Skip to content
Facebook Twitter Google-plus Youtube Microphone
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Menu
  • Home
  • About Us
  • Contact Us
Swasthyer Britte Archive
Search
Generic filters
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Menu
  • আরোগ্যের সন্ধানে
  • ডক্টর অন কল
  • ছবিতে চিকিৎসা
  • মা ও শিশু
  • মন নিয়ে
  • ডক্টরস’ ডায়ালগ
  • ঘরোয়া চিকিৎসা
  • শরীর যখন সম্পদ
  • ডক্টর’স ডায়েরি
  • স্বাস্থ্য আন্দোলন
  • সরকারি কড়চা
  • বাংলার মুখ
  • বহির্বিশ্ব
  • তাহাদের কথা
  • অন্ধকারের উৎস হতে
  • সম্পাদকীয়
  • ইতিহাসের সরণি
Search
Generic filters

“তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়”

subhash mukhopadhay
Dr. Samudra Sengupta

Dr. Samudra Sengupta

Health administrator
My Other Posts
  • June 20, 2023
  • 7:08 am
  • No Comments
“গোড়ার কথা”
একেবারে শুরুতেই একটি কথা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুদিনে তাকে নিয়ে অজস্র ভুলে ভরা বা অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে মনগড়া কাহিনীমূলক নানান লেখার রিবাটাল নয় এই লেখাটা। এটা লেখার কারণ অন্য। একটি লেখায় আহুত হয়ে মন্তব্য করেছিলাম যে “ওনার মৃত্যুতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রাক্তনী হিসেবে আমি গভীরভাবে দুঃখিত, পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে, ও ভারতীয় হিসেবে, আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, এবং বামপন্থী হিসেবে অত্যন্ত লজ্জিত।” এইটে পড়ে এক বন্ধু জানতে চেয়েছেন যে এমনধারা মন্তব্য করার কারণ কি। বলতে পারেন বাকি লেখাটা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদে লেখা।
“জীবন খাতার প্রতি পাতায়”
ডা: মুখোপাধ্যায় ঠিক কি কি কারণে আত্মহনের পথ বেছে নিয়েছিলেন সেটা জানা বোঝার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করবো। আমাদের আগেও অনেকেই জানতে বুঝতে চেয়েছেন। তাদের মতামতের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও একটি বিষয়ে অনেকেই একমত যে ওনার মন ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে তাদের অন্যতম হল একটি কমিটি। এই বিখ্যাত বা কুখ্যাত কমিটির কাজকর্মের অনেক নমুনা আমরা পেশ করবো। শুরু করা যাক সেই জায়গাটা থেকে যখন তাঁর আবিষ্কারের কাহিনী শুনে সন্দেহ এর বীজ বপনটা সুকৌশলে এইভাবে ছড়ানো হয়েছিল ওই কমিটি দ্বারা যে উনি তো ফিজিওলজির শিক্ষক, টেস্ট টিউব বেবির উনি কি জানেন। মার্জনা করবেন। আমাদের আলোচনায় এই টেস্ট টিউব বেবি শব্দ গুলি ঘুরে ফিরে আসলেও প্রাজ্ঞ পাঠক জানেন যে আসলে বলতে চেয়েছি ইন ভিট্র ফার্টিলাইজেশন (সংক্ষেপে আইভিএফ) এর কথা যা চলতি ভাষায় টেস্ট টিউব বেবি (বাংলায় নলজাতক) নামে পরিচিত।
তথ্যগত দিক থেকে ওই কমিটি সঠিক ছিল। সত্যিই তো, ৩রা অক্টোবর ১৯৭৮ সালে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়া তথা ভারতের প্রথম নলজাতক কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গা জন্ম নেয় তখন তার মানসপিতা ডা: মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজির প্রফেসর। কথায় বলে না, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওই কমিটি এবং কেউ কেউ সযত্নে যে তথ্যগুলো এড়িয়ে যেতে চায় তা’হল –
এক) ডা: মুখোপাধ্যায় কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার গাইনকোলজি ও ধাত্রীবিদ্যার শাখায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, “হেমাঙ্গিনী স্কলারশিপ ও কলেজ মেডেল পেয়েছিলেন। আমার জানা নেই যে বন্ধ্যাত্ব নিবারণ এর ভাবনা চিন্তা ঠিক কবে তার মাথায় এসেছিল। কিন্তু এটা অনুমান করা যায় যে ধাত্রীবিদ্যা তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। এই তথ্যটা আমাদের মহামান্য উইকি সাহেব আবার চেপে গেছেন কেন কে জানে।
দুই) দু’বার পিএইচডি করা এই মানুষটি প্রথমবার উপাধিটি পান ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ড: সচ্চিদানন্দ ব্যানার্জির তত্ত্বাবধানে রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি নিয়ে গবেষনা করে যে গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ” দি বায়োকেমিক্যাল চেঞ্জেস ইন নর্মাল এন্ড এবনর্মাল প্রেগনেন্সি”।
তিন) এডিনবরাতে জুটিয়ে আনা দ্বিতীয় পিএইচডিটার কথা সুধী পাঠক ভুলে গেলে আরেকবার মনে করিয়ে দি, কলম্বো স্কলারশিপ পেয়ে উনি পিএইচডিটা করতে যেখানে গিয়েছিলেন সেটার নাম, “ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজি রিসার্চ ইউনিট। ওনার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক জন লোরেইন যিনি নিজে একজন রিপ্রোডাক্টিভ ফিজিওলজিস্ট হিসেবে পরিচিত;
চার) নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে তাঁর সমসাময়িক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী স্মৃতিচারণে বলেছেন যে উনি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল এ ও ডা: মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়ায় বদলি হয়ে যাওয়ার আগেও তাঁদের মধ্যে আলাপচারিতায় ওই টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে গবেষণার কথা উঠে আসে;
এহ বাহ্য। ডা: মুখোপাধ্যায় এমবিবিএস এর আগে ওই প্রেসিডেন্সি থেকে ফিজিওলজি নিয়ে অনার্স পাশ করেছেন এবং এডিনবরা থেকে দ্বিতীয় পিএইচডি করার পরে নীলরতন সরকার এ ফিজিওলজির লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন এই তথ্যই তাঁকে “ফিজিওলজির লোক” হিসেবে দেগে দেওয়া যথেষ্ট কারুর কারুর কাছে।
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে”
সত্যিই তো। কি এমন হাতিঘোড়া আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যে তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করতে হবে। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নি যে তিনিই এশিয়া তথা ভারতের প্রথম ইত্যাদি তথ্য তো এটাই যে তিনি প্রথম হতে পারেন নি, সেকেন্ড বয়। ফার্স্ট বয় তো সেই ব্রিটিশ বায়োলজিস্ট রবার্ট এডওয়ার্ডস যিনি সুভাষবাবুর ৬৭ দিন আগে ওল্ডহ্যাম, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে লুই জয় ব্রাউন এর মানসপিতা হয়েছেন ডা: স্টেপটো এর সহযোগিতায়, নোবেল পকেটে পুরেছেন।
একবারটি দেখে নেওয়া যাক যে গোরা সাহেবের থেকে নেটিভ বাঙালিবাবু কোথায় কোথায় আলাদা। অধ্যাপক এডওয়ার্ডস এর টিম যেখানে স্বাভাবিক ঋতুচক্রের উসাইট ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে প্রফেসর মুখার্জির টিম ব্যবহার করেছিল হিউম্যান মেনোপজাল গোনাডোট্রপিন হরমোন স্টিমুলেটেড সাইকেল। অবাক কথা এই যে আজকাল সবাই এসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজির যে পদ্ধতি অনুসরণ করে সেটা নোবেল পাওয়া এডওয়ার্ড সাহেবের ওই ন্যাচারাল সাইকেল নয়, বরঞ্চ খেলাতচন্দ্র স্কুলের বাংলার মাস্টার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছাত্তর ওই ভেতো বাঙালির আবিষ্কার করা স্টিমুলেটেড সাইকেল। সাহেবকে বাঙালির দেওয়া এক নম্বর গোল।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ’ল ক্রায়ো-প্রিজারভেশন অফ হিউম্যান এমব্রাও – এডওয়ার্ডস এর টিম জরায়ুতে এমব্রাওটিকে প্রতিস্থাপিত করেছিল ওই একই ঋতুচক্রে। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর টিম মনে করেছিল যে ইউটেরাসকে সময় দেওয়া হোক ইমপ্লান্টেশনের জন্য রেডি হতে। তাই
অন্য ঋতুচক্রতে এমব্রাওটিকে প্রতিস্থাপনের আগে প্রিজার্ভ করা হয়েছিল হিমায়িত অবস্থায় ৫৩ দিন রেখে। ওঁর টিম বিশ্বে সর্ব প্রথম এই এমব্রাও ক্রায়ো-প্রিজারভেশন টেকনিক ব্যবহার করে সফল ভাবে। এর পরে দ্বিতীয়বার এই টেকনিক ব্যবহার করে ট্রনসন ও সহযোগীরা নেচার পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন ১৯৮৩ সালে। এখন এই টেকনিকই ব্যবহার করা হয়। সাহেবকে দেওয়া বাঙ্গালির দু’নম্বর গোল। এই হিমায়িত করা বিষয়টা সুধী পাঠক মনে রাখবেন। আবার আসবে এই প্রসঙ্গ। কুখ্যাত সেই এনকোয়ারী কমিটি এটা নিয়েও ব্যঙ্গ করেছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল ওই লোড শেডিং এর বাজারে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করা গেল কি ভাবে, কারেন্ট চলে যায় নি ?
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হ’ল – ট্রান্স ভ্যাজাইন্যাল রিট্রিভাল অফ উসাইট। উসাইট সংগ্রহ করার জন্য ডা: স্টেপটো ব্যবহার করেছিলেন ঝুঁকিপূর্ণ ইনভেসিভ ট্রান্স এবডমিনাল রুট, পেট কেটে ল্যাপরোস্কপি দিয়ে, আর ডা: মুখার্জির টিম করেছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মিনিমাল ইনভেসিভ ট্রান্সভ্যাজাইন্যাল রুট। ওনারা কলকাতায় বসে সেই সময়ে আল্ট্রা সোনোগ্রাফি ব্যবহারের সুযোগ পান নি তাই পোস্টিরিয়ার কল্পটমি করতে হয়েছিল। মধ্য-আশির দশক থেকে আল্ট্রা সোনোগ্রাফির সুযোগ নিয়ে ওই ট্রান্সভ্যাজাইন্যাল রুটই ব্যবহার করা শুরু হয় এবং এখন সেটাই চলছে। বাঙালির তিন নম্বর গোল।
বৈজ্ঞানিক জার্গনের কচকচি ছেড়ে মোদ্দা কথা এটাই দাঁড়ালো যে ডা: মুখার্জীদের আবিষ্কৃত টেকনিক ওই লন্ডন স্কুলের পদ্ধতি থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। পরবর্তীকালে ডা: মুখার্জীর পদ্ধতিটিই মোটামুটি অনুসরণ করা হয় অন্যান্য জায়াগায় কারণ ওনাদের পদ্ধতিটি তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ-সরল, নিরাপদ ও সাফল্যের হার অনেক বেশি। ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে মোহনবাগানের দুই-এক গোলে হারানো নয়, এ একেবারে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তিন-শূন্য গোলে হারানো। জিতে মোহনবাগান শিল্ড পেয়েছিল, আর ডা: মুখোপাধ্যায় কি পেয়েছিলেন ?
“কি পেয়েছি তার হিসাব মিলাতে”
বেঁচে থাকতে যা যা সাহায্য সহযোগিতা সন্মান পেয়েছিলেন তা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তাঁর স্ত্রী নমিতার কথা। ….
এর পরে বলতে হয় ১৯৬৬ এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে তাঁর সমসাময়িক গাইনকলজি বিভাগের এসিস্টেন্ট প্রফেসর বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর কথা। অধ্যাপক চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী তিনি ও তাঁর বন্ধু ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দুজনেরই আনকমন সাবজেক্ট নিয়ে গবেষণার ঝোঁক ছিল ও সেই সময়ে সুভাষবাবু এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে কাজ করছেন। সেই সময়ে দুজনেই বয়েস মধ্য চল্লিশ। নিজেদের মধ্যে প্রচুর আইডিয়া ও উৎসাহের আদান-প্রদান হ’ত।
কালক্রম অনুসারে এর পরে আসবে ওনার রিচার্চ টিমের অন্য দুই সদস্যের কথা। টেস্ট টিউব বেবি সংক্রান্ত গবেষণায় ওনার সহযোগী ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গাইনকোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা: সরোজকান্তি ভট্টাচার্য এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সুনীত মুখার্জি। উইকিবাবা আবার ভুল করে এনাকে “ক্রায়ো-বায়োলজিস্ট” বানিয়ে ছেড়েছে। ডা: মুখোপাধ্যায় এর সহযোগী ও আজীবন তাঁর একনিষ্ঠ অনুগামী এই ইঞ্জিনিয়ার মানুষটির কথায় আমরা আবার ফিরে আসবো। আপাততঃ এটুকু বলে রাখি যে সুনীতবাবু .. এর সহযোগিতায় “ডা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়লজি রিসার্চ সেন্টার” গড়ে তোলেন।
এছাড়াও সহযোগিতার একটি বিচিত্র নমুনা পেশ করা যাক। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর গবেষণার জন্য প্রয়োজন “এনিম্যাল হাউস”। অর্থবরাদ্দে কলেজের প্রিন্সিপাল রাজি তবে তার জন্য বিনিময়প্রথায় আসতে হবে। ওনাকে হোস্টেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে হবে। গবেষণারত এক বিজ্ঞানীর কাছে সময়ের মূল্য অপরিসীম। সেই মূল্যবান সময়ের কিছুটা খরচ হবে হোস্টেলের পেছনে। তাই হোক, অন্য উপায় কি। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় রাজি হয়ে গেলেন। পেলেন ইঁদুর, বাঁদর, গিনিপিগ ওয়ালা এনিম্যাল হাউস। আরেকটা লাভ হয়েছিল, তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকায় যুক্ত হল ওই হোস্টেলের আবাসিকবৃন্দ।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুর পরে বিশেষকরে তাঁর মরণোত্তর খ্যাতিলাভের পরে তাঁর একসময়ের সহকর্মীদের একাংশ নিজেদের গুণমুগ্ধ বলে দাবি করেছিলেন কিন্তু ওনার বিপদের দিনে তাঁদের আচার-আচরণ তাঁদের বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তাঁদের মরাল সাপোর্টের অভাব ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁদের ওই গুণমুগ্ধতার দাবি ঠিক ধোপে টিঁকছে না।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর চাওয়া-পাওয়ার তালিকায় সর্বশেষ ও সম্ভবত সর্ববৃহৎ অবদান যাঁর, যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর ভাবমূর্তিকে একজন টিপিক্যাল ট্র্যাজিক বাঙালি হিরো থেকে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীতে রূপান্তরিত করেছেন তিনি কোনও বাঙালিই নন, তিনি নিজে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও আইসিএমআর এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিপ্রোডাক্টিভ হেল্থ এর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডা: তিরুচিলাপল্লি চেলভারাজ আনন্দকুমার। তাঁর আরেকটি পরিচয় যে তিনি ও তাঁর সহযোগী ডা: ইন্দিরা হিন্দুজা ও তাঁদের টিম ১৯৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট ভারতের প্রথম “সায়েন্টিফিক্যালি ডকুমেন্টেড” টেস্ট টিউব বেবির জন্ম দেয়। ওনার এই কাজ ১৯৮৬ সালে আইসিএমআর বুলেটিনে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮৮ সালে “জার্নাল অফ ইন ভিটরো ফার্টিলাইজেশন এন্ড এমব্রাও ট্রান্সফার” এ প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক সুনীত মুখার্জি ১৯৮৩ সালে ডা: কুমারকে সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ডা: কুমার আসতে পারেন নি। পরে ১৯৯৭ সালে কলকাতায় এআরটি এর তৃতীয় জাতীয় কনফারেন্স এ এসে উনি ডা: সুভাষ মুখার্জী মেমোরিয়াল লেকচার দিতে আসেন। এই সময়ে সুনীতবাবু ডা: কুমারের হাতে তাঁর কাছে সযত্নে রাখা অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর গবেষণার বেশ কিছু কাগজপত্র ও হাতে লেখা নোটস তুলে দেন এবং অনুরোধ করেন সেগুলি উল্টে পাল্টে দেখতে।
স্বভাবসিদ্ধ চালে ডা: কুমার ওই কাগজপত্র ও নোটসগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন এবং স্তম্ভিত হয়ে যান। ততদিনে ভারতের প্রথম নলজাতক এর আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর ভুবন জোড়া খ্যাতি লাভ হয়ে গেছে। তবুও তিনি অসীম সাহস ও উদার্যের পরিচয় দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি নন, ডা: মুখোপাধ্যায়ই ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জনক। তিনি কেবলমাত্র “সায়েন্টিফিক্যালি ডকুমেন্টেড ফার্স্ট টেস্ট টিউব বেবি” এর জনক। তাঁর এই দাবি প্রমাণ করার জন্য তিনি ডা: মুখোপাধ্যায় এর এতাবৎকাল প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণা কাজের ওপর ভিত্তি করে একটি নিবন্ধ লেখেন এবং সেটি “দি আর্কিটেক্ট অফ ইন্ডিয়াজ ফার্স্ট টেস্ট টিউব বেবি – ডা: সুভাষ মুখার্জি” এই শিরোনামে কারেন্ট সায়েন্স পত্রিকায় ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়।
কলকাতার কনফারেন্সে যখন ডা: আনন্দ কুমার স্বেচ্ছায় তাঁর প্রথম আসনটি ত্যাগ করে দ্বর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, “লেট মি টেল ইউ দ্যাট সুভাষ মুখার্জি মাস্ট বি গিভেন ক্রেডিট ফর দ্যা ফার্স্ট টেস্ট-টিউব বেবি” এবং “অল আদার এচিভমেন্টস ডোয়ারফ ইন কম্পরাইজন টু হোয়াট হি এচিভড” তখন যথারীতি গণমাধ্যম লুফে নেয় এই চনমনে খবরটি। বন্যায় জলের মতো একের পর এক খবরের কাগজে টিভিতে খবর প্রকাশিত হয়।
“জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা”
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যে যে উদ্যোগগুলি গ্রহণ করা হয়েছিল তার কয়েকটি উল্লেখ না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। কালক্রম অনুযায়ী:-
১৯৮২ সালে ইন্ডিয়ান ক্রায়োজেনিক্স কাউন্সিল শুরু করেন “ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল অরেশন”। ১৯৮৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ক্রায়োজেনিক্স কাউন্সিল এবং বেহালা বালানন্দ ব্রহ্মচারী হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে বেহালায় তৈরি হয় ‘ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার”।
এর পরে স্মৃতি রক্ষার কাজকর্মে ভাঁটা পরে কিছুদিন। তাতে আবার জোয়ার আসে ডা: আনন্দ কুমারের প্রবন্ধের পরে।
২০০২ সালে, তাঁর মৃত্যুর ২১ বছর পরে আইসিএমআর তাঁর বিষয় নিয়ে চর্চার জন্য একটি বারো সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটি শব্দটি দেখে সুধী পাঠক আঁতকে উঠবেন না। দিনের শেষে আইসিএমআরও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র বাদ দিয়ে চলতে পারে না। তবে এবারের অভিজ্ঞতা সুখকর। শেষ অবধি ২০০৩ সালে অধ্যাপক মুখার্জির কাজ স্বীকৃতি পায়। এবং ২০০৮ সালে তাতে সরকারি সিলমোহর পরে।
১৯শে ২০০৬ সালে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের একাডেমিক বিল্ডিং এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের স্বীকৃতি হিসেবে একটি স্মৃতিফলক বসে যার আবরণ উন্মোচন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: সূর্যকান্ত মিশ্র।
২০০৭ সালে মেডিক্যাল সায়েন্সের জগতে মার্গদর্শনের কাজ করে গেছেন এমন ১১০০ জন বিজ্ঞানীকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন একটি “ডিকশনারী অফ মেডিক্যাল বায়োগ্রাফি” প্রকাশ করে। তাতে জায়গা পান অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়।
আইভিএফ এর ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৭ সালের ৭ই নভেম্বর ব্রাজিলীয় মেডিক্যাল সোসাইটি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তারা ‘ডা: সুভাষ মুখার্জি মেমোরিয়াল রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার” কে একটি ট্রফি প্রদান করে।
২০১২ সালে এসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজি, রিপ্রোডাক্টিভ বায়োলজি এন্ড এনডোক্রিনলোজির জগতে অসামান্য অবদানের জন্য আইসিএমআর চালু করে “ডা: সুভাষ মুখার্জি পুরস্কার”।
গণমাধ্যমে ও জনপ্রিয় মাধ্যমে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে নানান “চনমনে” চর্চার পাশাপাশি কয়েকটি অবদান আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
প্রখ্যাত কথাশিল্পী রমাপদ চৌধুরী অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনে ১৯৮২ সালে লেখেন ‘অভিমন্যু’ উপন্যাসটি। ১৯৯১ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে প্রকাশ পায় তপন সিনহা পরিচালিত ছায়াছবি “এক ডক্টর কি মৌত”। ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যুকে নিয়ে রাজীব সরকার ডকুমেন্টারি ফিল্ম “ব্লাড স্টেইনস নেভার ফেড” মুক্তি পায়। ছবিটি ইউ টিউবে উপলব্ধ। আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন।
একাডেমিক জগতে মেডিক্যাল সায়েন্সের নানান জার্নালে লেখাপত্র এর পাশাপাশি দুটি লেখা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার। ডন নামের পিয়ার-রিভিউড জার্নালে ২০১১ সালের ১১ নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ” লাইফ এন্ড ওয়ার্কস অফ ডা: সুভাষ মুখার্জি” প্রবন্ধটি।
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সান্দ্রা বার্নাথর তাঁর পিএইচডির থিসিস হিসেবে রচনা করেন “দ্যা হিস্ট্রি অফ আইভিএফ ইন ইন্ডিয়া” যেখানে তিনি অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর অবদানকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর জীবন ও কাজকর্ম নিয়ে আগ্রহ তৈরি করার উদ্দেশ্যে আইসিএমআর এর অর্থসাহায্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি একটি প্রজেক্ট নেয়। তার ফলশ্রুতিতে ড: শ্রাবনী মুখার্জি ও ড: রাজভী মেহতা একটি পুস্তিকা লেখেন যেটি নাম, “ডা: সুভাষ মুখার্জি – এ ভিশনারী এন্ড পাইয়নিয়ার অফ আইভিএফ” নামে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি অন্তর্জাল জগতে পিডিএফ ফরম্যাটে পাওয়া যায়।
ওপরে উল্লেখিত বেশ কিছু রচনা এই প্রবন্ধ লেখার তথ্য সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। একটি বইকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে যাতে বায়াসনেস এর অভিযোগ না ওঠে। বইটি হল সুনীত মুখার্জি রচিত “সুভাষ-নমিতা-সুনীতের উপকথা। আগ্রহী পাঠক চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।
“এ কাকে দিয়েছ রাজার পার্ট”
ভালো কথা অনেক হল এবার খারাপ কথা বলার পালা। সেই এনকোয়ারী কমিটি নিয়ে আরো একটু কথা বলা যাক যেটি “দাশগুপ্ত কমিটি” নামেও পরিচিত। কমিটির সদস্যরা হলেন: ডা: মৃণালকান্তি দাশগুপ্ত, রেডিও ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স; ডা: ডি এন কুন্ডু, ডিরেক্টর, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ডা: জে সি চট্টোপাধ্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ; ডা: কৃপা মিনা, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক অজিত মাইতি, নিউরোফিজিওলজি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক অচিন্ত্য মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজ।
কোনও গবেষণামূলক কাজের পিয়ার রিভিউ একটি অতি প্রচলিত পদ্ধতি। ওই এক্সপার্ট কমিটি কিছুটা পিয়ার রিভিউ টেকনিক অবলম্বন করে থাকবেন এটা আমরা ধরে নিতে পারতাম। মুশকিলটা এখানেই যে পিয়ার রিভিউয়ার হতে গেলে কিছু যোগ্যতা লাগে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা লাগে- সেটা যে এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে বহুল পরিমানে অনুপস্থিত ছিল তা কমিটির প্রশ্নোত্তর পর্বগুলি খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পরবে। শুধু এই লেখক নয়, ডা:আনন্দ কুমার এর মতো বিজ্ঞানীও ওই আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “নান অফ দিজ কমিটি মেম্বার্স কুড হ্যাভ হ্যাড এনি ব্যাকগ্রাউন্ড অর ইনসাইট ইনটু মর্ডান রিপ্রোডাক্টিভ টেকনলোজি, এ সাবজেক্ট আপঅন হুইচ দে ওয়ার টু হোল্ড এন এনকোয়ারী”।
দু’একটি নমুনা পেশ করা যাক, এক সদস্য বই পড়ে সবজান্তাভাব দেখিয়ে ওভাম নেগেটিভলি চার্জড এর সমস্যা নিয়ে কূটপ্রশ্ন তুলে ডা: মুখার্জিকে বিব্রত করতে চাইলেন যেটা আদৌ এই কাজের সাথে সম্পর্ক যুক্ত নয়। সেই সদস্যকে ডা: মুখার্জীর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, “আপনি জীবনে কোনোদিন ওভাম দেখেছেন ? দেখেন নি।”
ভ্রূণ হিমায়ণ প্রসঙ্গে এক সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন যে এই লোডশেডিং এর বাজারে উনি ফ্রীজে রেখে ঠান্ডা করাটা বজায় রাখলেন কি করে। হ্যাঁ এটা সত্যি যে সেই সময়ে প্রচুর লোডশেডিং হত। এমন প্রশ্ন কোনো সাধারণ মানুষ করলে তাকে মানতো কিন্তু তাই বলে একজন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য জানবেন না, তাঁর এই নূন্যতম পড়াশোনাটুকু থাকবে না যে ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন এর জন্য বাড়ির ডোমেস্টিক ফ্রিজ নয়, লিকুইড নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি প্রশ্নের নমুনা এই রকম। এম্পিউলসগুলি হিট সিল করা হয়েছিল জানার পরে এক সদস্যের প্রশ্ন, আচ্ছা, ওই সময় তাপ লেগে গোটা মিশ্রণটা গলে গেল না কেন। তাকে কে বোঝাবে যে হাজার লক্ষ ওষুধের এম্পিউলস হিট সিলই করা হয় আর কাচ তাপের অত্যন্ত কূপরিবাহী। সেজন্যই অন্য মেটেরিয়াল এর বদলে কাচ ব্যবহার করা হয়।
আর নমুনা দিয়ে পাঠকদের ধৈর্য্যচুতি ঘটাবো না। মোদ্দা কথা এই যে, ক্রমাগত প্রশ্নকর্তাদের এই ধরনের অপরিসীম অজ্ঞতা মিশ্রিত ঔদ্ধত্যমূলক প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হতে উত্তরদাতার উত্তরের মধ্যেও ফুটে উঠতে থাকে একধরণের করুণা মিশ্রিত তাচ্ছিল্য।
এই কমিটি কি রায় দিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা এবার একটু জানা বোঝার চেষ্টা করবো যে এই তথাকথিত এক্সপার্ট কমিটির এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কেন। কারণ অধ্যাপক মুখার্জিকে নিয়ে সামান্য চর্চার পরে এই প্রবন্ধ লেখকের এটাই মনে হয়েছে যে কেবলমাত্র খ্যাতি উদ্ভূত ঈর্ষা বা প্রফেশনাল জেলাসি বা তথাকথিত কাঁকড়া মনোবৃত্তি দিয়েই এটা ব্যাখ্যা করা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে।
সমসাময়িক বিজ্ঞানের জগৎ থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা মানুষের চিন্তাভাবনার নাগাল পাওয়া অন্যদের পক্ষে প্রায়ই সম্ভব হয় নি- এই ঘটনা বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে অজানা নয়। নাগাল না পাওয়ার ফলে নতুন কোনও আবিষ্কারকে গড়পড়তা মানুষতো বটেই, এমনকি গড়পড়তা চিকিৎসক বিজ্ঞানীর কাছেও “অবিশ্বাস্য” ঠেকতে পারে। অধ্যাপক মুখার্জি যে তার সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন এটা তার সমস্ত আলোচকদের কথায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ডা: আনন্দ কুমারের ভাষায় “পাইয়নিয়ারিং ওয়ার্ক”।
অধ্যাপক মুখার্জি গণমাধ্যমেতো বটেই এমনকি পেশাদার সহকর্মীদের সাথেও তাঁর গবেষণার বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করেন নি, বৈজ্ঞানিক জার্নালে ধারাবাহিক এমন কোনও নিবন্ধ প্রকাশ করেননি যা থেকে ওয়াকিবহাল মহলে এমন ধারণা তৈরি হতে পারে যে উনি একটা বড়সড় ব্রেক থ্রু এর সামনে আছেন। তাই ওনার সাফল্য সংবাদটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রচন্ড বিস্ময়বোধের জন্ম দিয়েছিল। এই বিস্ময়বোধ কিন্ত প্রকারান্তরে ওই অবিশ্বাসকেই বাড়িয়ে তুলেছে, বিশ্বাসকে নয়।এই অপরিচিত অচিন্তনীয় পদ্ধতিটি নিয়ে অবিশ্বাস ও সন্দেহ এর মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েছে।
এর সাথে যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি যোগ করতে হবে, সেটি হ’ল আমাদের, ভারতীয়দের কলোনিয়াল হ্যাংওভার। সাহেবরা এতকিছু টেকনোলজি ও ফান্ডের সাপোর্ট পেয়ে কিছু করতে পারলো না আর আমাদের ঘরের ছেলে সুভাষ একটা “ডোমেস্টিক” ফ্রিজ নিয়েই কামাল করে দিলো – এ হতেই পারে না। একথা সত্যি যে আজকালকার দিনে সাইনিটিফিক রিসার্চ এর সাফল্যলাভের সম্ভাবনার এর সাথে ওই অত্যাধুনিক টেকনোলজি ও প্রভূত ফান্ডিং যোগসূত্রটি চিহ্নিত এবং সেই কারণে আমাদের মননে স্মরনে গ্রথিত ও প্রোথিত তাই অবিশ্বাসটা খুব আনকমন নয়।
ভারতীয় তথা বাঙালির আরেকটি বৈশিষ্ট্য এর কথাও না বললেই নয়। কুপমণ্ডূকতা। বিজ্ঞানের জগৎ এ নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখতে আপটুডেট রাখতে নিয়মিত বৈজ্ঞানিক জার্নাল পত্রপত্রিকা পড়ে যেতে হয় নৈলে পিছিয়ে পরতে হয় – যে অভ্যাসটি অনেকে বিজ্ঞানীই ত্যাগ করে থাকেন বিশেষ করে তার যদি মাস গেলে একটা ভদ্রস্থ মাইনের বন্দোবস্ত থাকে। এই কমিটির কারুর মধ্যে যে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা, জাতীয়/ আন্তর্জাতিক স্তরের গবেষনা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল – তার প্রমাণ অন্ততঃ তাদের প্রশ্নোত্তরে ধরা পরেনি।
“দোষ কারো নয় গো মা”
আমরা এবার ফিরে আসছি অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় এর জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়টিতে। কি এমন ঘটলো যে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার বদলে মানুষটি আত্মহত্যা করলেন।
সিজার করে দুর্গা জন্ম নেয় ৩রা অক্টোবর ১৯৭৮ সালে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে। তার জন্মের খবর অর্থাৎ সে যে নলজাতক সেটি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। অধুনালুপ্ত অমৃতবাজার পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয় ৬ই অক্টোবর।
সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার যার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য। স্বাস্থ্য অধিকর্তার পদে ডা: মনিকুমার ছেত্রী। স্বাস্থ্য অধিকর্তাই তখন স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য-প্রশাসক, তখনও এখনকার মতো আলাদা মেডিক্যাল এডুকেশন ডাইরেকটরেট তৈরি হয় নি। তাঁর নির্দেশে ১৯৭৮ সালের ১৯শে অক্টোবর অধ্যাপক মুখার্জি একটি রিপোর্ট জমা দেন। নানান কারণে রিপোর্টটি সংক্ষিপ্ত ছিল। কেন ছিল এ বিষয়ে অধ্যাপক মুখার্জি স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে তাঁর লেখা ১লা ডিসেম্বরের চিঠিতে পরে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
ওই রিপোর্ট এর ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তর অধ্যাপক মুখার্জির দাবির সত্যাসত্য জানার জন্য ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন ও বেঙ্গল অবসটেট্রিক্স এন্ড গাইনকোলজি এসোসিয়েশনের অধীনে একটি “এক্সপার্ট” কমিটি তৈরি করেন।
১৭ই নভেম্বর, ১৯৭৮ সালে ইনস্টিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স এর সভাঘরে বিশদ আলোচনার পরে কমিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং ঘোষণা করে যে “দ্যা ওয়ার্ক অফ ড: সুভাষ মুখার্জি এন্ড হিজ টিম এজ ইমপ্লজিবল এবং বোগাস।
তদন্ত কমিটির এই রায় সামনে আসার পরে অধ্যাপক মুখার্জি ১লা ডিসেম্বরের সেই চিঠিটি লেখেন। তাতে তিনি জানান যে তাঁর প্রাথমিক রিপোর্টটি তৈরি করার জন্য তিনি বিশেষ সময় পান নি। তাকে আরেকটু সময় দেওয়া হোক। আগের সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে বেশ কিছু তথ্য হাজির না করার কারণ হিসেবে তিনি জানান যে তার ইচ্ছে ছিল যে “ওই এক্সপেরিমেন্ট এর রিপ্রোডিউসেবিলিটি সম্পর্কে মোটামুটি আশ্বস্ত হয়ে সেটি কোনো স্বীকৃত মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশ করার।”।
তিনি ওই চিঠিতে তদন্ত কমিটির তোলা একটি বিশেষ পয়েন্ট – তাঁর আবিষ্কৃত হিমায়ণ এর পদ্ধতি ও ডিএমএসও নামের উপাদানের বিস্তারিত তথ্য তিনি জনসমক্ষে আনতে চাননি বলেই ইচ্ছে করেই উল্লেখ করা থেকে বাদ দিয়েছেন কারণ, তাঁর ভাষায়, “আই হ্যাড টু বি কেয়ারফুল টু গার্ড আওয়ার আনপাবলিশড ডাটা বিকজ বাই দ্যাট টাইম আই বিকেম এওয়ার অফ দ্যা পেনিট্রেটিং এফিসিয়েন্সি অফ দ্যা টেনটাকলস অফ দি মাস মিডিয়া।”
ডা: আনন্দ কুমার এই চিঠির বয়ানকে অর্থাৎ ডাটা গোপন রাখার সিদ্ধান্তকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও তার ফলাফল প্রকাশ সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তারাও ডা: কুমারের সাথে একমত হবেন। অন্যের গবেষণার ফল চুরি করে নিজে নামী হওয়া (এবং কিছু ক্ষেত্রে দামী) এর ঘটনা আকছার ঘটে।
গবেষণাপত্র প্রকাশের তাগিদে নিয়োগকর্তার কাছে তথ্য গোপন করার এই “অপরাধ” এর জন্য অধ্যাপক মুখার্জিকে কি নিদারুণভাবে শাস্তি পেতে হয়েছে সেটা আমরা পরে দেখবো। ওই শাস্তি ওনাকে পেতে হয়েছে কারণ দিনের শেষে তিনি অধ্যাপক, বিজ্ঞানী ফিজ্ঞানী কিস্যু নন, তিনি স্রেফ সরকারি চাকুরী করা একজন ডাক্তার।
একটি তথ্যসূত্র মোতাবেক কেবল এনকোয়ারী কমিটি নয়, কেবল আমলাতন্ত্রও নয়, “সাম প্রফেসনাল বডিজ অলসো হেকেলড হিম ইন সাম মিটিংস”, অর্থাৎ ডাক্তারদের কিছু পেশাদারি সংগঠনও কিছু সভায় তাঁকে হেনস্থা করে।
আমরা আমাদের গোটা আলোচনায় একটি প্রসঙ্গ প্রায় এড়িয়ে গেলাম -সেটা হল, বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ কর্মসূচির অর্থকরী দিকটি। এড়ানো হল এই কারণে নয় যে অর্থ এই লেখকের একটি ব্যক্তিগত অপ্রীতিকর বিষয়, এই কারণেই এড়ানো হল যে এ বিষয়ে পাথুরে প্রমান ও তথ্যের অভাব।
এসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজিতে পাইয়নিয়ার হিসেবে বিখ্যাত একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যিনি পরবর্তীকালে এই ফিল্ডে সুনাম ও অর্থ দুই কুড়িয়েছেন, তিনি ডা: মুখার্জির সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে থিসিস চুরি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। ওনার স্ত্রী যেহেতু নামটি নিতে চান নি তাই সেটি অপ্রকাশিতই রয়ে গেল।
এনকোয়ারী কমিটি, আমলাতন্ত্র, সহকর্মী, প্রফেশনাল বডি – কাকে বাদ রাখবো ! সাধে কি আর রমাপদ চৌধুরী মশাই তাঁর উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন “অভিমন্যু”। পুরানের অভিমন্যু বাঁচে নি। আমাদের অভিমন্যুরও বাঁচার কথা ছিল না।
যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা
ওই তথাকথিত এক্সপার্ট কমিটির সমালোচনা এবং মাস মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশিত নানান খবর পড়ে কোনো পাঠকের মনে হতে পারে যে অধ্যাপক মুখার্জি তাঁর গবেষণার কাজের ডকুমেন্টেশন এ অবহেলা করেছিলেন, স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম অনুযায়ী পিয়ার রিভিউ জার্নালে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন নি। প্রকৃত পক্ষে এর কোনোটাই সত্যি নয়।
তিনি জার্নালে অনেক পেপার পাবলিশ করেছেন, সাইন্টিফিক কনফারেন্স এ বক্তৃতা দিয়েছেন। কয়েকটি উল্লেখ করা হল। হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন এর উৎস সম্পর্কে তাঁর গবেষণা ১৮৭০ সালের হাইপোথিসিসকে ভুল প্রমাণিত করে। ফিমেল ইনফার্টিলিটি নিয়ে টেস্টস্টেরণ এর প্রয়োগ নিয়েও তাঁর গবেষণা ছিল। ফিমেল ইনফার্টিলিটি এর কারণ এর মানসিক চাপ এর যোগাযোগ আছে এনিয়ে তিনি ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে প্যারিসে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পেপার হাজির করেন।
১৯৭৮ সালের ১৭ই আগস্ট বেলুড় রোটারি ক্লাবে টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর তাঁর টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয়। তিনি তাঁর গবেষণার কিছুটা অংশ ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রায়োজেনিক্স এ প্রকাশ করেন এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে হাজির করেন।
তিনি তার গবেষণা নিয়ে নয়া দিল্লিতে ১৯৭৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ফিফথ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন হরমোনাল স্টেরয়েড এ আলোচনা করেন। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ল্যাবরেটরি অফ হিউম্যান রিপ্রোডাকশন এর অধ্যাপক জন ব্রিগস এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক সাক্সেনার সাথে আলোচনা করেন।
তিনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি দ্বারা আমন্ত্রিত হন এমব্রাও ট্রান্সফার নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তিনি গৌহাটি ও এন্ড জি সোসাইটি দ্বারা আয়োজিত কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন ও একটি মানপত্র দ্বারা সম্মানিত হন।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ছিল অধ্যাপক মুখার্জির টিমের বিরুদ্ধে। মিডিয়া একটা সময় সর্বসম্মতিক্রমে একমত হয় যে অধ্যাপক মুখার্জির সবচেয়ে বড় অসুবিধের জায়গা ছিল তাঁর দাবির সপক্ষে ফিজিক্যাল এভিডেন্স হিসেবে নলজাতককে হাজির করতে না পারা। ১৯৭৮ সালে দুর্গার মা-বাবা প্রভাতকুমার ও বেলা আগরওয়াল তাদের কন্যার জন্মের বিশদ বিবরণ লোকসমক্ষে আনার অনুমতি দেন নি অধ্যাপক মুখার্জিকে। লোকলজ্জা, রক্ষণশীল মাড়ওয়ারিসমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয় – কারণটা সুধী পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। যদিও পরবর্তী কালে এক সাক্ষাতকারে দুর্গার বাবা প্রভাতবাবু দাবি করেছেন যে ভয় নয়, মিডিয়া হাইপ ও এটেনশনে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন তাই তার ওই সিদ্ধান্ত। এই প্রসঙ্গে ডা: আনন্দ কুমারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বারবার সেই বিশেষ “ইন্ডিয়ান সাইকি” এর কথা বলেছেন যা সন্তান উৎপাদন হীনতা কে, “বাঁজা” হওয়াকে একটা অভিশাপ বলে মনে করে।
একথা মনে করার কারণ নেই যে সশরীরে ওই শিশু দুর্গা ও তার বাবা-মাকে উপস্থিত করলেই সব ঝামেলা মিতে যেত। অধ্যাপক মুখার্জিকে এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে যে ওই সদ্যজাতক যে ‘ইন ভিভো’ ফার্টিলাইজেশন অর্থাৎ স্বাভাবিক জনন ক্রিয়ার উৎপাদন নয়, ওনার দাবি মতো ‘ইন ভিট্রো’ ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) এর ফসল অর্থাৎ ‘টেস্ট টিউব বেবি’- তার কি প্রমাণ আছে। শিশুটির মা বেলা দেবীর ঋতুচক্র স্বাভাবিক থাকলেও তার ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্থ ছিল, স্বাভাবিক পদ্ধতি মেনে ওই মা কোনোদিনই সন্তান ধারণ করতে পারার কথা নয়। ডাক্তারি পরিভাষায় প্রাইমারি ইনফার্টিলিটি। অন্য এক চিকিৎসক তার কেসটা ডা: মুখার্জিকে রেফার করে। তিনি ওই দম্পত্তিকে একটি অভুতপূর্ব পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রস্তাব দেন। সেই সময় তিনি ওদের আরো জানিয়ে দেন যে এটি একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, এতে সাফল্যের কোনো গ্যারান্টি নেই। দম্পত্তি রাজি হয়ে যায়।
এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয় অধ্যাপক মুখার্জির নেতৃত্বে, তিনি তখন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে পোস্টেড, সপ্তাহ অন্তে বাড়ি আসতেন। উসাইট সংগ্রহ করার আগে ওভারিকে স্টিমুলেট করার জন্য গোনাডোট্রপিন ব্যবহার করা হয়। ট্রান্স ভ্যাজাইন্যাল রুটে ফ্লুইড এসপিরেট করা হয়। শেষ পর্যায়ে এমব্রাওকে লিকুইড নাইট্রোজেন ব্যবহার করে হিমায়িত করা হয়। এই কাজে ডাইমিথাইল সালফক্সাইড (ডিএমএসও) যৌগটিকে ক্রায়োপ্রটেকট্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ৫৩ দিন বাদে ভ্রূণ কে হিমায়িত অবস্থা থেকে বের করে ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ১ ঘন্টার জন্য ইনকিউবেটরে দিয়ে গলানো হয় এবং তারপরে মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বেলা দেবীর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এ সবই ডকুমেন্টেড ছিল।
সর্বোপরি অধ্যাপক মুখার্জির টিমের অন্যতম সদস্য সুনীত বাবুর বক্তব্য অনুযায়ী, ওই দম্পত্তিকে এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন যৌনমিলন থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছিল এবং ওরা সেই পরামর্শ মেনে চলেছিলেন।
ওই দম্পত্তিকে যেহেতু সশরীরে হাজির করা যায় নি সেহেতু অধ্যাপক মুখার্জির কাছে বিশেষ কোনো অপশন ছিল না। তিনি প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতোই সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন যে এই মুহূর্তে তিনি আইভিএফ এর সপক্ষে কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ দাখিল করতে পারছেন না কিন্তু কোনো জেনেটিক মার্কার তাঁর হাতে থাকলে এটা প্রমাণ করা যেত। সেই সত্তর দশকের শেষের দিকে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে এর বেশি কিছু বলা তিনি কেন, অন্য কোনও বিজ্ঞানীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
“উটের পিঠে শেষ খড়ের টুকরো”
তাঁর নিজের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করার জন্য অধ্যাপক মুখার্জি ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইমেট রিসার্চ সেন্টার আয়োজিত একটি বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। খরচ ওদের। তিনি নিয়ম মেনে বিদেশযাত্রার অনুমতি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) চেয়ে আবেদন করেন। তখনও স্বাস্থ্য ভবন তৈরি হয় নি, রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তরের ঠিকানা রাইটার্স বিলিডিং। তাঁর আবেদনপত্রের ফাইলে রাইটার্স এর কনিষ্ঠ রাইটার বাবু বা বরিষ্ঠ মন্ত্রী কি নোট দিয়েছিলেন তা জানা নেই (একদিন জানার ইচ্ছে আছে)। স্বাস্থ্য অধিকর্তার সই করা চিঠি গেল চটপট তাঁর কাছে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখের ওই চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অশেষ দুঃখের সাথে জানালেন যে তাঁর আবেদন নামঞ্জুর। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে তিনি যেন সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে দেশত্যাগ না করেন। ভাবুন একবার, অধ্যাপক মুখার্জি যেন কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানী-গবেষক নন, তিনি যেন কোনও কুখ্যাত অপরাধী যে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ধান্দায় আছে।
এই পর্যন্ত পড়ে যারা ভাবছেন যে যাক নিশ্চিত হওয়া গেল, এই গল্পের হিরো কে সেতো জানাই ছিল, এইবার ভিলেন কে সেটাও জানা গেল – তাদের জন্য তথ্য হিসেবে দু’একটা কথা। কারণ এই উপাখ্যানটি কোনো রগরগে বাজার চলতি তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্য নয়। এতে সম্পুর্ন সাদা বা সম্পূর্ণ কালো কোনো চরিত্র নেই। সবাই ডিফারেন্ট সেডস অফ গ্রে – ধূসর। স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা: ছেত্রী নিজগুনে একজন প্রোথিতযশা চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে, বাম সরকারের আগের সরকারের আমলে নিযুক্ত হলেও বাম সরকারের যথেষ্ট আস্থাভাজন ছিলেন এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।
উল্টোদিকে তদানীংতন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলের পরিচিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থেকে মন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন। প্রয়াত এই মানুষটির অতিবড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও স্বীকার করবেন যে এককথায় তিনি স্বজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। অধ্যাপক মুখার্জির এই হেনস্থার জন্য তিনি ডা: ছেত্রীর সাথে বা অন্যকারুর সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র রচনা করেছিলেন এটা ভাবা কষ্টকর। কিন্তু হেনস্থাতো হয়েছিল। তাই তার মন্ত্রকের নৈতিক দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না, যেমন পারেন না ডা: ছেত্রী।
উটের কথায় ফিরে আসা যাক। বিদেশ যাত্রা প্রত্যাখ্যান এর ওই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরে অধ্যাপক মুখার্জির হার্ট এটাক হয়। সুধী পাঠক, আপনি কি বলবেন জানি না, “দুষ্টজনে” বলে থাকে যে ওই বিদেশযাত্রা প্রত্যাখ্যান আর হার্ট এটাকের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক আছে। অসুস্থ অধ্যাপক মুখার্জি দুটি আবেদন করেন স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছে। স্পেশাল লিভ এবং বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ির কাছে বদলি। স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রথমটি নামঞ্জুর করলেও দ্বিতীয়টি মঞ্জুর করেন। তাঁকে ১৯৮১ সালের ৫ই জুন বদলি করা হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজিতে “ইলেক্ট্রফিজিওলজি” বিভাগের প্রফেসর হিসেবে। এমন একটি বিভাগ যে বিষয়ে তার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।
এটাই বোধহয় ছিল সেই প্রবাদবাক্যের উটের পিঠে শেষ খড়ের টুকরো। সরকার তাঁকে বিজ্ঞান-সম্মেলনে গিয়ে নিজের গবেষনাপত্র হাজির করার সুযোগ দেবে না, গবেষণার ফলাফল গুছিয়ে লেখার জন্য সময় বের করার ছুটি দেবে না, সহকর্মীরা করবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। উট আর বইতে পারে নি। ক্লান্ত শ্রান্ত ন্যুব্জ পিঠ ভেঙে গেছিল। তাঁর বদলির আদেশনামা বেরোনোর ৪৪ দিন পরে ১৯শে জুলাই, ১৯৮১ অধ্যাপক মুখার্জি আত্মহননের রাস্তা বেছে নেন। সুইসাইড নোটে লিখেছিলেন,”প্রত্যেক দিন হার্ট এটাক হওয়ার চেয়ে একবার হওয়া ভালো”। নোটের এই “হার্ট” শব্দটা বেছে নিয়ে তাঁর এক নিকট আত্নীয় আবেদন করেছিলেন আমাদের কাছে, “দোহাই আপনাদের, দয়া করে ওই হার্ট শব্দটার বাংলা তর্জমা করার সময় “হৃদযন্ত্র” আনবেন না, জানেন তো হার্ট এর আরেকটা বাংলা ‘হৃদয়’ ?”
“তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয় চে”—
ফিজিওলজি বা বিজ্ঞানের কোনো শাখায় কোনো বাঙালি নোবেল পান নি আজ অবধি। অধ্যাপক মুখার্জির আবিষ্কার বোধহয় সবচেয়ে কাছাকাছি সুযোগ ছিল।
পিতৃদিবসে অনেকেই তাঁর বাবাকে নিয়ে তাদের ভালোবাসা শ্রদ্ধার কাহিনী শুনিয়েছেন। আমার অদেখা এই মানুষটিকে আজ স্মরণ করলাম যিনি ডা: আনন্দ কুমারের ভাষায় ছিলেন ভারতের তথা এশিয়া মহাদেশের প্রথম নলজাতকের “সাইন্টিফিক ফাদার”। গবেষণা পাগল নিঃসন্তান এই মানুষটি আমাদের জন্য যে লিগ্যাসি রেখে গেছেন তা হল এই যে আমরা বাঙালিরা, ভারতীয়রাও পারি।
তার জীবন কেবল কতগুলি কুচক্রী মানুষের হাতে এক প্রতিভাবান এর মৃত্যুর উপাখ্যান নয়। বাঙালি তথা ভারতীয়রাও যে চেষ্টা করলে বিজ্ঞানেও নোবেল পেতে পারে সেই আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়ার জন্যই তাঁর জীবনের কাছে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যাবো বার বার দু হাত জড়ো করে তাঁর আশীর্বাদ পেতে।
PrevPreviousতুষার-শার্দুল
Nextএকজন উদীয়মান ওসির গল্পNext
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত পোস্ট

রিটায়ার্ড

September 21, 2023 No Comments

সব কোলাহল থেমে গেল। যাকে বলে পিন পতন স্তব্ধতা! নিউটাউনের ফ্ল্যাটে এসে দেখি ওরা নেই। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করতে বলল, – “দাদা, ইলাহি কারবার। কমিউনিটি হলে আছে

খুপরির গল্প ১৪: অভিনয়

September 21, 2023 No Comments

রোজ কত কিছু ঘটে যায়, লেখা হয় না। আসলে লেখার ইচ্ছেও হয় না। খুপরি জীবন ভয়ানক একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। বিচিত্র কত অসুখ, মানুষের কত অসহায়তা,

এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার জন্য ঘুষ

September 21, 2023 No Comments

অনেকে অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু কথার দাম বা মূল্যবোধ যদি এই বাজারেও কোনও একটা ফিল্ডে, সাধারণভাবে, অটুট থেকে থাকে, তাহলে সেটা যাকে বলে দু-নম্বরির

রূপ

September 20, 2023 No Comments

এক সময় এই গানটা মাইকে হেব্বি বাজতো, ‘চেহেরা কেয়া দেখতে হো, দিল মে উতর কর দেখো না।’ কুমার শানু, আশা ভোঁসলে। কিন্তু ভালো কথা কানে

The Crazy Pavement: A Cocktail Journey to Poet-Hood

September 20, 2023 No Comments

A Non-sense Novelette Chapter 11 A Dizzy Conquest With Paharida’s patronage Srirup’s ascendancy in the literary world was now fairly rapid. Would-be poets in book

সাম্প্রতিক পোস্ট

রিটায়ার্ড

Dr. Arunachal Datta Choudhury September 21, 2023

খুপরির গল্প ১৪: অভিনয়

Dr. Aindril Bhowmik September 21, 2023

এমবিবিএস পরীক্ষায় পাস করার জন্য ঘুষ

Dr. Bishan Basu September 21, 2023

রূপ

Dr. Indranil Saha September 20, 2023

The Crazy Pavement: A Cocktail Journey to Poet-Hood

Dr. Asish Kumar Kundu September 20, 2023

An Initiative of Swasthyer Britto society

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

Contact Us

Editorial Committee:
Dr. Punyabrata Gun
Dr. Jayanta Das
Dr. Chinmay Nath
Dr. Indranil Saha
Dr. Aindril Bhowmik
Executive Editor: Piyali Dey Biswas

Address: 

Shramajibi Swasthya Udyog
HA 44, Salt Lake, Sector-3, Kolkata-700097

Leave an audio message

নীচে Justori র মাধ্যমে আমাদের সদস্য হন  – নিজে বলুন আপনার প্রশ্ন, মতামত – সরাসরি উত্তর পান ডাক্তারের কাছ থেকে

Total Visitor

451078
Share on facebook
Share on google
Share on twitter
Share on linkedin

Copyright © 2019 by Doctors’ Dialogue

wpDiscuz

আমাদের লক্ষ্য সবার জন্য স্বাস্থ্য আর সবার জন্য চিকিৎসা পরিষেবা। আমাদের আশা, এই লক্ষ্যে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও আপামর মানুষ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের আলোচনা ও কর্মকাণ্ডের একটি মঞ্চ হয়ে উঠবে ডক্টরস ডায়ালগ।

[wppb-register]