পেশায় এল এম এফ ডাক্তার। রুগীরও কমতি নেই। কিন্তু দেশগঠনের ব্যামোর ওষুধ তখনও বেরোয় নি। ফলে বাবার ধানের গোলা খুলে দিলেন। হাভাতেরা খেয়ে বাঁচল। আর যা হয়, হতভাগারা লতার মত আঁকড়ে ধরে। তাই বাপ চোদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে আর যাওয়া হল না ডাঃ রাধাকৃষ্ণ পালের। থেকে গেলেন বেঙ্গাই গ্রামে। কিন্তু এমন হদ্দ গ্রামে কে আসবে? একে জলকাদায় মাখামাখি। তায় লেঠুড়েদের উৎপাত। সন্ধ্যে হলে কার বাপের সাধ্যি এদিকে আসে। ফাঁকা মাঠে পথিকের পা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া হয় সড়কি। পড়ে গেলেই দুই বাঁশের মাঝে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে একটু মোচড়। ব্যস, কেল্লা ফতে।
ডাঃ পাল নিয়ে এলেন আদিবাসীদের, চন্দ্রকোণা থেকে। সাহসী, বলিষ্ঠ। এবার লড়াই সেয়ানে সেয়ানে। নিজের জোত জমিও দিলেন তাঁদের জীবিকার জন্যে। বেঙ্গাই পাল্টাতে লাগল। কিন্তু ভদ্দরলোকেরা যে পা দেয় না। এবার দিলেন কড়া দাওয়াই। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলই। কতবার সাধ্যমত নিবেদন করেছেন তাঁর দেশাভিযানে। তাই আমন্ত্রণ জানালেন নেতাজিকে বেঙ্গাই গ্রামে একবার আসতে। সাড়া দিয়ে এলেন নেতাজি। আর তাঁকে দেখতে তথাকথিত ভদ্রলোকেরাও। জাতে উঠল বেঙ্গাই। ডাঃ পাল বেঙ্গাই মোড়ের নাম দিলেন “নেতাজি নগর”। আজও বহাল। আরো উজ্জ্বলভাবে।
নিজের গ্রামে বিনা পয়সায় চিকিৎসার পাশাপাশি একাধিক স্কুল, সেবাকেন্দ্র তৈরী করতেই ডাক পেলেন পাশের আরামবাগ থেকে। একাধিক বিদ্যালয়, কালিপুরে নেতাজি মহাবিদ্যালয় – এরকম খান বিশেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন নিজের সীমিত জীবনে।
প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে হারিয়ে রাজ্য আইনসভাতে সদস্য হলেন। কৌতুকপ্রিয়, স্পষ্টবাদী মানুষটিকে ভুল বুঝলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ডাঃ রায় পারতপক্ষে ডাঃ পালের ছায়া মাড়াতেন না। এদিকে ডাঃ পালের ইচ্ছে হল বেঙ্গাইতে একটা কলেজ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। সোজা দেখা করলেন ডাঃ রায়ের সঙ্গে। প্রস্তাব শুনেই নাকচ করলেন ডাঃ রায়। ভাবলেন যাক, অন্তত এ যাত্রায় বেশ জব্দ করলেন ডাঃ পালকে। কিন্তু হল উল্টো। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়কে তখুনি পাঁচকথা শুনিয়ে ছাড়লেন তিনি। আর সঙ্গে এক জবরদস্ত “হুমকি” – “শুনুন ডাঃ রায়, আমি যদি রাধাকেষ্ট (রেগে গেলে নাকি এভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতেন) পাল হই, তবে বেঙ্গাইতে আমি কলেজ করবই। আর সেটা উদ্বোধন করবেন আপনি। আর সেটাও, আমি যেদিন স্থির করব সেই দিনে।” বলেই গট গট করে হাঁটা দিলেন। আর ডাঃ পালের ঔদ্ধত্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ রায়।
দিন যায়। ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন ডাঃ রায়। মনে পড়ল ডাঃ পালকে তাঁর চেম্বারে ঢুকতে দেখে। মনে মনে শঙ্কিতও হলেন আজ আবার কি বচনবিদ্ধ করেন ডাঃ পাল। আসলে শুধু বিধায়ক হিসেবে তো নয়, দরদী, সফল চিকিৎসক এবং নিস্বার্থ সমাজসেবী হিসেবে ডাঃ পালকে মনে মনে বোধহয় খানিকটা সমীহও করতেন ডাঃ রায়। যাই হোক, এসে চেয়ারে না বসেই ডাঃ পাল বললেন ডাঃ রায়কে – “আগামী —-তারিখে বেঙ্গাই কলেজের উদ্বোধন। আপনাকে উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রণ জানালাম। এই নিন আমন্ত্রণপত্র।”
কি আশ্চর্য! কোন অনুমোদন নেই, অনুমোদনের আবেদনও নেই অথচ আস্ত একটা কলেজ তৈরী হয়ে গেল। আর কি দুঃসাহস, মুখ্যমন্ত্রীকে বলে কিনা তা উদ্বোধন করতে। বিরক্তিতে আমন্ত্রণপত্রটি ছুঁড়ে ফেলতে যাবেন এমন সময় ডাঃ পাল বলে উঠলেন, “ডাঃ রায়, ওটি ছুঁড়ে ফেলার আগে একবার দেখে তো নিন, কি ফেলছেন।”
বহুকষ্টে রাগ সামলে খাম খুলে আমন্ত্রনপত্রে চোখ বুলাতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন ডাঃ রায়। দেখলেন, লেখা আছে – আগামী —-তারিখে “অঘোরকামিনী-প্রকাশচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের” উদ্বোধন করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। নিশ্চল মুখ্যমন্ত্রীর গাল বেয়ে নেমে আসছে জল। ছেলে হয়ে যে কাজ তিনি করতে পারেন নি আজ তাঁর হয়ে সেই কাজটাই করে দিয়েছেন ডাঃ রাধাকৃষ্ণ পাল। ডাঃ রায়ের নিজের মা, বাবার নামে পরম শ্রদ্ধায় একটি কলেজ করেছেন ডাঃ পাল। আর তার জন্য একটি পয়সাও তিনি নেননি ডাঃ রায়ের থেকে। আবেগ সামলে ডাঃ রায় বললেন, “রাধাকেষ্ট, আমি জানতাম তুমি ক্রিটিক্যাল…” কথাটা শেষ না করতে দিয়ে ডাঃ পালের পাদপূরণ, “ এখন তো বুঝলেন – হাইলি”।
তারপর আর কি? সে দিনের সেই কলেজ আজ আরামবাগ মহকুমার অন্যতম নামী, ব্যস্ত কলেজ – এ কে পি সি কলেজ, বেঙ্গাই।
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম-মৃত্যুদিনে সারাদেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে “জাতীয় চিকিৎসক দিবস”। চিকিৎসক যে কেবল দেহের চিকিৎসাই করেন না, করেন সমাজ ও জাতির – আমরা দেখেছি, শুনেছি তাঁর জীবন থেকে।
আরেক চিকিৎসক ডাঃ রাধাকৃষ্ণ পাল বোধহয় একটা রোগের দাওয়াই দিয়ে গেলেন, নিজের জীবন দিয়ে। আমরা যখন বাথরুমের দেওয়ালেও নিজের নাম খোদাই করতে ছাড়ি না, তখন প্রায় কুড়িটিরও বেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্মান করেছিলেন যে মানুষটি, একটিতেও নিজের নামে উৎকীর্ণ করে যান নি। এত বড় সংযম আর ত্যাগ যদি আমাদের প্রভাবিত না করে তবে তো আমরা দূরারোগ্য রোগে ভুগছি।
মহাজীবনের স্মরণ বর্তমানকে পথ দেখায়। শুনেছিলাম আরামবাগের গুণীজন ডাঃ রাধাকৃষ্ণ পালের জন্মদিন, ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখটিকে রাজ্যকর্তৃক স্মরণ-দিন হিসেবে চিহ্নিত করার আর্জি জানিয়েছিলেন ২০০৮-০৯ সালে। হয়ত দেখে যেতে পারব তাঁদের সে অনুনয় একদিন মান্যতা পেয়েছে।
ক্ষুদ্র আমি, আজ বিনম্রচিত্তে স্মরণ করি এই দুই বিরল চিকিৎসককে, যাঁরা নিজেদের বাইরে দাঁড়িয়ে সমাজেরও চিকিৎসা করেছেন ত্যাগে আর মমতায়। প্রণাম।।
(রচনাকাল : ১লা জুলাই ২০১৪ / লেখক: ভাস্কর জ্যোতি বেরা।)
সংগৃহীত