(পূর্বপ্রকাশিতের পর…)
সংলাপ ২
— কমেছে?
— হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, অনেকটাই কমেছে।
— রাতে ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে?
— হ্যাঁ। প্রথম দু’দিন একটু ছটফট করছিল। তারপর থেকে রাতে ঘুমোচ্ছে, দিনেও যেন একটু ঢুলুনিভাব।
— তা তো একটু হবে। অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপ খাচ্ছে তো। এবার ওটার ডোজ কমিয়ে দেব, তারপর একেবারে বন্ধ করে দেব।
— তখন তাহলে খাবার ওষুধ থাকবেই না?
–না। খাবার ওষুধ দরকার হবে না।
–তবে আপনি আগে একবার যেন বললেন না, অ্যাটোপিক একজিমা রোগটা চামড়ায় দু-একটা জায়গায় দেখা দিলেও সেটা আসলে সারা শরীরের ব্যামো। তাহলে লাগানোর ওষুধ দিয়ে …
— বাঃ, বেশ মনে রেখেছেন তো কথাগুলো! ঠিকই, অ্যাটোপিক একজিমা সারা শরীরের ব্যধি, যদিও রোগলক্ষণ প্রকাশ পায় চামড়ার খানিকটা অংশে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সারা গায়েই একজিমা হতে পারে, কিন্তু সাধারণত তা হয় না।
–হ্যাঁ, মুখে মাথাতেই হয়, তাই না?
— আপনার মেয়ের বয়স তো একবছরও হয়নি, ঐ বয়সে মুখে, মানে গালে, কপালে বেশি হয়। কানে, মাথাতেও হতে পারে। তবে ধড়ে, মানে ভালো ভাষায় দেহকাণ্ডেও হতে পারে, হাতে পায়ে হতে পারে।ঐরকম ছোটো বাচ্চাদের প্রথম লক্ষণ সাধারণত মুখেই হয় অবশ্য।
— তার মানে আমার মেয়ের গায়ে-হাত-পায়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে?
— তা পারে। তবে ওষুধে সাড়া দিয়েছে যখন, তখন চিকিৎসা চালিয়ে গেলে ছড়ানোর সম্ভাবনা খুব কম।
— তাহলে তো খাবার ওষুধটা বন্ধ না করাই ভালো?
— তা নয়। খাবার ওষুধ অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপ কেবল রোগলক্ষণ কমায়। চুলকানি না থাকলে ওটা দেবার তেমন মানে হয় না। কিন্তু সারা গায়ে মাখার ওষুধটা চালাতে হবে।
— সারা গায়ে মাখার ওষুধটা? মানে আপনি যেটা বললেন ময়েশ্চারাইজার?
— হ্যাঁ, ঐ ময়েশ্চারাইজারটাই। ওটা এখন সারা গায়ে মাখছে তো?
— মাখছে। কিন্তু সেটা তো ওর চামড়া শুকনো-শুকনো, তাই আপনি দিয়েছিলেন। রোগ সারাতে তো অন্য ওষুধ, মানে স্টেরয়েড মলম।
— অ্যাটোপিক ডার্মাটাটিসের একটা বড় ব্যাপার হল শুকনো চামড়া। চামড়া শুধু শুকনো নয়, তার বেরিয়ার ফাংশনও কম।
–ডাক্তারবাবু, উচ্চ-মাধ্যমিকে আমি ইংরাজিতে ঊনপঞ্চাশ।
— হে হে হে, ভুল হয়ে গেছে। অবশ্য আমিও সাতান্ন। কিন্তু বেরিয়ার ফাংশন কিছু এমন শক্ত কথা নয়। বাংলায় বললে বলব, বাঁধ দেবার ক্ষমতা।
— চামড়ায় বাঁধ?
— হ্যাঁ। বাঁধের কাজ হল আটকে রাখা। চামড়ায় জলীয় অংশ ঠিকঠাক না থাকলে সেই চামড়া বাঁধ বা পাঁচিল হিসেবে তেমন কাজ করতে পারে না। বাইরে থেকে জিনিস ভেতরে সহজে ঢুকে যায়, আর ভেতরের জিনিস বাইরে চলে আসে। অবশ্য সব জিনিস এরকম আসতে পারে না। কিন্তু নানা প্রদাহ তৈরি করার মতো জিনিস ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।
— প্রদাহ? মানে?
— কী জ্বালা! ইংরাজিতে ইনফ্লামেশন বললে তো আবার আপনি ঊনপঞ্চাশের গল্প শোনাবেন! আপনাকে কোনোদিন ছোটো লাল পিঁপড়ে কামড়েছে?
— তা আবার কামড়ায় নি! উফ, সে কী জ্বালা, ইংরাজিতে ঊনপঞ্চাশের মতোই!
— বড় ডেয়োঁ পিঁপড়ে কামড়ালে জ্বালা আরও বেশি। ঐ যে জ্বালা হওয়া, লাল হয়ে ফুলে ওঠা, ওটাই প্রদাহ। ইংরাজিতে ইনফ্লামেশন।
— তার মানে প্রদাহ হল পিঁপড়ে-টিঁপড়ে কামড়ানোর প্রতিক্রিয়া?
–ঠিক তা নয়। আপনার গায়ে কামড়ালে প্রদাহ হবে, কিন্তু একটুকরো কাপড়ে কামড়ালে হবে না। মানে প্রদাহ হল আমাদের শরীরের একটা ধর্ম। পিঁপড়ে কামড়ালে হয়, আবার দেহের মধ্যে জীবাণু আক্রমণ করলেও হয়। ঐ যে, কদিন আগে টনসিল ফুলে জ্বর হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খেলেন না, সেটা জীবাণু আক্রমণের ফলে শরীরে প্রদাহ। প্রদাহ না থাকলে ঐসব জ্বর-টর হতো না, গলাব্যথা হতো না, বা পিঁপড়ে কামড়ালেও তেমন অসুবিধা হতো না।
— শরীরের ধর্ম না কচু! অধর্ম বলুন! শরীর খামোকা কষ্ট পায়, আর সেটা শরীরের ধর্ম! অমন ধর্ম না থাকলেই ভাল ছিল।
— না না, প্রদাহ হলো ক্ষতিকর জিনিস, জীবাণু বা বিষাক্ত কোনো জিনিস, সেগুলোকে নষ্ট করে দেবার একটা প্রক্রিয়া। তার সঙ্গে ব্যথা হয়, সেটারও উপকারিতা আছে। ব্যথা হয় বলেই তো আমরা বিশ্রাম নিতে বাধ্য হই, তাতে শরীরের বিপদ দূর করতে সুযোগ বাড়ে। তাই বলছিলাম…
— বুঝেছি, ঢের বুঝেছি, আর বুঝতে চাইনা। আর প্রশ্ন করছি না বাবা, একজিমা থেকে কদ্দূর যে কথা গড়াল! বলুন চামড়ার ঐ বাঁধের কাজের কথাটা, আর তার সঙ্গে ময়েশ্চারাইজার মাখানোর সম্পর্ক।
— চামড়া তো আমাদের বর্ম, না থাকলে মারা পড়তাম।শরীর থেকে জল ও লবণ বেরিয়ে যেত হু-হু করে, আর বাইরের জীবাণু ও নানা ক্ষতিকর জিনিস ঢুকে পড়ত কোনো বাধা ছাড়াই। তাছাড়াও চামড়ার রয়েছে ঢুকে-পড়া ক্ষতিকর জীবাণুকে মারার ব্যবস্থাও। অ্যাটোপিক একজিমার রোগীর চামড়া দিয়ে জীবাণু ইত্যাদি ঢোকে তুলনায় সহজে, আর তাদের মারবার ব্যবস্থাটাও কমজোরি। এর ওপর আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল, কিছু জীবাণুর দেহের প্রোটিন অ্যাটোপিকদের দেহে বেশি প্রদাহ তৈরি করে, যেমন স্ট্যাফাইলোকক্কাস-এর সুপার-অ্যান্টিজেন।
— ডাক্তারবাবু, ওরকম মেডিকেল কলেজের ক্লাসের মতন বললে আমি বুঝতে পারব না যে!
— সরি সরি, একটু বেশি কঠিন হচ্ছে বোধহয়। মোট কথাটা হল, অ্যাটোপিকদের ত্বকে চট করে প্রদাহ হয়, আর জীবাণু-সংক্রমণ, বিশেষ করে স্ট্যাফাইলোকক্কাস নামে জীবাণু সংক্রমণ হয় বেশি। আবার, স্ট্যাফ সংক্রমণ হলে সেটা অ্যাটোপিক একজিমাকে বাড়িয়ে দেয়।
— স্ট্যাফ আবার কী?
— স্ট্যাফাইলোকক্কাস-এর ডাকনাম। এই জীবাণুর নামটা আপনার চেনা নয়, কিন্তু এর উপদ্রবে নির্ঘাত ভুগেছেন একবার না একবার। চামড়ায় যে ফোঁড়া হয় সেগুলো প্রায় সবসময়ই স্ট্যাফ-এর সংক্রমণ।
— তাহলে তো আমার মেয়ের ভারি বিপদ! ওকে কী সবসময় অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়ে যেতে হবে?
— আরে না না। খালি মনে রাখবেন, ওর কোনো সংক্রমণ হলে, বিশেষ করে চামড়ায় পুঁজ নিয়ে কিছু হলে, শিগগির চিকিৎসা করতে হবে। আর ওর রোগ তেমন তীব্র নয়, অন্তত শীতকালে ওকে ময়েশ্চারাইজার মাখাতেই হবে, গরমকালে যদি মনে হয় চামড়া শুকনো, তাহলে গরমকালেও মাখাতে হবে।
— যে কোনো ময়েশ্চারাইজার মাখাবো?
— না, সাধারণত গন্ধ-ছাড়া ময়েশ্চারাইজার আমরা মাখাতে বলি, কেননা গন্ধদ্রব্য জাতীয় রাসায়নিকে অ্যাটোপিকদের অ্যালার্জি হবার চান্স বেশি। তখন সুগন্ধি ময়েশ্চারাইজার মাখিয়ে উলটো বিপত্তি, প্রদাহ বেড়ে যাবে। সাধারণভাবে কসমেটিক্স হিসেবে যেসব ময়েশ্চারাইজার পাওয়া যায় সেগুলোতে কিছু গন্ধদ্রব্য মেশানো থাকে। এমনকি ওষুধ হিসেবে আমরা যে সব ময়েশ্চারাইজার লিখি, তাদের অধিকাংশের মধ্যেও গন্ধদ্রব্য মেশায়। বিকল্প নেই, আমরা অনেকটাই ওষুধ-কোম্পানির হাতে। তবু গন্ধদ্রব্যের মধ্যে তারতম্য আছে, সবগুলো সমান অ্যালার্জি করে না। আবার সব ময়েশ্চারাইজার সমান কাজের, তাও তো নয়। সে সব ভেবেই ময়েশ্চারাইজার বাছতে হয়। তারপরে দেখতে হয় ময়েশ্চারাইজার মাখার পরে-পরেই চুলকানি বাড়ছে কিনা— মানে ময়েশ্চারাইজারে অ্যালার্জি— সে ক্ষেত্রে বদলাতে হয় সেটা।
— আর টিউবের যে ওষুধটা দিয়েছেন?
— ওটা স্টেরয়েড মলম। ওটাই একজিমা-হওয়া চামড়াকে স্বাভাবিক করতে প্রাথমিক ওষুধ। যদি কোনো রোগী ময়েশ্চারাইজার কিনতে না পারে, আমরা বলি, নারকেল তেল মাখুন। কিন্তু স্টেরয়েড মলম আমাদের প্রায় সবসময় দিতেই হয়।
— স্টেরয়েড মলম ‘প্রায়’ সবসময় দেন? মানে, দিতেই হয় এমন নয়?
— না, কোনো সময় কেবল ট্যাক্রোলিমাস বা পিমেক্রোলিমাস মলম দিলেও চলে। বিশেষ করে বাচ্চাদের, আর যদি কম তীব্র আক্রমণ হয়। যেমন আপনার মেয়েকে— আর কিছুদিন স্টেরয়েড মলম দিয়ে তারপর ট্যাক্রোলিমাস-এর ওপরেই রাখব বলে ভাবছি। সমস্যা হল, ট্যাক্রোলিমাস দামি, আর অনেকের চামড়ায় জ্বালা হয়। পিমেক্রোলিমাস-এ জ্বালা খুব কম ক্ষেত্রে হয়, কিন্তু সেটা আবার আরও বেশি দামি। তাই শরীরের অল্প জায়গায় না হলে ওগুলো না দেওয়াই ভাল। তার ওপর ওগুলো দিলেও যে নিশ্চিন্ত, তা নয়।
— স্টেরয়েড মলম দিলে নিশ্চিন্ত?
— না। স্টেরয়েড মলমে সাইড এফেক্ট আছে। প্রথমত স্থানীয় প্রতিক্রিয়া। কোনো সংক্রমণ থাকলে সেটা সহজে বেড়ে যেতে পারে, আর মনে রাখবেন অ্যাটোপিকদের চামড়া এমনিতেই সংক্রমণকে তেমন সহজে সারাতে পারে না। এছাড়া বেশিদিন লাগালে চামড়া পাতলা হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে বাচ্চাদের ও মুখ, কুঁচকি এরকম সব জায়গায়, যেখানে চামড়া এমনিতেই পাতলা। জোরালো স্টেরয়েড মলম তাড়াতাড়ি চামড়া পাতলা করে বলে বাচ্চাদের আমরা দিই না, মুখেও দিই না। মুখে বেশি লাগালে ব্রণর মতো বেরোয়, মুখে লোম বেরোয়, রোদে গেলে জ্বালা করে – এরকম হাজারও পার্শ্বক্রিয়ার লিস্টি আছে। সুতরাং যতদিন বলে দিচ্ছি ততদিনের বেশি মলম লাগাবেন না। মাঝে-মধ্যে দেখে নেব সাইড এফেক্ট হলো কিনা, আর কাজই বা কতোটা হলো, আর সেই অনুযায়ী ওষু বদলানো বা কমানো-বাড়ানো করতে হবে।
— যাক বাবা, ভেতরে গিয়ে কোনো ক্ষতি তো করে না মলম!
— না না, তাও করে। আমি বলছিলাম স্থানীয় প্রতিক্রিয়ার কথা। কিন্তু গোটা দেহের ওপর প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। সেটা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবার সম্ভাবনা বেশি। আবার বলছি, আপনার মেয়ের শরীরে তেমন কিছু হবে না, কেন না অল্প জায়গায় অল্প মলম লাগিয়েই কাজ হচ্ছে। কিন্তু অনেকটা জায়গায় অনেকটা মলম যদি লাগাতে হতো, যেমনটা হয় খুব তীব্র রোগ ও ছড়িয়ে পড়া রোগের জন্য, তাহলে কিন্তু লাগানো মলম শরীরে যে পরিমাণ ঢুকত তাতে মুখে খাবার, বা ইঞ্জেকশনে নেওয়া স্টেরয়েডের মতোই সাইড এফেক্ট হতো। সে এক লম্বা ফর্দ, এখন অত বলার সময় নেই, আপনার শুনে কাজও নেই।
— খাবার স্টেরয়েড দিতে হবে না ভাগ্যিস!
— হ্যাঁ, আপনার মেয়ের তো তেমন জোরালো অসুখ হয়নি, ওকে খাবার কিংবা ইঞ্জেকশনের স্টেরয়েড দিতে হবে না বলেই মনে হয়, যদি না আপনি চিকিৎসায় গাফিলতি করেন। কিন্তু বেশি তীব্র রোগ হলে বা সারা শরীরে রোগ ছড়ানোর মতো অবস্থা হলে খাবার বা ইঞ্জেকশনে স্টেরয়েড দিতে হয়, ওর থেকেও জোরালো ওষুধ, বেশি সাইড এফেক্ট আছে এমন ওষুধও দিতে হয়; না দিয়ে উপায় থাকে না।
(চলবে…)