গেল নভেম্বরের চার তারিখ। দেওয়ালীর দুপুর। গ্যাংটকের রাস্তায় মেল্লিতে নেমেছিলাম তিস্তার ওপর জীবনের প্রথম র্যাফটিং এর জন্য। গাইডের অকুতোভয়ে সাঁতার না জানা সহধর্মিণীও লাইফ জ্যাকেট পরে তৈরি । কিন্তু প্রথম মাইল অতিক্রম করার পরই রাক্ষসী ঢেউয়ের করালতায় রাবারের নৌকো গেল উল্টে। প্রবল ঠান্ডা জলে ডোবার মুহূর্তে কারুর একটা পদচালনায় আরো গভীরে ডুবে গেলাম। প্রবল স্রোত আর কনকনে ঠান্ডায় যখন মাথা তুললাম তখনই আবার একটা প্রবল ঢেউয়ের ঘূর্ণিপাকে নিচে নিয়ে গেলো খানিক। দ্বিতীয়বার মাথা তুললাম বটে। কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। রবারের নৌকা, বাকি সাথীরা সবাই যেন মুহূর্তে অতীত। চরম স্রোতের মাঝ বরাবর ভেসে চলেছি আমি। গভীর বনানী। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি প্রায় আধা কিলোমিটার পেছনে সহধর্মিণীর “হেল্প,হেল্প” আর্তচিৎকার। বুকের অদ্ভুত দংশনে পা চালিয়ে সাঁতরাতে যেতেই হাঁটুতে পাথরের প্রবল ধাক্কায় অবশ হয়ে গেল ডান পা। মল্লিকা সাঁতার জানে না। লাইফ জ্যাকেট যদি খুলে যায়? সর্বনাশা বিপদের গন্ধ পাওয়ার পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উপক্রম। অসহায়তার ক্লেদাক্ত রূপ সেদিন অনুভব করেছিলাম আমি।
জম্পেশ সাঁতারু হয়েও স্রোতের টানে শৈশবের সে শিক্ষা যৎকিঞ্চিৎ। নদীর বাঁকে অদৃশ্য হলো মল্লিকা। আবারও ঘূর্ণিপাকে একঝটকায় আমাকে নিচে টেনে নিলো তিস্তা। প্রাণপণে ভেসে যখন উঠলাম তখন আবার এক বাঁকের কোলে আমাদের রাবারের নৌকাকে দেখে স্বস্তি হলো ঠিকই, কিন্তু যাবো কি করে? মাঝবরাবর নদীর প্রবল স্রোতে টেনে নিয়ে চলেছে আমায়। সামনে অনেক পাথরে ধাক্কা খেয়ে নদী নেমেছে খানিক নিচে। ওখানে পড়লে সর্বনাশ। শরীরের অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে নৌকার অভিমুখে পা চালালাম।অবশেষে উদ্ধার করে পাড়ে তুললো বাকিরা।
নিজ জীবনে এ অভিজ্ঞতা প্রথম হলেও গ্রামবাংলার চিকিৎসক হিসেবে জলডুবির রোগী কম দেখিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কচি কাঁচারা বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে এ দুর্ঘটনার শিকার হতো। মাদক সেবনে বোমভোলে রোগী বা অভাগা মৃগীর অ্যাটাকে বড়দেরও জলডুবি হতে দেখেছি। আত্মহত্যার উপায় হিসেবেও এ পদ্ধতির ব্যবহার গ্রামবাংলার বুকে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
জলে ডোবা রোগীকে উদ্ধারের পর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে মুখ একদিকে কাত করে দিন যাতে মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জল শ্বাসপথে ঢুকে বিপত্তির সৃষ্টি না করে। রোগীর পরনের ভেজা কাপড়গুলো খুলে দিন যাতে শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়ে অতিরিক্ত বিপত্তি না ঘটায়। পারলে গরম কাপড়ে শরীর ঢেকে দিন। এরপর দেখুন, অজ্ঞান রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে কিনা এবং নাড়ির স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে কিনা। যদি সব স্বাভাবিক থাকে তাহলে পেটের ওপর হালকা চাপে মুখ থেকে কিছু জল বেরিয়ে এসে রোগীকে স্বাভাবিক করতে বেশি সময় নেবে না। একাধিক চাপে অধিকাংশ সময়েই শ্বাসপথরোধকারী জলের নিষ্ক্রমণ প্রাণের পুনঃপ্রকাশ ঘটায়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় যদি শ্বাসপ্রশ্বাস, বা নাড়ির স্পন্দন না পান? সেখানেই প্রাথমিক চিকিৎসার জরুরি প্রয়োগ একটা প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারে। আসুন শিখে নিই সেই প্রয়োগ পদ্ধতি।
পরিস্থিতি ১ রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ কিন্তু নাড়ি সচলঃ
এমতাবস্থায় রোগীর ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে চিবুকের নিচে উর্ধ্বমুখি ঠেলা দিয়ে রোগীর মুখে নিজের মুখ লাগিয়ে জোরে নিজের শ্বাসবায়ু রোগীর ফুসফুসে ভরে দিন যাতে রোগীর বুক আপনার দেওয়া শ্বাসবায়ুর ঠেলায় ফুলে ওঠে।প্রয়োজনে নিজের মুখ ও রোগী র মুখের মধ্যে হাওয়া চলাচলে সক্ষম এরকম কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করতে পারেন। এরকম প্রত্যেক মিনিটে ১০ থেকে ১২ টি শ্বাস দিতে হবে। প্রত্যেক দুই মিনিট অন্তর নাড়ি ও শ্বাস পরীক্ষা করতে থাকুন যতক্ষণ না স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
পরিস্থিতি ২ রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস ও নাড়ি দুইই অচলঃ
সেক্ষেত্রে রোগীর বুকের মাঝবরাবর বাম হাতের তালু রাখুন ও তার ওপর ডানহাতের তালু রেখে বুকের ওপর চাপ দিন যাতে হৃৎযন্ত্র চাপ পেয়ে কৃত্রিম ভাবে রক্তসঞ্চালন করতে পারে। চাপের ঠেলায় যেন রোগীর বুক অন্তত দুই ইঞ্চি অবধি ডেবে যায়। প্রত্যেক তিরিশ বার বুকের সংকোচনের পর দুইবার মুখে মুখ লাগিয়ে বুক ভরে শ্বাসবায়ু দিন। মিনিট প্রতি অন্তত ১০০ বার বুকের সংকোচন জরুরি। প্রত্যেকবার নাড়ি পরীক্ষা করে নাড়ির স্বাভাবিক গতি ফিরে এসেছে কিনা পরীক্ষা করুন।
মনে রাখবেন এগুলি শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা। এই পদ্ধতি প্রয়োগ কালেই তড়িঘড়ি নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া একান্ত জরূরী।
যদিও রিভার র্যাফটিংএর বেলায় সহধর্মিনীর এসব কিছুই দরকার হয়নি। পরবর্তী নৌকা ওকে অবসন্ন, প্রায় জ্ঞানহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছিলো।
প্রাথমিক চিকিৎসার এই প্রয়োগ প্রাণ বাঁচানোর জন্য অত্যাবশকীয় কৌশল। জেনে রাখলে বাঁচবে প্রাণ। চিত্রগুপ্তের ক্লান্তি কিছুটা লাঘব হবে বৈকি।