নরওয়ে দেশটার সাথে আমরা তেমন পরিচিত নই, এর একটা কারণ হল তারা বাণিজ্যের ছদ্মবেশে আমাদের দেশে রাজত্ব করতে আসেনি। ওই দেশটাতে একটা সময় কুষ্ঠরোগের খুব বাড়াবাড়ি ছিল। ১৮৫০ এর দশকে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগের বদান্যতায় বার্গেন শহরে কুষ্ঠ নিয়ে গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হয়। দায়িত্বে ছিলেন ড্যানিয়েল কর্ণেলিয়াস ড্যানিয়েলসেন ও কার্ল উইলহেল্ম বক নামে দুই ডাক্তার-গবেষক।
এঁরা দুজনেই প্রচুর গবেষণা করেন রোগটা নিয়ে, প্রচুর অবদান। কিন্তু মুশকিল ছিল একটা জায়াগায়। ড্যানিয়েলসেন বিশ্বাস করতেন যে কুষ্ঠ একটি বংশগত রোগ। ওঁর সমালোচনা করার আগে পাঠকদের মনে রাখতে হবে সময়কালটা। কুষ্ঠরোগ কেন হয় সে সম্বন্ধে চালু হাইপোথিসিসের মধ্যে ছিল – পূর্বজন্মের পাপের ফল বা অভিশাপের ফল। এর সাথে যুক্ত হল এই বংশগত কারণের হাইপোথিসিস।
এই সময়ে দুটি ঘটনা ঘটে। ১৮৬৮ সালে এক তরুণ গবেষক ডাক্তার বার্গেনের ওই গবেষণাগারে যোগ দেন। তাঁর নাম গারহার্ড হেনরিখ আর্মার হ্যানসেন। উনি নানান গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে কুষ্ঠ বংশগত রোগ নয়, এটা একটা জীবাণু ঘটিত রোগ। হ্যানসেনের সাথে তাঁর বস ড্যানিয়েলসেনের সরাসরি সংঘাত ঘটে। বসকে চটিয়ে দেওয়ার মতো আরো একটা কাজ করেছিলেন সামান্য মাইনের জুনিয়র এসিস্টেন্ট হ্যানসেন। বসের মেয়ে স্টিফানি মারি-র প্রেমে পরে যান তিনি।
ড্যানিয়েলসেনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বসের কথার উল্টো বললে কোনো বসই কোনোকালে ভালো ভাবে নেয় নি। অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও ওই জীবাণু হাইপোথিসিস নিয়ে হাসাহাসি করেন। হ্যানসেন উপলব্ধি করেন যে ওই জীবাণুঘটিত হাইপোথিসিস প্রমাণ করার জন্য তাঁকে আরো খাটতে হবে। ভালো করে হিস্টোপ্যাথলজি বিশেষত কোষকলা স্টেইন বা রং করার পদ্ধতি শেখার জন্য হ্যানসেন পাড়ি দেন ভিয়েনায়।
এবার দ্বিতীয় ঘটনার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। বেলজিয়ামের এক রোমান ক্যাথলিক যাজক, ফাদার ড্যামিয়েন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মোলকাইতে যান কুষ্ঠরোগীদের সেবা করতে। ওদের সাথে দীর্ঘদিন মেলামেশার পরে তাঁর নিজের শরীরে কুষ্ঠরোগের লক্ষণ দেখা যায়। এই ঘটনায় ইউরোপের শিক্ষিত মহলে তোলপাড় পরে যায়। এক ধর্মযাজক, যিনি রোগীদের সেবা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, পাপ বা অভিশাপের ফলে তাঁর কুষ্ঠরোগ হয়ে গেল এটা কেউ মানতে চাইলো না। দুটো হাইপোথিসিস ধ্বসে গেল।
ইউরোপের অন্যান্য যাজকদের মত ফাদার ড্যামিয়েন, পূর্বাশ্রমে যাঁর নাম ছিল জোসেফ ডি ভেউস্টার, মোটামুটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষের ঠিকুজি কুলুজি খুঁজেও কারুর মধ্যে কুষ্ঠরোগের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গেল না। তিন নম্বর হাইপোথিসিসও ধ্বসে গেল। তখন খোঁজ পরলো সেই ছোকরা ডাক্তার হ্যানসেনের।
দিনের পর দিন অক্লান্ত গবেষণা করে হ্যানসেন অবশেষে কুষ্ঠরোগের জীবাণু আবিষ্কার করলেন। তাদের রং করে মাইক্রোস্কোপের তলায় নিজে দেখলেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু গবেষক আলবার্ট নাইজারকে দেখালেন। ১৮৭৩ সালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। এর পর থেকে সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছে যে “শাপে নয়, পাপে নয়, জীবাণুতে কুষ্ঠ হয়”। একই সময়ে হ্যানসেন তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ে করেন।
মানুষের শরীরে রোগ তৈরি করে এমন বহু জীবাণু আছে, কিন্তু প্রথম যে জীবাণুটি আবিষ্কার হয় তার নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি – হ্যানসেনের ব্যাসিলাস।
আজ হঠাৎ করে হ্যানসেনের আবিষ্কার বা তাঁর প্রেম কাহিনী বলতে বসার কারণ আছে। দু দিন আগেই দেখলাম যে এই ২০২১ সালেও আমাদের প্রিয় বাংলার একটা জায়গায় আবার “ডাইনি” সন্দেহে তিন আদিবাসী মহিলার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাদের সমাজ। পুলিশ-প্রশাসনে তেমন কিছু হেলদোল নেই। ডাইনি নামক এই অমানবিক প্রথা, এই কুসংস্কার দূর করা কেবল ওই পুলিশ -প্রশাসন দিয়ে হবেও না। মানুষের রোগ সৃষ্টির সাথে অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই এটা প্রমাণ করার জন্য তাই হ্যানসেনের আবিষ্কারের এই পুরোনো কাহিনীকে আবার সামনে নিয়ে আসা।
চারদিক থেকে উপহাসের শিকার, ওপরওয়ালার সাথে ঝামেলায় বিপর্যস্ত মাত্র ৩২ বছর বয়সের এক তরুণ হিরো অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ দিয়ে পরে আছে্ন ঘন্টার পর ঘন্টা, ভিলেন জীবাণুদের আশ্চর্য জগৎ খুলে যাচ্ছে তাঁর চোখের তলায় – এ দৃশ্য আবার যেন আমরা বারবার দেখতে পারি, দেখাতে পারি।
ভালো লাগলো