এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ডিউটি। সন্ধ্যের রাউন্ড চলছে। জুনিয়র ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু ছুটে এলো। দাদা, একটু নিচের তলায় মেল এমারজেন্সি বিভাগে যেতে হবে। মধ্য চল্লিশের এক রোগী রেফার হয়ে এসেছেন ক্যানিং হাসপাতাল থেকে। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ইউরিনারী ক্যাথিটার পরানোর প্রচেষ্টা সব জায়গাতেই ব্যর্থ। এখানেও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু জোর করে ক্যাথিটার ঢোকাতে গেলেই রক্তপাত হচ্ছে।কথাগুলো কানবন্দি করতে করতেই স্টেথোস্কোপটা গলায় পাকিয়ে দৌড়ে নিচে ছুটলাম।
যন্ত্রণায় ভদ্রলোকের তখন প্রাণবায়ু বেরোনোর জোগাড়। চোখ বিস্ফারিত। কথা বলতে পারছেন না। ঈশারায় শুধু তলপেটের দিকে দেখিয়ে দিলেন। যন্ত্রণাশ্রু গালের কোলে দাগ পাকিয়েছে ।
পেট অসম্ভব ফুলেছে। প্রস্রাব মুখ ক্যাথিটার ঢোকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার ক্লান্তিতে যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও শোণিতাবিষ্ট।
তার উপর স্যালাইন চলছে রোগীর। ফলে প্রস্রাবের উৎপাদন হেতু উপর্যুপরি চাপ বেড়েই চলেছে।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উদবিগ্ন সিস্টার ম্যাডামকে একটা স্যালাইন সেট সমেত সবুজ রঙের জেলকো আনতে বললাম। মেডিক্যাল কলেজের হাতেকলমে শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগের যথোপযুক্ত সময় সমাগত। তলপেটে থাকা ইউরিনারী ব্লাডার লক্ষ্য করে সবুজ জেলকো ঢুকিয়ে দিলাম পেট ফুটিয়ে। প্রথম প্রচেষ্টাতেই লক্ষ্যভেদ হলো। জেলকোয় ফিট করা স্যালাইন সেটের নল বেয়ে নেমে এলো মূত্রধারা। মিনিট কয়েকের অবিশ্রান্ত ধারাস্রোতের পর বন্ধ হলো প্রস্রাব। ফুলে থাকা ঢাউস পেট মুহূর্তে চুপসে শান্ত হলো। মুখ থেকে যন্ত্রণার দাগ মুছে তখন গভীরতর প্রশান্তির চক্ষুমুদন।
“বাঁচালেন ডাক্তারবাবু”, বলেই তড়াক করে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। “দুপুর থেকে কি কষ্টটাই না পাচ্ছিলাম।”
ভদ্রলোকের অতিপ্রশান্তির পথে বাধা দিয়ে বললাম, “এখানেই শেষ নয়। সাময়িক ভাবে উপশম হলো বটে, কিন্তু প্রস্রাবের আটকে যাবার আসল কারণ খুঁজে বের করে যথোপযুক্ত চিকিৎসাই একমাত্র মুক্তির উপায়।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিজনদের উত্তরে রোগবর্ণনা না করে উপায় নাই।
প্রস্রাবের আটকে যাবার ডাক্তারী পরিভাষায় নাম “ইউরিনারী রিটেনসান”। কারণ বিবিধ। প্রস্রাবপথের ইনফেকশান থেকে শুরু করে প্রস্রাব পথে স্টোন, মূত্রনালী সরু হয়ে যাওয়া, পেটের অপারেশানের পর অ্যাঢেশান বা কোনো টিউমার হেতু প্রস্রাবপথ আটকে যাওয়া, প্রস্রাব মুখের সরু হয়ে যাওয়া, সবেতেই রোগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রস্রাবের আটকে যাওয়া থেকে শুরু করে ইনফেকশন মায় রক্তক্ষরণও অস্বাভাবিক নয়।
মধ্যচল্লিশোত্তর পুরুষের প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের বাড়বাড়ন্তের কারণে এবং মায়েদের যোনিপথে একাধিক সন্তান জন্মের পরে সিস্টোসিল বা রেক্টোসিলের কারণে প্রস্রাবপথে যে বাধা তৈরি হয় তার কারণে ইউরিনারী রিটেনশানের রোগী সর্বাধিক।
চটজলদি উপায় হিসেবে ক্যাথিটার পরিয়ে প্রস্রাব করানো হলেও রোগের মূল কার্ণ নির্ণয় করে সেইমত চিকিৎসা জরুরি।
ন্যূনতম রুটিন ইউরিন টেস্ট, তলপেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও ইউরোফ্লোমেট্রি করা ছাড়া মূল চিকিৎসার দোরগোড়ায় পৌঁছানো কষ্টসাধ্য।
কিছুক্ষেত্রে মূত্রনালীতে বাধা থাকলে সরু ক্যাথিটার পরানোও কষ্টকর হয়ে ওঠে। সংবেদনশীল প্রস্রাবপথে রক্তক্ষরণ বেশ ভীতিপ্রদ। সেক্ষেত্রে আধুনিক শল্যোপচারে সিস্টোস্টমি করে মূত্রথলি থেকে প্রস্রাব বের করা হয়।
এসব বিপত্তি এড়াতে চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ ও একাধিক গর্ভধারিনী মায়ের নিয়মিত প্রস্রাবপথের যত্ন ও চিকিৎসামুখী মননের অতি প্রয়োজন।
এতক্ষণের জ্ঞানগর্ভ বক্তিমের পর হাঁ হয়ে থাকা পরিজনেদের একজন কপালের ভাঁজ গভীরতর করে জিজ্ঞেস করলেন “তাহলে আমাদের রোগীর ওপর যা করলেন, তার নাম কি?”
বিব্রতকন্ঠে মুচকি হেসে বললাম “জেলকোস্টমি”।
বহরে ভারী সিস্টোস্টমি পদ্ধতির সাধারণীকৃত বাংলা প্রয়োগ। দিনের শেষে রোগীর যন্ত্রণালাঘবের জন্য আমাদের সাহেবী সিলেবাসের বাইরে অনেক কিছুই করতে হয় বইকি।