বাচ্চাদের শ্বাসকষ্ট নিয়ে লিখতে বসলেই চোখের সামনে কোভিডকালের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা ভেসে ওঠে। কোভিড ওয়ার্ডগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। কেউ হাঁফাচ্ছে, কারো গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, কেউ বমি, পাতলা পায়খানা আর পেটের ব্যথায় কাহিল। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সংখ্যা নেহাতই অপ্রতুল। হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি। কোনো বাচ্চাকে অক্সিজেন দিতে গেলে আগে পাঁচবার ভাবতে হয়। মূল হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় কোভিডের চিকিৎসা হচ্ছিল। পিপিই-র অসহ্য কষ্ট সহ্য করে আমরা চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়েছি। বাইরে পরিজনের উৎকণ্ঠা ভরা চোখ। এখনও ভাবলে আতঙ্ক হয়। প্রায় একইরকম একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল গত বছর সাংঘাতিক অ্যাডিনোভাইরাস সংক্রমণের সময়। সেই শ্বাসকষ্ট. . . রাত জাগা. . . নির্ঘুম চোখ। শিশুদের শ্বাসকষ্ট, চিকিৎসক এবং পরিজন সবার কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। আজকের আলোচনায় শিশুদের শ্বাসকষ্ট সম্পর্কে খুব সহজ ভাষায় অল্প কিছু কথা জেনে নেব।
শিশুদের শ্বাসকষ্ট কেন হয়?
দীর্ঘ আলোচনায় যাব না। সাধারণ কারণগুলোর ওপরেই জোর দেব। শ্বাসকষ্টের কথা ভাবলেই, প্রথমে যে অঙ্গটির মাথায় আসে, সেটি হল শ্বাসযন্ত্র। শ্বাসযন্ত্রের ওপরের দিকে নাক, ল্যারিংস, টনসিল, ভোকাল কর্ড ইত্যাদি জায়গায় সংক্রমণ হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এসব জায়গায় কোনো মাংসপিণ্ডের মতো কিছু ফুলে উঠলে, জন্মগত সমস্যা থাকলে, পুঁতি, মটর বা বোতামের মতো কিছু আটকে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। ফুসফুসের যাবতীয় সংক্রমণ শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়া (ভাইরাস, সাধারণ ব্যাকটিরিয়া, টিবি ইত্যাদি), ব্রঙ্কিয়োলাইটিস, ফুসফুসের পর্দা বা প্লুরার মধ্যে জল, হাওয়া, পুঁজ, রক্ত ইত্যাদি জমে যাওয়া, হাঁপানি, অনাক্রম্যতার বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসে বায়ুবাহিত বিভিন্ন দূষিত পদার্থ জমে যাওয়া ইত্যাদি শ্বাসকষ্টের কারণ। শ্বাসকষ্ট মানে শুধুই শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা নয়। বিভিন্ন ধরনের হৃদ্যন্ত্রের রোগ, মস্তিষ্ক সংক্রমণ, রক্তশর্করা বেড়ে যাওয়া, রক্তে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি, ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্র বা মস্তিষ্কে আঘাত, পেটে জল জমে যাওয়া, ফুসফুসে রক্তবাহের রাস্তা আটকে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
নবজাতকের শ্বাসকষ্টের কারণগুলোও কি একইরকম?
নবজাতকের শ্বাসকষ্টের কারণ একটু আলাদা। উপরোক্ত শ্বাসকষ্টের কারণগুলোর মধ্যে বেশ কিছু নবজাতকের জন্যও প্রযোজ্য। কিছু বিশেষ রোগ কেবল নবজাতক অবস্থাতেই দেখা যায়। এর মধ্যে জন্মগত অঙ্গবিকৃতির ব্যাপারগুলো আসবে। জন্মগতভাবে চোয়ালের হাড় ছোটো বা ভেতরের দিকে ঢুকে থাকলে, নাকের পেছনের অংশ চামড়া দিয়ে বন্ধ থাকলে, অস্বাভাবিক বড়ো জিভ, গলার কাছে বড়ো কোনো মাংসপিণ্ড বা জলভরা থলি থাকলে, পেটের নাড়িভুঁড়ি বুকের খাঁচায় উঠে এলে, শ্বাসনালি ও গ্রাসনালির মধ্যে অস্বাভাবিক সংযোগ থাকলে, বুকের খাঁচার গঠন ত্রুটিপূর্ণ হলে শ্বাসকষ্ট হয়। অপরিণত শিশুর ফুসফুসের পৃষ্ঠটান কমানোর জন্য এক ধরনের তরলের অভাবে শ্বাসকষ্ট হয়। শিশু মায়ের পেটের মধ্যে থাকাকালীন পায়খানা করে ফেললে সেই দূষিত জল ফুসফুসে ঢুকে শ্বাসকষ্ট হয়। পরিণত শিশুদের বিশেষত সিজারিয়ান সেকশন হলে এক ধরনের সাময়িক শ্বাসকষ্ট হয়। এ ছাড়া রক্তে শর্করা কমে যাওয়া, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, রক্তাল্পতা বা রক্তাধিক্য, মস্তিষ্ক সংক্রমণ, রক্তের বিভিন্ন আয়নের তারতম্য ইত্যাদি কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বুঝব কীভাবে?
শ্বাসকষ্ট বোঝার জন্য শিশু ও নবজাতকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল স্কেল আছে। সেগুলোর নিখুঁত ব্যবহারে শ্বাসকষ্ট আছে কি না এবং থাকলে তার ভয়াবহতা কতটা সেটা বোঝা যায়। বর্তমান আলোচনায় আমরা শুধু সাধারণ উপসর্গগুলোর দিকে নজর রাখব। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি থাকলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বুঝব—শ্বাসের গতি বেড়ে গেছে, গলার নীচের দিক বা বুকের পাঁজর ভেতরের দিকে ঢুকে আসছে, ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চা শ্বাস নেওয়ার সময় আওয়াজ করে শ্বাস নিচ্ছে বা ছাড়ছে ইত্যাদি। দু-মাসের নীচের বাচ্চার ক্ষেত্রে শ্বাসের হার মিনিটে ষাটের বেশি, দু-মাস থেকে এক বছর অব্দি পঞ্চাশের বেশি, তার পর থেকে পাঁচ বছর অব্দি মিনিটে চল্লিশের বেশি শ্বাসের হার হলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বুঝব। সঙ্গে পালস অক্সিমিটার থাকলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে কি না দেখে নেওয়া যায়। এ ছাড়া (স্টেথোস্কোপে শুনে) বুকের দু-দিকে সমানভাবে হাওয়া ঢুকছে কিনা, শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে বাঁশির মতো বা বুদবুদ ফাটার মতো শব্দ হচ্ছে কিনা, এগুলো দেখে শ্বাসকষ্ট বোঝা যায়। যদিও স্টেথোস্কোপে শুনে বোঝার ব্যাপারটা মূলত চিকিৎসকের কাজ।
হৃদ্যন্ত্রঘটিত বা ফুসফুস ছাড়া অন্যান্য অঙ্গজনিত শ্বাসকষ্টও কি এভাবেই বোঝা যাবে?
হৃদ্যন্ত্রঘটিত শ্বাসকষ্ট একটু অন্যরকম হয়। বাচ্চা ভালোভাবে বুকের দুধ টানতে পারে না। দুধ খেতে খেতে বারবার ছেড়ে দেয়। ওজনে বাড়তে সমস্যা হয়। কপাল ঘামতে পারে। পেটের ডানদিকে হাত দিয়ে লিভার বেড়ে যাচ্ছে কিনা দেখতে হয়। ঠোঁট নীল হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসক স্টেথোস্কোপে শুনে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পারেন।
শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এমন বাচ্চার শ্বাসযন্ত্র আর হৃদ্যন্ত্র পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছু না পেলে শ্বাসকষ্টের অন্যান্য কারণ যেমন, রক্তে অ্যাসিড জমে যাওয়ার কারণগুলো ভাবতে হবে। এই সমস্যায় বাচ্চার শ্বাসের গতি এবং গভীরতা একসঙ্গে বৃদ্ধি পায়।
শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এমন বাচ্চার জন্য বিশেষ কোনো পরীক্ষা লাগে?
শ্বাসকষ্টের কারণ বুঝতে বিভিন্ন পরীক্ষার দরকার হতে পারে। চিকিৎসক ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য যে যে কারণ সন্দেহ করবেন সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে হবে। রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান, ইসিজি, ইকোকার্ডিয়োগ্রাফি, বুক বা পেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, পালমোনারি ফাংশন টেস্ট ইত্যাদি পরীক্ষা দরকার হতে পারে। নবজাতকের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের কারণ অনুযায়ী নাক বা গলা দিয়ে নল ঢুকিয়ে এক্স-রে তোলার দরকার হতে পারে।
শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা কীভাবে হবে?
সাধারণ মানুষ শ্বাসকষ্ট হলেই চিকিৎসা বলতে অক্সিজেন বোঝেন। আসলে ব্যাপারটা ওরকম নয়। কী কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার ভিত্তিতে চিকিৎসা বদলে যায়। শ্বাসনালী ফোলানোর ওষুধ, স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক, মূত্রের পরিমাণ বাড়িয়ে শরীরে জমা জল বের করার ওষুধ, রক্তচাপ কমানো বা বাড়ানোর ওষুধ, ফুসফুসের পৃষ্ঠটান কমানোর ওষুধ ইত্যাদি নানারকম চিকিৎসার দরকার হতে পারে। প্রয়োজনে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে চিকিৎসা করার দরকার হতে পারে। অস্ত্রোপচার লাগবে এমন রোগগুলির ক্ষেত্রে দ্রুত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার বা নেবুলাইজার মেশিন দিয়ে চিকিৎসা কতটা নিরাপদ? পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে কি?
প্রথমেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা ভালো যে ওষুধের সুস্পষ্ট ক্রিয়া আছে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও থাকতে বাধ্য। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা একটি বিশুদ্ধ সোনার পাথরবাটি। ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা’ একটা নির্জলা মিথ্যে কথা। এর মানে সংশ্লিষ্ট ‘ওষুধে’ আদৌ কোনো সক্রিয় উপাদান নেই অথবা সে সম্পর্কে কোনো গবেষণাই হয়নি। গবেষণা না হলে তার সম্পর্কে কোনোদিন তথ্য উঠে আসবে না। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নিজেকে পরীক্ষার মুখোমুখি বসায় এবং বলার মতো দোষ খুঁজে পেলে নিজেকে বদলায়। প্রয়োজন হলে ওষুধ বাতিল হয়। বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়।
এবার আসি, শ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। বাচ্চাকে শ্বাসের মাধ্যমে শ্বাসনালি ফোলানোর যে ওষুধ দেওয়া হয় (ধরা যাক, সালবুটামল) এবং সিরাপ/ট্যাবলেটের মাধ্যমে যেটা দেওয়া হয়, সে দুটো একই ওষুধ। মুখে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে দিলে লিভারে গিয়ে তার সিংহভাগই নষ্ট হয়ে যায়। বাদবাকি ওষুধটার সামান্য অংশ শ্বাসযন্ত্রে পৌঁছোয়। ফলে মুখে খাওয়ার ওষুধের কার্যকারিতা কম বরং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। অপরদিকে একই ওষুধ শ্বাসের মাধ্যমে দিলে অনেক কম পরিমাণ ওষুধ প্রয়োগ করা যায় এবং সেটা সরাসরি শ্বাসযন্ত্রে পৌঁছে দেওয়া যায়। কাজেই শ্বাসের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ অনেক নিরাপদ এবং কার্যকরী। সারা পৃথিবীতে শ্বাসনালি সংকোচনজনিত শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা এভাবেই হয়। কাজেই, বাচ্চার ইনহেলার বা নেবুলাইজার মেশিন দিয়ে চিকিৎসার দরকার হলে ভ্রান্ত ধারণা দূরে সরিয়ে নির্ভয়ে প্রয়োগ করুন। তবে অবশ্যই পাশ করা ডাক্তারের পরামর্শে।
স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা কি নিরাপদ?
স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অন্যতম স্তম্ভ। স্টেরয়েডের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা খুব কমই আছে। আবার তার অযৌক্তিক ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। মোদ্দা কথা, স্টেরয়েড একটা ছুরির মতো। যার নিজে থেকে খারাপ বা ভালো কোনোটাই করার ক্ষমতা নেই। ছুরি দিয়ে সবজি কাটা হবে নাকি গলা কাটা হবে সেটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। উপযুক্ত চিকিৎসকের হাতে স্টেরয়েডের ব্যবহার হলে নির্ভয়ে বাচ্চাকে দিন।