আজ অষ্টমী। অর্কদেবকে আজ তার ছেলে নিয়ে যাচ্ছে। অর্ক, তার বউ আর ছোটোছেলে এই পাড়ায় থাকে। বড়ছেলে জয়, ছেলের বউ আর নাতি থাকে এই শহরেরই ভিন পাড়ায়। বড়ছেলের ভারি সাধ, পুজোর মধ্যে একদিন, তাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে মা-বাবা আর ভাই। তাদের হাউসিং কমপ্লেক্সে আজকের লাঞ্চ-কুপন কেটেছে সে। সেই মত অষ্টমীর দুপুরে সে এসেছে গাড়ি নিয়ে। এসেই তাড়া। ‘চলো চলো শিগগির চলো। আমাদের কমপ্লেক্সের নিয়ম কানুন ভারি কড়া। ঠিক সময়ে না গেলে খাবার পাবে না।’
অর্ক তখন ছিল তাদের পাড়ার প্যান্ডেলে। নানান কমপিটিশন হচ্ছে সেখানে। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে ঘন ঘন।
অর্ককে কেউ পাত্তা দেয় না। আজ না হয় তার বয়স হয়েছে। কোনও কালেই কেউ পাত্তা দেয়নি। দেবার কথাও না।
অর্কর কিন্তু ভারি সাধ সে কিছুতে মানে কোনও কমপিটিশনে নাম দিয়ে বাহবা কুড়োবে। কিন্তু ছেলের তাড়নায় সেই সাধে জলাঞ্জলি দিয়ে বাধ্য বাবা অর্ক রওনা হল বউ আর ছোটোছেলেকে নিয়ে।
বড়ছেলে জয়কে সে ভয়ই পায় একরকম। জয় যখন নিজে ছোটো ছিল সেও বাপকে ভয় করত সামাজিক নিয়মমত। আজ পাশার দান উলটে গেছে। কী করা। মাইকে তখনও ঘোষণা চলছে, ‘এর পরের প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীরা চলে আসুন।’
পরের দিন নবমী। হঠাৎই জয়ের ফোন। ‘বাবা, দশমিনিটের মধ্যে আসছি। তোমাকে আনতে যাচ্ছি। আমাদের এখানে শঙ্খ বাজানোর কমপিটিশন। তুমি তো এক্সপার্ট। মজুমদার বাড়িতে একটা প্রাইজ আনতেই হবে।’
এক্সপার্ট? অর্ক কিছুতেই এক্সপার্ট হতে পারেনি সারা জীবনে। খেলা গান ছবি আঁকা কিছুতেই না। কিছুই পারে না সে। তবে জয়দের ছোটোবেলায় নিজের বাচ্চাদের কাছে বাহাদুরি নেবার জন্য শাঁখ বাজাতো বটে কখনও কখনও। ছেলেরা অবাক হয়ে বলত, ‘উফ বাবা, কী দম গো তোমার!’
সেই তুচ্ছ স্মৃতি মনে রেখে জয় ভাবছে বোধ হয় ওর বাবা সেই আগেরই মতন পারে। মাঝে যে ওর বাবা এক্স-স্মোকার হবার কারণে ডাক্তারের প্রেসকৃপশন মোতাবেক সিওপিডি মার্কা পেয়েছে, রেগুলার ইনহেলার নিতে হয়, সেটা খেয়ালই করেনি।
সে যাই হোক, অকুস্থলে পৌঁছে বারকতক শাঁখে ফুঁ দিয়ে প্র্যাকটিশ করে নিতে হল জয়ের আদেশে। কিন্তু বেশি প্র্যাকটিশ না। কড়া কোচ সে। বাবাকে সাবধানও করল চেনা গল্প বলে। রোজ ব্রেকফাস্টে দশপাউন্ড পাঁউরুটি খাওয়া লোকটা কী ভাবে বাজি রেখে খেতে যাবার আগে অধিক প্র্যাকটিশ করে খাওয়ার আসরে নাস্তানাবুদ হয়েছিল সেই গল্প।
একদম শেষে তাকে যেমন ছোটোবেলায় বলা হত, সেও বাবাকে মনে করিয়ে দিল, ‘বাবা, ফার্স্ট হতেই হবে’।
মোটমাট নির্ধারিত ওয়ান-টু-থ্রির পর শাঁখে ফুঁ দিতেই হল বেতো রেসের ঘোড়া,অর্ককে। নেহাতই কর্পোরেট নারী-পুরুষের হাসিঠাট্টার আসর। অন্যরা কেউ কেউ শাঁখের আওয়াজই বার করতে পারল না। কেউ বা দশ কেউ বারো, হায়েস্ট কুড়ি সেকেন্ড।
প্রাণপণে নিজের শেষ চেষ্টার বাতাসটুকু দিয়ে সাতাশ সেকেন্ড পেরুলো অর্ক। আর প্রতিযোগিতার শেষে কী আশ্চর্য এতেই, এই মাত্র সাতাশ সেকেন্ডেই সে ফার্স্ট! বাবার বিজয়গর্বে জয় উচ্ছ্বসিত।
ফিরে নিজের পাড়ায় আগের দিনে হওয়া কমপিটিশনের খোঁজ নিল অর্ক। জয়ের সঙ্গে বেরোবার সময়ই ঘোষণা হচ্ছিল বটে আর পাঁচটা প্রতিযোগিতার সঙ্গে এই শঙ্খ বাজানোরও। ভারি আপশোস হল। ইস্, থাকলে তো সেও নাম দিত, ফুঁ দিত।
অবশ্যি আশ্বস্তও হল। তাদের পাড়ায় ফার্স্ট হয়েছে প্রণবশঙ্কর, যে নাকি হেলায় পঁয়তিরিশ সেকেন্ড।
মোটে আট সেকেন্ড? ঠিক মত ফুঁ দিতে পারলে, পরের বছর বাতাসের অনন্ত মহাসমুদ্র থেকে এটুকু বাতাস, মাত্র আট সেকেন্ডের বাতাস কী আর নেওয়া যাবে না?
সেই অবধি অর্কদেব শঙ্খ কিনেছে। বাড়িতে প্র্যাকটিশ শুরু করেছে। শাঁখে ফুঁ দিয়ে প্রায় মরণপণ প্র্যাকটিশ।
হ্যাঁ, মরণপণই।
এবারের শীতেই এক্সস্মোকার সিওপিডির পেশেন্ট অর্কদেব শুয়ে পড়েছে। জয় খুব চেষ্টা করেছে। কর্পোরেট হাসপাতালে ভর্তি করেছে ইনসিওরেন্সের তোয়াক্কা না করে। শেষের কদিন ঘোরের মধ্যে ছিল। পাড়ায় খবর পৌঁছোলো, বুড়োটা টপকে গেছে।
হাসপাতালের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল অ্যাকিউট সিভিয়ার এক্সাসারবেশন অফ সিওপিডি।
শেষ দিন প্রবল ভাবে যখন নিঃশ্বাসের বাতাস তাকে চূড়ান্ত বঞ্চনা করছে তখনও নাকি ঘোরের মধ্যে জয়ের কাছে ইঙ্গিতে তার সাধের শাঁখটা চাইছিল বেচারা। ওই মাত্র আট সেকেন্ডের বেড়াটা যে ওকে টপকাতেই হবে।
★