পয়লা বৈশাখের সকাল। মোবাইল খুট খুট করে সকাল থেকে ভেসে আসা শুভেচ্ছাস্রোতের উত্তর দেওয়ার সময় এখন – অনেকদিন পরে সকালে একটু অবসর। কাজ বেলা থেকে।
ঠিক এখনই খবরটা এল। তিনি নেই। না ফেরার দেশে চলে গেলেন আজ সকালেই। ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার জগতের, বিশেষত বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার অবিসংবাদী শিরোমণি, শিক্ষকদেরও শিক্ষক, নবতিপর বয়সেও চিন্তন, মনন, প্রজ্ঞা ও স্মৃতিতে ভাস্বর – এক অলোকসামান্য মনীষী ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, MO, FRCOG, FRCS, D.Sc। আমাদের ছোট-বড় সকলের পরম শ্রদ্ধার BNC।
এ খবরটা অপ্রত্যাশিত ছিল না- বয়স হয়েছিল, শরীরের কলকব্জাগুলো বিকল এবং রোগাক্রান্ত হচ্ছিল একে একে। বহুদিন ধরে নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন অতি সঙ্কটজনক অবস্থায়। তবু, মহীরূহ তো মহীরূহই – তার পতন কে দেখতে চায়? কে মানতে পারে শূন্য আকাশ?
চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসাবে ওঁর মূল্যায়ন করা আমার আয়ত্তাতীত। তাছাড়া সে পরিসরও এটি নয়। নিশ্চয় কোনও উপযুক্ত মানুষ দ্রুত সে দায়িত্ব নেবেন। এ কেবল এক অযোগ্য উত্তরসূরীর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ।
নাম শোনা ছিল, কিন্তু ওঁকে প্রথম চিনি দু হাজার তিনে এন্ডোমেট্রিওসিস সোসাইটি ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে, সদ্যগঠিত যে সভার আমি একজন সাধারণ সদস্য মাত্র। সসম্ভ্রম সে দেখা – তিনি আমার গুরু ডাঃ প্রমথেশ দাস মহাপাত্র’রও গুরু, অতএব পরমগুরুকে মানুষ যেভাবে দূর থেকে দেখে।
তার অনেক পরে ২০১১। নাগপুরে এন্ডোমেট্রিওসিস সংক্রান্ত একটি সারাদিনের সেমিনার। আগের রাতে তাঁকে দেখলাম ডাঃ মঞ্জুলা রোহাতগির বাড়িতে ঘরোয়া ডিনারে। গলায় কলার – হাসতে হাসতে অনেকের কৌতূহলের উত্তরে বললেন, “আরে, BNC র কি বয়স বাড়বে না? দিনাজপুর হাসপাতালে জলচৌকিতে বসে ঘাড় উঁচু করে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে হাজারখানেক VVF repair করেছি পেশেন্টকে লোহার টেবলে শুইয়ে। তখন কোথায় তোমাদের অ্যাডজাস্টেবল ওটি টেবল? তার দাম তো দিতে হবে।”
পরদিন সকালে প্রথম বক্তা আমি – ওই যেমন বড় জলসার শুরুতে এলেবেলে দু তিন জনকে দিয়ে আসর জমাতে দেওয়া হয়, সেরকম। উনি লাঞ্চের ঠিক আগে বলবেন – Conference Oration। তা হোক। জীবনে একবার হলেও আমি BNC র সাথে, একইদিনে, একই মঞ্চে বক্তা হয়েছি। আমার এ নগণ্য ডাক্তারী জীবনে এ এক পরম প্রাপ্তি।
সেদিন বিকালে নাগপুর এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ। দুদিন পরে কলকাতায় ভাষাভবনে আমায় বিতর্কসভায় বলতে হবে টেস্ট টিউব বেবির পক্ষে, দত্তক নেওয়ার বিপক্ষে। সহযাত্রী ডাঃ নির্মলা পিপারার সাথে আলোচনা করছিলাম, কিভাবে যুক্তি সাজানো যায়। উনি বললেন, দেখো ওপাশে BNC বসে আছেন। ওঁর কাছে গিয়ে টিপস্ নাও। ওরে বাপস্, ওঁর কাছে আমি যাব টিপস্ নিতে? আমায় ঠেলে পাঠালেন নির্মলা দিদি। পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য বললাম। BNC চেয়ারে, আমি পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে। এক কিংবদন্তী তাঁর এক অপরিচিতকে কাঁধে হাত রেখে বোঝালেন, পড়ালেন। বিপক্ষ কি যুক্তি দিতে পারে, তাও সাবধান করলেন। আমি যেন জ্যোতিঃস্পৃষ্ট হলাম।
দু হাজার বারোর জানুয়ারি। নীলরতন সরকার হাসপাতালে গাইনির স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শিবির। মঞ্চের উপরে নকল মৌখিক পরীক্ষার আসর। দর্শকাসনে পরীক্ষার্থী ও অন্যান্য শিক্ষক-চিকিৎসকরা। দ্বিতীয় দিন BNC আসবেন মক্ এগজামিনার হয়ে। প্রথমদিন রাতে ফোন এল, কেউ ওঁর সাথে সহ-পরীক্ষক হতে রাজি নন। কোনও ক্যান্ডিডেটও ওই সেশনে হট সিটে বসতে চাইছে না। অগত্যা আমি – কারণ আমি বয়সে সিনিয়র। না করা আমার অভ্যাস নয়, আর তাছাড়া যাঁকে সবার ভয়, তিনি নিজেই তো সে ভয় ভাঙিয়ে দিয়েছেন ছ’মাস আগে।
পরদিন আমার সাথে ডাঃ রুমিনা বাগচীকে রাজী করানো হল হট সিটে বসার জন্য। মঞ্চে টেবলের একদিকে BNC একা। অন্যদিকে রুমিনা এবং আমি। উনি দুজনকে দুটি প্রশ্ন করলেন, সদুত্তর পেয়ে গোটা বন্ধ্যাত্ব বিষয়টি পরীক্ষার মত করে পড়িয়ে দিলেন পরের আধঘন্টায়। আমি আরও একবার ধন্য হলাম। ভাগ্যিস আর কেউ রাজি হয়নি – টেবলের কোনওদিকেই।
ওঁকে শেষ দেখি ২০১৯ এর AICC RCOG কনফারেন্সে, কলকাতায়। নব্বই বছরেও কি সতেজ স্মৃতি, অতলান্তিক প্রজ্ঞা আর তীক্ষ্ণ রসবোধ। তারপর তো কোভিড এল। এই সময়ে উনি আরও বৃদ্ধ হলেন। মহামারীর করাল ছায়া কেটে সবে আলো আসছে – আমাদের সবার BNC চলে গেলেন অস্তাচলে।
শল্যবিদ্যা, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা, ফলিত-বিজ্ঞান, চিকিৎসা-গবেষণা এবং পেশানির্ভর উদ্যোগের জগতটা বড় রিক্ত হয়ে গেল।
এ নববর্ষের দিনটা এই খারাপ কারণে মনে রাখতে হবে।
বিদায় স্যর।
পার্থ, খুব মনোজ্ঞ স্মৃতিচারণ। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।