না, অত্যাবশ্যক ওষুধ উৎপাদনে বাধ্য করবে না— অথচ আশা করা হবে চিকিৎসক জেনেরিক নাম (সঠিক শব্দটা হল— আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম বা INN—International Non-proprietary Name)-এ ওষুধ লিখবেন?!
সমাধানের রাস্তা দেখানো হয়েছিল কিন্তু আজ থেকে ৩৭ বছর আগে, যখন জয় শুকলাল হাথীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি ১৯৭৫-এ বাজারের প্রায় ৬০ হাজার ফর্মুলেশনের বদলে ১১৭ টা ওষুধকে দেশের জন্য অত্যাবশ্যক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, ওষুধ-কোম্পানীগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগের মাত্রা কমিয়ে এনে পরে কোম্পানীগুলোকে জাতীয়করণ করার সুপারিশ করেছিল।
আজ যদি ডাক্তার কেবল প্রয়োজনীয় ওষুধই লেখেন জেনেরিক নামে, তার অধিকাংশ দোকানে পাওয়া যাবে না। বেশীর ভাগ ওষুধ কোম্পানীর জেনেরিক ডিভিশন আজ যে সব ওষুধ তৈরী করে তাদেরও ব্র্যান্ড নাম আছে, এদের পোষাকী নাম ব্র্যান্ডেড জেনেরিক্স। জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে কোন ব্র্যান্ডের ওষুধ রোগী পাবেন তা নির্ভর করবে ওষুধের দোকানীর ওপর। যে ব্র্যান্ডে দোকানীর লাভ বেশী, সে ব্র্যান্ডই পাবেন রোগী। এর চেয়ে বরং ডাক্তার কমদামী ব্র্যান্ড লিখলে রোগীর খরচ কমবে।
আমির খানের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক জেনেরিক নামের ওষুধের বিরোধিতা করছেন। বর্তমান লেখকের প্রায় তিন দশকের চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য। গুণবত্তায় ও কার্যকারিতায় জেনেরিক নামের বা কমদামী ব্র্যান্ডের সঙ্গে দামী ব্র্যান্ডের কোনো ফারাক নেই। দামী কোম্পানীর দামী ওষুধের মোড়কে ছোট অক্ষরে লেখা (fine prints) দেখুন। দেখবেন সে ওষুধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৈরী হয়েছে (manufactured at) ছোট কোনো কোম্পানীতে, বাজারজাত করছে (marketed by) নামী-দামী কোম্পানী।
চিকিৎসা বীমা সমাধান নয়, চিকিৎসা-বীমার আঁতুড় ঘর আমেরিকায় কিন্তু সব নাগরিকের চিকিৎসার সুযোগ নেই।
আসল সমাধান অন্য পথে। যে দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থার ধাঁচে আমাদের দেশের আধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থার শুরু—সে দেশ গ্রেট ব্রিটেন সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়, অথচ সে দেশে ৪০-এর দশকের শেষ থেকে নাগরিকদের চিকিৎসা-পরিষেবা দিত জাতীয় স্বাস্থ্য প্রকল্প (National Health Scheme)। ডাক্তাররা সেখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিশ করতেন না, তাঁরা ছিলেন রাষ্ট্রের কর্মচারী। রোগী কোন প্রাথমিক চিকিৎসককে দেখাবেন তা নির্ভর করত কোন অঞ্চলে তিনি থাকেন তার ওপর, প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট প্রাথমিক চিকিৎসক থাকতেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছু করাতে হলে চিকিৎসক পাঠাতেন NHS-নির্দিষ্ট সংস্থায়, কোন এলাকার প্রাথমিক চিকিৎসক কোন বিশেষজ্ঞ বা অতি-বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন তাও NHS নির্দিষ্ট করা থাকত। ডাক্তাররা ওষুধ লিখতে পারতেন কেবল এক নির্দিষ্ট তালিকা থেকে, যার নাম BNF (British National Formulary), বছরে তার চারটে সংস্করণ বেরোয়, তার অন-লাইন সংস্করণ আছে, ছাপা বই তিন মাস ছাড়া ডাক্তারের কাছে পৌঁছে যায়। মার্গারেট থ্যাচারের সময় থেকে NHS-কে জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রয়াস চলতে থাকলেও এখনও তা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েনি।
এমন এক ব্যবস্থাই আসলে সমাধান। যেখানে ডাক্তার ও রোগীর মাঝে লেন-দেনের সম্পর্ক থাকবে না, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের স্বাস্থ্য-রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব নেবে, এমন এক ব্যবস্থাই আসলে দুর্নীতি-মুক্ত হতে পারে।
রাষ্ট্র চিকিৎসা-পরিষেবা থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের মৃগয়া-ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে চিকিৎসা পরিষেবা— সে বিষয়ে নীরব থেকে কেবল চিকিৎসকদের ঘাড়ে সব দোষ চাপানো সমীচীন নয়। তবু আমির খানকে ধন্যবাদ জানাবো এক জ্বলন্ত সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য, তা তিনি ‘সত্যমেব জয়তে’-র এপিসোড-পিছু যত কোটি টাকাই পেয়ে থাকুন না কেন।