সংলাপ ১
.
— ডাক্তারবাবু, একজিমা নয়তো?
— হ্যাঁ, একজিমাই তো।
— কি সব্বোনাশ! একজিমা?
— সব্বোনাশ? কেন, সর্বনাশের কী হল?
— একজিমা মানেই সারবে না। হাঁপানি হবে। নোংরা রোগ একটা।
— সারবে তো! না সারার কী আছে। আর হাঁপানি? হ্যাঁ, আপনার বাচ্চার যে একজিমা হয়েছে সেটার নাম অ্যাটোপিক একজিমা। অ্যাটোপি সারা দেহের একটা রোগ। যাদের অ্যাটোপিক একজিমা হয় তাদের হাঁপানি হবার সম্ভাবনা একটু বেশিই থাকে।
— তাহলে কি ওর একজিমার চিকিৎসা করাব না? মানে বলছিলাম কি, হোমিওপ্যাথি দেখাই?
— কেন? সব ব্যাপারেই তো আমাদের, মানে আপনার ভাষায় অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারদের দেখান। হঠাৎ হোমিওপ্যাথির ওপর ভক্তি?
— মানে শুনেছি তো অ্যালোপ্যাথিতে স্টেরয়েড দেয়…
— তা দেয়। তো?
— স্টেরয়েড! মানে, এক্কেবারে স্টেরয়েড? খুব জোরালো ওষুধ যে ডাক্তারবাবু, ঐটুকু বাচ্চাকে দিলে সে কি আর…
— বাচ্চাকে তো বাচ্চার ডোজেই স্টেরয়েড দেওয়া হবে, বড়দের মাপে তো আর নয়। সেটুকু বাচ্চারা সবাই সহ্য করতে না পারলে স্টেরয়েড ওষুধটাই বাচ্চাদের জন্য কবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিত।
— ইঞ্জেকশন দেবেন নাকি?
— না। ইঞ্জেকশন দেবার দরকার হয় না বললেই চলে।
— তবে সিরাপ?
— তাও এখন দেব না। দেব মলম।
— মলম তো বাইরের থেকে চিকিৎসা। আপনি যে বললেন এই রোগটা সারা দেহের?
— মলম চামড়ার মধ্যে দিয়ে দেহের মধ্যে গিয়ে কাজ করে। অসুখ যেটুকু চামড়ায়, মলম সেটুকু চামড়ায় দিলেই চলে। ইঞ্জেকশন দিলে সাধারণত সারা শরীরেই ওষুধটা ছড়িয়ে পড়ে, মলমে কেবল দরকারের জায়গায়।
— মলম চামড়ার মধ্যে দিয়ে দেহের ভেতরে চলে যায়? তাহলে তো ইঞ্জেকশনের মতোই হল যে, ডাক্তারবাবু। আপনি বলুন, এরকম স্ট্রং ওষুধ, তারপর ইঞ্জেকশন না হলেও অনেকটা ইঞ্জেকশনের মতোই… ঐটুকু তো বাচ্চা…
— কী জ্বালা! মলম আবার ইঞ্জেকশনের মতো হতে যাবে কেন। মলম মলম, আর ইঞ্জেকশন হল ইঞ্জেকশন। আরে, ঘাবড়ে গেলেন নাকি। না, না, মজা মারছি না। আচ্ছা বলুন তো, এই একটা টিউব মলম, এতে কতোটা ওষুধ থাকে?
— বলতে পারলে তো আমিই আপনার চেয়ারটায় বসতাম।
— আরে, আপনি এবার বোধহয় রেগেই গেছেন। আচ্ছা, আমি বলছি। একটা ইঞ্জেকশনে যতটা ওষুধ থাকে, ধরে নিন তার ছোটো এক অংশ থাকে এই গোটা টিউবে।
— তাতে কী?
— তাতে এই যে, মলমটা আপনার মেয়ে লাগাবে দশদিন কি পনেরো দিন ধরে। ইঞ্জেকশন দিলে রোজ ধরুন গোটা একটা ইঞ্জেকশন দিতে হতো। একটা ইঞ্জেকশনে একদিনে যতোটা ওষুধ বাচ্চার শরীরে যেত তার একটা অংশ মাত্র মলম দিয়ে যাচ্ছে, তাও একদিনের জায়গায় দশদিন ধরে। আবার তারও পুরোটা শরীরে অ্যাবজর্ব হচ্ছে না, মানে, শোষিত হচ্ছে না। কী, খুশি?
— কিন্তু মলম দিয়ে তো রোগটাকে চেপে দেবেন?
— চেপে দেব না তো কি রোগটাকে আল্লাদ দিয়ে মাথায় তুলব?
— না, ওঁরা যে বলেন রোগটাকে চেপে না দিয়ে বের করে দেওয়াই ভালো?
— হ্যাঁ, আপনার ঐ একরত্তি মেয়ে সারাদিন সারারাত চুলকোবে, ঘুমোতে পারবে না, ঘা হবে, ইনফেকশান হয়ে পুঁজ হবে, সেটাই আপনার ভালো লাগবে তো? তাহলে বাড়ি যান, রোগ বের করার জন্য আলাদা করে চেষ্টা করতে হবে না। ওষুধ না দিলে এমনিই বেরবে।
— আরে এবার দেখি আপনিই চটে যাচ্ছেন! ওঁরা যে বলেন, রোগটাকে চামড়ায় বেরোতে না দিলে ঐসব হবে। মানে হাঁপানি, আরও কী সব, সে সব ভারী জটিল রোগ যে!
— তা বের করে দিলে সেগুলো হবে না?
— কী জ্বালা ডাক্তারবাবু, আপনিই তো বললেন, আমার মেয়ের একজিমা হয়েছে মানে হাঁপানি হবার চান্স বেশি।
— তা চান্স তো বেশিই। কিন্তু সেটা কমানোর উপায় কি একজিমা না সারিয়ে রেখে দেওয়া?
— চেপে দিলেই তো পরে অন্যপথে বেরিয়ে আসবে… মানে ওঁরা যে বলেন…
— ওঁরা কী বলেন তার চাইতে বেশি কাজের কথা হল, কী ঘটে। একজিমা রোগীকে চিকিৎসা করে সারিয়ে দিলে, বা তার কষ্টগুলো কমিয়ে দিলে, হাঁপানি হবার চান্স মোটেই বাড়ে না।
— বলছেন?
— বলছি মানে? এটা আমার মুখের কথা নয়। অনেক রোগীকে দেখে, বছরের পর বছর ধরে তাদের অবসারভেশন করে, মানে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, খুব নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে একজিমার চিকিৎসা করলে হাঁপানি হবার সম্ভাবনা বাড়ে না।
— কিন্তু শুধু তো ওঁরা নন, অনেকেই বলেন। মানে বয়স্ক মানুষরা সব বলেন, আর তাঁরা অভিজ্ঞতায় দেখেছেন বলেই না বলছেন।
— আসলে অভিজ্ঞতায় আমরা যা দেখি সেটা সবসময় পুরো সত্যি নয়। আমরা এক কথায় বলি, অ্যাটোপি। সেটা হলো একটা প্রবণতা। অ্যাটোপিক একজিমা রোগটা চামড়ায় দু-একটা জায়গায় দেখা দিলেও সেটা আসলে সারা শরীরের ব্যধি। সেই ব্যধি যখন চামড়ার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোয়, তখন হয় অ্যাটোপিক একজিমা। যখন নাকের মধ্যে হয়, তখন হয় অ্যালার্জিক সর্দি-হাঁচি। আর যখন ফুসফুসের শ্বাসবাহী নালীর মধ্যে দিয়ে হয় …
— তখন হয় হাঁপানি, মানে অ্যাজমা, তাই তো ডাক্তারবাবু?
— একদম ঠিক। বাঃ, এইবার তো বুঝেই গেছেন।
— কোথায় আর বুঝলাম? চামড়ার মধ্যে দিয়ে হওয়াটা চেপে দিলে তো সেই প্রবণতাটা কোথাও-না-কোথাও দিয়ে বেরোবেই? তার মানে সেই হাঁপানি!
— উফ, চেপে দেওয়া আর বেরিয়ে যাওয়া, এর বাইরে আপনাকে টানাহ্যাঁচড়া করেও বের করতে পারছি না। এবার তাহলে আপনি আমার ঘর থেকেই বেরিয়ে যান।
— সে কি কথা ডাক্তারবাবু, শোনাই তো হল না হাঁপানি না হলে প্রবণতাটা, মানে আপনি যাকে বলেন অ্যাটোপি, সেটা কী করবে!
— যান বলছি মশাই, নইলে মুশকিল হবে, হ্যাঁ। আপনার কথা শুনে আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছে, আপনাকে যাচ্ছেতাই গালাগালি করে ফেলতেই হবে।
— কী যে বলেন, আপনার মুখ থেকে গালাগালি? বেরোতেই পারে না।
— কিন্তু গালাগালি না করলে রাগটা তো থেকে যাবে। তখন আপনাকে দুমদাম মেরেও দিতে পারি। তার চাইতে দুটো গাল দিই, কেমন?
— আরে দূর, আপনি রাগ ঠিক হজম করে এখুনি হাসিমুখে বসবেন, এ আমি বেশ জানি।
— আপনার মেয়ের অ্যাটোপিও তাই, আমার মতন।
— মানে?
— একজিমা হয়ে অ্যাটোপির রাগ বের করতে না দিলে সে কিছুদিন পরে সেই রাগ হজম করে ফেলবে।
— তাই? কেমন করে জানলেন?
— ঐ যে বললাম, অনেক রোগীর ওপর অবজারভেশন বা নিয়মমাফিক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বয়স্ক মানুষেরা যে বলেন, একজিমা সারিয়ে দিল আর হাঁপানি হল, সেটা তাঁরা নেহাত মিথ্যে কথা বলেন না।
— ঐ দেখুন ডাক্তারবাবু, আপনি নিজেই আবার ওঁদের মতো কথা বলছেন। কী সব্বোনাশ!
— হ্যাঁ, পুরো কথাটা না শুনলে ভারি সব্বোনাশ। বয়স্ক মানুষেরা যা দেখেছেন সেটা ঠিকই বলেন, সে হিসেবে মিথ্যে বলেন না। কিন্তু একজিমার পর হাঁপানি— এই রোগদুটো পরপর ঘটার কারণ অন্য। অনেক অ্যাটোপির রোগীর ছোটোবেলায় অ্যাটোপিক একজিমা হয়, একটু বড় বয়সে সেটা কমে যায়, আর সেই সময়েই হয় হাঁপানি। একজিমা যা হোক কিছু চিকিৎসা তো হয়ই, লোকে মনে করে চিকিৎসায় চামড়ার রোগ সারল, আর তার ফলেই হাঁপানি হল। কিন্তু চিকিৎসা না করলেও ব্যাপারটা একই হতো, সেটা …
— অনেক রোগীর ওপর অবজারভেশন বা নিয়মমাফিক পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, তাই না ডাক্তারবাবু?
— একদম তাই। সুতরাং, কী করবেন?
— একজিমার চিকিৎসা করব। কিন্তু ডাক্তারবাবু, কদিনে সারবে?
— আপনার মেয়ের তেমন বেশি তীব্র রোগ হয় নি, ওর কষ্টগুলো দু-চার সপ্তাহে প্রায় পুরোই কমে যাবে। পুরো সারতে অবশ্য কতোটা সময় লাগবে তা বলা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে হাঁপানি বা সর্দি-কাশির ধাত হবে কিনা, সেও এখন বলতে পারব না।
— সে তো বুঝতেই পারছি ডাক্তারবাবু, আপনারা অত মোটা মোটা বই পড়েও সব কি আর জানতে পেরেছেন? সেটা মেনে নিতেই হবে। যাকগে, এখন কী করব?
— ওষুধ কিনবেন।
— ওষুধ? মানে স্টেরয়েড?
— হ্যাঁ, লাগানোর স্টেরয়েড মলম, আর মুখে খাবার অ্যান্টিহিস্টামিন। আরেকটা মলম দেব, ময়েশ্চারাইজার, সারা গায়ে লাগাতে হবে।
— অ্যান্টিহিস্টামিন? মানে অ্যালার্জির ওষুধ? খুব ঘুমোবে তো?
— তা ঘুমোক না। ও তো এখনও স্কুলে ভর্তি হয় নি, একটু আরামে ঘুমোক। চুলকানির কষ্ট পাবে না।
— অনেক জ্বালালাম ডাক্তারবাবু।
— তা জ্বালালেন। দুসপ্তাহ পরে যখন আসবেন তখন মনে করে আরেকটু জ্বালাবেন, কেমন?
.
বাকিটার জন্য দুসপ্তাহ অপেক্ষা। আর, নীচের চিত্রটির চক্ষুদান হয়নি, এমন নয়। নেহাত নিয়ম মানতে চোখে চাপা দেওয়া হয়েছে।