বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজ থেকেই এমবিবিএস পাস করেছিলাম, কিন্তু সেখানে রেডিওথেরাপি বিভাগটা চিনতাম না। সেটা অবশ্য আলাদাভাবে আমার অপদার্থতা বা ফাঁকিবাজির কারণে নয়। অধিকাংশ এমবিবিএস ডাক্তারের ক্যান্সার চিকিৎসা বিষয়ে কোনও ধারণাই থাকে না – ক্যান্সার বিভাগে ঠিক কী কী করা হয়, সেসব খায় না মাথায় মাখে, সে নিয়ে ন্যূনতম ধারণা থাকে না – অন্তত অধিকাংশ নতুন পাশ-করা ডাক্তারের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য।
ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার-আক্রান্তের সংখ্যার বাজারে এর বিপদ দু’রকম –
১. এমন একটা অবান্তর ধারণা তৈরি হয়, যেকোনও শারীরিক অবস্থাতেই ক্যান্সারের চিকিৎসা করে ফেলা সম্ভব এবং শয্যাশায়ী মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রেও চিকিৎসায় দুরন্ত ফল মেলে। অতএব, একেবারে শেষ দশায় অতি-অসুস্থ রোগীকে রেফার করার পর ক্যান্সার-বিশেষজ্ঞ যদি কেমোথেরাপি প্রেসক্রাইব না করেন, নতুন ডাক্তারবাবুরা যারপরনাই বিরক্ত হন – ভাবেন, ট্রিটমেন্ট ছাড়া ফেলে রাখা হচ্ছে এবং সেই ফালতু-হ্যারাস-করা-হচ্ছে টাইপের ভাবনাটা রোগীর পরিজনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। অথচ, যে রোগী চব্বিশ ঘণ্টা বিছানাবন্দী, অসুখের কারণে যাঁর সারাক্ষণ অক্সিজেন লাগে – এককথায় যিনি প্রকৃত অর্থে মুমূর্ষু – তাঁর ক্ষেত্রে অসুখ সারানোর লক্ষ্যে ক্যান্সার চিকিৎসা কার্যকরী নয়। ক্যান্সারের কড়া চিকিৎসা সহ্য করতে পারার জন্যও ন্যূনতম একটা শারীরিক সক্ষমতা জরুরি।
২. আবার পূর্বোক্ত বিভ্রান্তির ঠিক উল্টো বিভ্রান্তি হিসেবে ধারণা জন্মায়, ক্যান্সার রোগীর যাবতীয় শারীরিক অসুস্থতা তাঁর ক্যান্সারের কারণে এবং তাঁর যাবতীয় উপসর্গের সুরাহার জন্য ক্যান্সার-বিশেষজ্ঞের মতামত জরুরি। অথচ, কারও ক্যান্সার হওয়ামাত্র তিনি গ্রহান্তরের আগন্তুক হয়ে ওঠেন না – তাঁরও ঠান্ডা লেগে জ্বরজারি হয়, এটাসেটা কারণে পেটখারাপ হয় – অথচ সেই খুচরো সমস্যার জন্যেও তাঁকে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করে ক্যান্সার-স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখিয়ে আসতে হয়। যা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। ভুক্তভোগী মাত্রেই এই হয়রানির কথা জানেন।
কিন্তু বারংবার বলাকওয়ার পরেও এমবিবিএস কারিকুলামে ক্যান্সারের চিকিৎসা বিষয় হিসেবে ঢোকানো যায়নি। ইদানীং নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে, শেষমেশ কী হবে বলা মুশকিল।
তো যেকথা বলছিলাম, বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে ছ’টি বছর কাটানো ও শহর-নদীর-পার-হাসপাতাল সবকিছুর অলিগলি চেনার পরেও রেডিওথেরাপি বিভাগটি চিনতাম না। চাকরির প্রথম পোস্টিং বাঁকুড়াতেই হওয়ার মুহূর্তেই মেডিকেল কলেজের জনৈক স্যার (নাম বলছি না, কিন্তু তিনি এই লেখা ঠিকই পড়বেন) জিজ্ঞেস করলেন – ডিপার্টমেন্টটা চিনিস তো? বললাম – না। অমনি বিস্তর শ্লেষাত্মক মন্তব্য ভেসে এলো। এবং এলো সস্নেহ উপদেশ।
শোন, প্রথম চাকরি করতে যাচ্ছিস। সেখানে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে আগে থেকেই চিনিস। তাঁরা তোর স্যার ছিলেন, এখন থেকে সহকর্মী, কলিগ। সম্পর্কটা বদলে যাবে। এই বদলটা যদি ধরতে না পারিস, আখেরে তুই ভুগবি। কিন্তু ওখানে গিয়ে একজনকে পাবি, চোখ বন্ধ করে যার সব কথা মেনে চলবি। তোর ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড হওয়ার যোগ্য ওই একজনই।
ডাঃ বলরাম সর্দার, নামটা সেই প্রথমবার শুনলাম।
প্রথম চাকরি করতে গিয়ে অবশ্য সমস্যা কিছু হয়নি। পুরোনো স্যাররা এতখানিই স্নেহ-প্রশ্রয়ে আগলে রেখেছিলেন, সমস্যার প্রশ্নই ওঠেনি। কোথায় থাকব, কীভাবে কম ঝামেলায় যাতায়াত করতে পারব, সবকিছু হাতে করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বাঁকুড়া শহরে আমার চেনাশোনার কোনও কমতি ছিল না, এমনিতেও সেখানে আমার অসুবিধের প্রশ্ন ছিল না। তৎকালীন প্রিন্সিপাল স্যারের বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজের প্রাক্তনীদের প্রতি বিশেষ স্নেহদৃষ্টি ছিল, সুবিধে ছিল সেখানেও। কাজেই, বলরাম সর্দারের শরণাপন্ন হওয়াটা আমার পক্ষে জরুরি ছিল না। কিন্তু কিছু কিছু সম্পর্ক তো সুবিধে-অসুবিধের তোয়াক্কা না করেই গড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে। বলরামদা আর আমার সম্পর্কও তেমনই।
প্রথমদিনই গিয়ে আলাপ। হাসিমুখে প্রশ্ন, আপনি আমাদের নতুন স্যার? এমনিতেই তখনও স্যার সম্বোধনটা শুনতে অভ্যস্ত নই, তার উপর বলরামদার ভাই হরিদা, ডাঃ হরিদাস সর্দার, কলেজে আমার দু’ব্যাচ সিনিয়র। অজাতশত্রু বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই। সবসময় হাসিমুখ, অকপট, অস্বাভাবিক রকমের সরল। বলরামদাকে বললাম, আমি হরিদারও জুনিয়র, আমাকে প্লিজ তুই করে বলুন।
তখুনি না হলেও সেদিনই তুই হয়ে গেলাম। কলেজ অফিসে গিয়ে জয়েন করাও বলরামদার বাইকে চেপে। আর সেদিনই বলরামদা আমার নিজের দাদা হয়ে গেলেন।
গতকাল বলরামদা মারা গেলেন। হঠাৎই। বলরামদাকে নিয়ে অনেক কথা বলতে পারতাম। বলাটা হয়ত জরুরিও ছিল। কিন্তু, সত্যিই পারছি না। গতকাল দুপুরেই খবরটা পেয়েছি। তার পর থেকেই এত দৃশ্য এত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসছে, সাজিয়ে লিখে ওঠা সম্ভব নয়। পরে হয়ত…
শুধু একটাই কথা বলার।
ডাক্তারি মূলত প্রায়োগিক বিদ্যা, যেখানে বইয়ের জ্ঞানের ভূমিকা সহকারীর। এদিকে মেডিকেল শিক্ষাটি পুরোপুরি ডিগ্রি নির্ভর। এর ফলে, সদ্য পাস করা অনভিজ্ঞ ডাক্তারবাবু অনায়াসে এক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন স্নাতকোত্তর-ডিগ্রিহীন ডাক্তারের উর্ধতন হয়ে বসেন, ক্ষেত্রবিশেষে “প্লেন এমবিবিএস” ডাক্তারের মতামতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করেন। পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে বলরামদা এমডি করে উঠতে পারেননি। কাজেই, প্রথাগত অর্থে অঙ্কোলজিস্ট বলতে যা বোঝায়, তাঁর পক্ষে সেটা হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।কিন্তু আজ বলে রাখা যাক, ক্যান্সারের চিকিৎসা বিষয়ে তাঁর জ্ঞানগম্যি খুব কম ছিল না। আর হাতেকলমে চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনেক তথাকথিত বিশেষজ্ঞের চাইতে এগিয়ে – অন্তত আমার চাইতে ঢের এগিয়ে তো বটেই।
এর পাশাপাশি ছিলেন অসম্ভব নিরহঙ্কার। যেকোনও সংশয়ের ক্ষেত্রে আরেকজনের অভিমত জানতে চাইতেন কুণ্ঠাহীনভাবে। এমনকি হাসপাতালের বাইরে কোনও রোগী দেখতে গিয়ে সংশয় জাগলে ধরে নিয়ে যেতেন, বাইকের পিছনে চাপিয়ে নিতেন – চল, তুইও একবারটি দ্যাখ। দাদা ভাই দুজন মিলে দেখলে ট্রিটমেন্টটা ঠিকঠাক হবে। এরকম বহুবার সঙ্গী হয়েও, কোনও রোগীর ক্ষেত্রেই বলরামদার চিকিৎসাভাবনা, ডায়াগনোসিস বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান, কোনও ক্ষেত্রে কোনও অসঙ্গতি খুঁজে পাইনি। কিন্তু, তার চাইতেও বড় কথা, যেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়, ডাক্তারির ক্ষেত্রে এই ইগো সরিয়ে রেখে এক জুনিয়রের মতামত নিতে পারাটা কতখানি ব্যতিক্রমী ব্যাপার।
অবশ্য বলরামদা মানুষটাই এরকম। মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তেমন। সবসময় হাসিমুখ। নিরহঙ্কার। সবার বিপদে-আপদে এগিয়ে আসা। সবাইকে যেটুকু সম্ভব সাহায্য করা।
কোনও কাজ নিয়ে বলরামদার বাইকে সঙ্গী হওয়াটা খুবই চাপের ব্যাপার। রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে কারও না কারও সঙ্গে গপ্পো জুড়বে। আধঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টার আগে সেরে ফেরা যাবে না। মাঝেমধ্যে রাগ হতো। এত হ্যাজান কেন? বলরামদা বোঝাতো, শোন, কেউ দুটো কথা বলতে চাইলে…
দু’হাজার বারো কি তের সাল নাগাদ সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন, মেডিকেল কলেজ থেকে অশিক্ষক চিকিৎসকদের সরিয়ে নেওয়া হবে। অর্থাৎ মেডিকেল কলেজে শুধুমাত্র শিক্ষক চিকিৎসকরাই থাকবেন, মেডিকেল অফিসাররা নন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনই, যেখানে তিন বছরের ডিগ্রি সম্পূর্ণ করা মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু দেড়-দুই দশকের অভিজ্ঞতা নিয়েও ডিগ্রি না থাকলে সেই সম্মান জোটে না। বলরামদার ক্ষেত্রেও তা-ই হল। অনেক লাফাঝাঁপা দৌড়াদৌড়ি করেও বলরামদার হেলথ সেন্টারে বদলি ঠেকানো যায়নি। বলরামদা যখন বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগ ছেড়ে হেলথ সেন্টারে জেনারেল ডিউটি মেডিকেল অফিসার হয়ে গেলেন, তার আগে তিনি একটি মেডিকেল কলেজের ক্যান্সার বিভাগে পনের-ষোলো বছরের বেশি সময় ধরে ক্যান্সার রোগী সামলেছেন। এবং সেই সময়ে যাঁরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিকিৎসার জন্যে এসেছেন, তাঁরা সকলেই জানবেন তাঁর সহমর্মিতাবোধ ও সুচিকিৎসার কথা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, ডাঃ বলরাম সর্দার-এর পক্ষে “বিশেষজ্ঞ” হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, “শিক্ষক” হওয়া তো দূরের কথা।
অথচ বলরামদার কাছে যা যা শিখেছি, তার ফর্দ করতে বসলে বড্ডো লম্বা হয়ে যাবে। আজকাল চারপাশে তাকালে মাঝেমধ্যে খুব হতাশ লাগে। সম্ভবত বয়স বাড়ার কারণে। তবু মনে হয়, এখনকার ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরাও বলরামদার মতো মানুষকে সামনাসামনি পেলে শিখতে পারত। শিখতে পারত ব্যস্ত আউটডোরে বসেও মুক্তোর মতো হাতের লেখায় ওপিডি কার্ডে রোগীর প্রাসঙ্গিক তথ্য লিখে রাখা। শিখতে পারত, সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোগীর কথা শোনা, এবং সেখানেও বাড়তি কথার মধ্যে কোন কথাটুকু প্রাসঙ্গিক তা ছেঁকে নেওয়া। শিখতে পারত, রোগীপরিজনের ভরসা কেমন করে অর্জন করা যায়, তেমন আচরণ – অধুনাচর্চিত “পেশেন্ট হ্যান্ডলিং” বলতে যা বোঝায়, তার বহু উর্দ্ধে সে আচরণ – আন্তরিক সহমর্মিতা। অন্তত আমি তো শেখার চেষ্টা করতাম – শিখে উঠতে পারিনি, বলরামদার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি বলে। সে যা-ই হোক, সিস্টেমের বিচারে এসবের চাইতে ডিগ্রি ঢের বেশি দামী, অতএব বলরামদার কপালে “শিক্ষক-চিকিৎসক”-এর তকমা জোটেনি।
বলরামদা মারা গেলেন। কত কথা মনে পড়ছে। গুছিয়ে লিখে ওঠা সম্ভবই নয়। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাঁদের সমস্যাটা তাঁদেরই একজন হয়ে বোঝা – চিকিৎসার আধুনিক মডেলে ব্যাপারটা পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। বলরামদারাও বাতিলের খাতায় পড়ে যাচ্ছিলেন, কেননা সেটাই স্বাভাবিক। স্থানীয় লব্জ অনুসারে মজার ছড়া কাটতে পারতেন বেশ। তারই মধ্যে একটা খুব মনে পড়ছে –
যস্মিন দেশে যদাচার।
ভাত নেই তো মুড়ি মার।।
আমাদের মতো বহু ভাষা বহু সংস্কৃতির দেশে, যেখানে আবার এমন সাঙ্ঘাতিক অসাম্য, সেখানে স্থানীয় মানুষের ভাষায় তাঁদের একজন হয়ে তাঁদের স্বাস্থ্যসমস্যাকে বোঝা ও তেমন করে সমস্যার সমাধানে এগোনো যে কতখানি জরুরি, তা বলে বোঝানো অসম্ভব। ডাঃ বলরাম সর্দাররা সেখানে সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতে পারতেন – তার পরিবর্তে তাঁরা বাতিলের দলে পড়ে যান। ক্ষতিটা বলরামদাদের তো বটেই, কিন্তু তার চাইতেও বহুগুণে বেশি ক্ষতিটা সাধারণ মানুষের। তবু…
লেখার সঙ্গে বলরামদার একখানা ছবি জুড়তেই পারতাম। ইচ্ছে করল না। গতকাল তাঁর ফুলে ঢাকা মুখের শেষ ছবিও এক বন্ধু পাঠিয়েছে। মুখে গভীর প্রশান্তি। যেন ঘুমিয়ে আছেন। ক্লেদহীন, ক্লেশহীন। প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল খুব। তারপর মনে হল, বিজয়া-টিজয়ার পর প্রণাম করতে গেলেই বলরামদা বলতেন, তুই আবার প্রণাম করবি কী রে ক্ষ্যাপা, বুকে আয়…
Amar borjora te posting. Sir er sathe etodin prai 2.5 yr katiyechhi. Eto bhalo manush ajkal pawa jaina. Sudhu byabohar noi, honesty teo sir tulonaheen.. kichudin agey sir er snge picnic o korechhi November ei. Abar kotha hoechhilo koyekmas pore abar picnic er.. seta ar hoe uthlo na. Sir jekhanei thakun, bhalo thakun.