পূর্ব প্রকাশিতের পর
[ক্যামেরার লেন্স পুরো খোলা। অন্ধকারের পরে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ধীরে ধীরে লেন্সের অ্যাপারচার ছোটো হয়। হাই লং শট।একটা গাছের তলায় বিনয় বসে আছে। জামা ঘামে ভেজা, গায়ে সেঁটে আছে। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে বসে আছে জনা পনেরো নারী পুরুষ। একজন মনে হয় শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা, তার পরণে প্যান্ট শার্ট, চোখে রঙিন চশমা। তার নাম মহাদেব মুর্মু। চল্লিশের কাছে বয়স। বাকিরা সবাই ধুতি, খালি গা বা গায়ে পিরান।মেয়েদের পরণে শাড়ি, ব্লাউজ। ক্যামেরা ক্রমশঃ বিনয়ের মুখের ক্লোজ আপে আসে।]
বিনয়|| আমাদের দেশে গরীব মানুষ বেশী….অনেক বেশী… এদের বেশীরভাগ তোমাদের মতো… আদ্ধেক দিন খেতে পায় না….শুখা মাটি….আগামীকাল কী খাবে জানে না।
[কাট। ক্যামেরা মাটিতে ট্রলিতে ঘুরতে থাকে। ফোকাসে বিনয়।ওয়েস্ট শট।]
বিনয়|| কোনোদিন, কোনো সরকার….কোনও নেতা গরীবের কথা ভাবে নি…..সেই রাজনীতির প্রথম থেকে।
[কাট। ক্যামেরা বিনয়ের পেছন থেকে বাকিদের মুখে ঘুরতে থাকে। বিনয়ের গলা শোনা যায়]
বিনয়|| ….য্যামন ধরো বিলিতি কাপড় পুড়িয়ে ফ্যালো… স্বদেশী জিনিস পরতে হবে… মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন। কিন্তু তখনও দেশের ভেতরে এ্যাতো কাপড় তৈরি হতো না যে সবাই দেশী মোটা কাপড় কিনে পরতে পারবে। গান বাঁধা হলো ….ইয়ে….মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই….মা যে মোদের….মোদের… দীন দুখিনী, তার বেশী আর সাধ্য নাই।
[একজন বিড়ি দু আঙ্গুলে ঘুরিয়ে আগুন ধরায়। মহাদেব আগুনের জন্য হাত বাড়ায়।]
জমায়েতের একজন প্রশ্ন করে||[ক্যামেরা তার মুখে জুম করে] বিনুদা, তাইলে ঐ সব কর্যাঁ কী লাভ হল্যোঁ বট্যেঁ?
[ক্যামেরা আবার ফিরে লং শটে যায়।]
বিনয়||জানি না। প্রচুর মানুষ গুলি খেয়ে মরলো। নিশ্চয়ই ব্রিটিশদের স্বার্থে লেগেছিলো। তখন সারাভাই আর বিড়লাদের কাপড়ের মিল ছিলো। বলা হয় গান্ধীজি ঐ সব মালিকদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছিলেন।
[ক্যামেরা ক্লোজে বিনয়কে ধরে]
মহাদেব|| আমি একটা কথা বুইলবোঁ? [ক্যামেরা মহাদেবকে ক্লোজআপে নেয়]
তাবল্যাঁ তুমি জাতির জনকের বিষয়ে এ্যামুন কথা বৈলবে ?যে স্বাধীনতার লেগে এ্যাতো লড়াই করল্যো?
(ওর চোখে তীব্র আক্রোশ। একবার ডান হাত মুখের কাছে এনে ঘড়িটা দেখে ন্যায়)
[ক্যামেরা প্যান করে’ সরে যায়।লং শট]
বিনয়|| দ্যাখ মহাদেব, তোর প্রশ্নটা খুব ভালো। কিন্তু ভগৎ সিংয়ের নাম শুনেছিস তো? শহীদ ভগৎ সিং? গোটা দেশ চেয়েছিলো বাপুজি মানে গান্ধীজি একবার ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করুন….ওর মুক্তির জন্য। উনি করেন নি। ভালো কথা শত্রুর কাছে অনুরোধ করার দরকার নেই। কিন্তু সুভাষ বোসের আক্রমণে যখন ব্রিটিশদের গদি টলমল……তখন তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ হেরে গেলে যখন নৌবাহিনীর ভারতীয় নাবিকরা বিদ্রোহ করে হেরে গ্যালো, সবাই শাস্তির মুখে পড়লো….তখন গান্ধী ওদের সমর্থন করেন নি।….
[বিনয় দৃশ্যতঃই উত্তেজিত। ওর গলা উচ্চগ্রাম। ও একটা বিড়িতে আগুন দিয়ে ঠোঁটে তোলে ক্যামেরা ক্রমশঃ বিনয়কে ক্লোজআপে নেয়]
জিন্নাহ আর নেহেরু যখন দেশ ভাগাভাগি করে তখন কিন্তু গান্ধী সেটা চান নি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছুই বলেন নি….হ্যাঁ স্বপক্ষেও কিছু বলেন নি। কংগ্রেস ভেঙে দিতে বলেন। তার পরে পরেই ওনাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যে দুটো প্রদেশে সব থেকে বেশী স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে…..সেই দুটোকেই কেটে দু টুকরো করা হয়।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মানে (বিনয় বিড়িতে টান দ্যায়) জানো?তখন ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হলো।…লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গ্যালো। দুটো ধর্মের মানুষ চিরকাল মারামারি করবে….দুটো দেশ চিরকাল লড়াই, যুদ্ধ করতে থাকবে। কোনদিন কেউ আর মানুষের বেসিক নীড….মানে খাওয়া পরা বাসস্থান নিয়ে ভাববে না। অস্ত্র কেনার জন্য সেই সাহেবদের দিকে তাকিয়ে থাকবে….অস্ত্র কিনবে, যুদ্ধ করবে, সেনাবাহিনী কে মাইনে দেবে…..মানুষ আরও নিঃস্ব হবে, এটা অন্য রকম একটা পরাধীনতা… ঔপনিবেশিকতা (আকাশে চীল ডাকে, দূরে একটা গাড়ির আবছা আওয়াজ শোনা যায়)…….মানুষ যতই গরীব হবে… যতই গরীব হবে….ততই সে দুঃখ ভুলতে নেশা করবে…
[ক্যামেরা ধীরে ধীরে লং শটে চলে যায়, গোলাকৃতি মানুষ আর বিনয়কে একপাশে রাখে, পেছনে পশ্চাৎপট হয় জঙ্গল]
সরকার সেটাই চায়….ততই সে বাঁচার মরীয়া আশায়….সুখের আশায় মন্দির গড়বে… মসজিদ….ধর্ম….মারামারি… বিভেদ।(গাড়ির শব্দ কাছে আসছে, আকাশে চীলের ডাকের শব্দও তীব্রতর। চীল বোধহয় শিকার দেখেছে।) তাই আমাদের মদের ঠেক বন্ধ করতেই হবে। যতো প্রাণ যায়, যাক্। আমাদের একটা সমবায় গড়ে তুলতে হবে….যেখানে একটা মানুষ তার বাড়তি টাকা রাখতে পারবে।শস্য….
[জঙ্গল থেকে একটা জিপ ধুলো উড়িয়ে প্রায় বিনয়ের গায়ের ওপর দাঁড়ায়। কয়েকজন পুলিশ নেমেই ছোট্ট জমায়েতে লাঠি চালাতে থাকে। একজন পুলিশ বিনয়ের কলার ধরে দাঁড় করায়।ক্যামেরা বিনয় আর পুলিশের লোকটাকে ফোকাস করে]
বিনয়||কোন অধিকারে….কোন অধিকারে আপনারা এই শান্তিপূর্ণ মিটিংয়ে হামলা করছেন?
পুলিশ||সালা খালভরা, তোর অধিকারের পিছন মের্যাঁ দুব্যো….খানকির বাছ্ছা
(একটা সজোরে থাপ্পড় খেয়ে বিনয় ছিটকে পড়ে।আরও দু তিনজন পুলিশ এসে লাথি মারতে থাকে)
[ক্যামেরা বিনয়ের যন্ত্রণা কাতর মুখের ক্লোজআপ ধরে]
বিনয়||কথা বলা আমাদের গণতান্ত্রিক…(মুখে লাথি এসে পড়ে)
[ফেড আউট]
একটা গলা শোনা যায়||আপনাকে ইউএপিএ ধারায় দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হলো।
[ক্যামেরা থানার ভেতরে। আধো অন্ধকার। লং শট। আলুথালু মণীষা থানার টেবিলে চাপড় মারছ]
মণীষা||আমার স্বামীকে আপনারা কোন সাহসে… গায়ে হাত তুলেছেন? (ওর গলার শিরা ফুলে ওঠে)
[মিড শটে ওসি আর মণীষা]
ওসি||আপনার স্বামী বট্যেঁ? বিহাটা কুথায় হল্যঁ গো ডাক্তারণী?কতক দিন ফুর্তি মারাঁইছেন….ব্যস ফুট্যেঁ পড়ুন। এর পর দিনকে বন্ধুক রাখার চার্জে তুলে আনা কইরবো…. দেশদ্রোহীকে থাকতে দিল্যেঁও পাপ বটে….
[ক্যামেরা ঘুরে ওসির পেছনে যায়। মণীষা একটু ব্যাকফুটে।ক্যামেরা একটু প্যান করে বাঁ দিকে। বাঁ দিকে জানালা। মণীষার মুখে আলো এসে পড়ে]
মণীষা||ইউএপিএতে ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি সেক্রেটারির সই করা অর্ডার লাগে। সেটা কোথায়?
[ক্যামেরা ওসির মুখে ফোকাস করে]
ওসি||যাঃহ উসব অর্ডার কোর্টে গিঁয়্যা চাইবে ক্যেনে… এই ওই শূয়ারের বাছ্ছাটাক্যেঁ লকআপে ঢোকা…
[ক্যামেরা ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে থাকা বিনয়ের ওপরে জুম করে।ও হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছিলো। কোমরের দড়িতে টান দিয়ে পুলিশ ওকে লকআপে ঢোকায়। কাট। ক্যামেরা ওসির পেছন থেকে থানার দরজার দিকে ফোকাস করে। মণীষা বেরিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা স্টিল ফটো হয়ে গেছে। মণীষাই একমাত্র মুভিং অবজেক্ট]
ওসির কন্ঠ শোনা যায়||যা ক্যানে যেখানে পারিস। ছেঁড়া যাবেক আমার….সাল্লা ভারভারা… না কে বট্যেঁ সে কিছু কঁইরতে লারলো… ইতো সালা বাজারি মিয়্যাছেলে….
[কাট। ক্যামেরা ওয়াইড লং শটে জঙ্গলের পথে মণীষার চলে যাওয়া দেখায়। আস্তে আস্তে সকলের নাম স্ক্রোল করে যায়]