অতিমারীর এই আড়াই বছর এক মহাকাব্যিক অভিজ্ঞতা। সারা পৃথিবীতে এখনো অব্দি ৬২ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। জীবন, জীবিকা, সামাজিকতা, শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদি সবকিছুতেই ব্যাপক রদবদল এসেছে। কোভিড আসার সামান্য আগে বা পরে যেসব শিশুরা পৃথিবীতে এসেছে তারা বাইরের পৃথিবীটাকে ভালোভাবে দেখারই সুযোগ পায়নি। কে কবে ভেবেছিলো ট্রেন বন্ধ রাখতে হবে মাসের পর মাস? রাজপথ ছেয়ে যাবে বুভুক্ষ মিছিলে? রেললাইনে পড়ে থাকবে রক্তাক্ত শ্রমিকের লাশ? কে ভেবেছিলো হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেবে? জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচী থমকে যাবে? কালোবাজারে বিক্রি হবে মাস্ক আর স্যানিটাইজার? অবৈজ্ঞানিক জরিবুটি ক্কাথ আর অ্যালকোহল ফোঁটার পেছনে পাগলের মত দৌড়োবে আমজনতা? নদীর পাড়ে গণচিতা জ্বলবে?
আমাদের প্রজন্ম বিশ্বযুদ্ধ দেখেনি। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেনি। সাতের দশকের টালমাটাল বিক্ষোভের দিনও দেখেনি। এ অতিমারী বিশ্বযুদ্ধের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে লড়াই করেছে। ‘মারীর দেশ’ সিরিজ অতিমারীর আবহে আমার ডায়েরির পাতা। নিজের মতো করে লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা লিখে রাখতে চেয়েছি। আজ কোভিড প্রায় নিয়ন্ত্রণে। খাতায়-কলমে থাকা নিষেধাজ্ঞাগুলোও সঙ্গত কারণেই তুলে নেওয়া হয়েছে। আজ বারবার ফেলে আসা আড়াই বছরের দিকে ঘুরে তাকাতে ইচ্ছে করছে। অনেক ক্ষতির বিনিময়ে আমাদের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোভিড নিতান্তই সাধারণ সর্দি কাশি। কিন্তু শুরুর দিনগুলো খেয়াল করুন। একটা সম্পূর্ণ নতুন রোগ। একটা অজানা আতঙ্ক। কীভাবে চিকিৎসা হবে কেউ জানে না। করোনার কথা শুনলেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা রক্তস্রোত নেমে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, মন্দির-মসজিদ সব বন্ধ। রাস্তাঘাট শুনশান। সবাই ঘরে খিল দিয়ে বসে। শুধু আপৎকালীন পরিষেবার সাথে যুক্ত মানুষজন একটা অসম লড়াই লড়ছেন। প্রথমবার পিপিই পরার অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যাচ্ছে। মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা। সে বর্ম ভেদ করে এতটুকু হাওয়া ঢোকে না। বাইরে ভ্যাপসা গরম। এসি তো দূরের কথা, ফ্যানগুলোও ঠিকঠাক ভাবে ঘুরছে না। ঘামে তো ভিজেছি বহুবার কিন্তু ঘামে ভেসে যাওয়া কী জিনিস সেটা প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম। জিভ শুকিয়ে কাঠ। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আক্ষরিক অর্থেই ধুঁকতে ধুঁকতে ওয়ার্ডের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়াচ্ছি। দুটো আলাদা ওয়ার্ড। ভেতর দিয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। যেতে হলে বাইরে বেরিয়ে রোদে বেশ খানিকটা হেঁটে উল্টো দিক দিয়ে ঢুকতে হয়। ভাষায় লিখে সে কষ্টের বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। ভয়ে বাড়ি যাচ্ছি না পাছে বাড়ির লোক আক্রান্ত হয়। কোথাও কোথাও সুশীল সহনাগরিক স্বাস্থ্যকর্মীদের পাড়ায় ঢুকতেই দিচ্ছেন না। আমার বোন একটা ব্লাড ব্যাঙ্কে কাজ করে। বেশ কিছুদিন ধরে বাড়ি ফিরতে পারছিল না। শেষমেষ বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয়। আমরা যে একটি সুসভ্য দেশের নাগরিক, সেটা সম্পর্কে আরেকবার নিশ্চিত হয়েছিলাম।
তারপর গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কত জল বয়ে গেল। অজানা রোগ। তার চিকিৎসাও অজানা। এই সুযোগে ভারতীয় উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত অপবিজ্ঞান বা ছদ্মবিজ্ঞান গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। বিভিন্ন জায়গায় (এমনকি সরকারি মদতে) অপ্রমাণিত কাচের শিশি, কাঠের ছিপির অ্যালকোহল ফোঁটা বা জরিবুটি ক্কাথ খাওয়ানো চললো। বলাই বাহুল্য, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও হাতড়ে বেড়িয়েছে। ডুবন্ত মানুষ হাতের কাছে খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। কোনও ওষুধের স্বপক্ষে সামান্য কিছু প্রমাণ পাওয়া গেলেও সেটা নিয়ে ভীষণ হইচই হয়েছে। অন্য সময় এ ধরনের ‘প্রমাণ’কে শুরুতেই পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়া হয়। হাজারো পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে একটা ওষুধ বাজারজাত হয়। তার পরেও নজরদারি চলে। যুদ্ধের সময় ভাবনা চিন্তার জন্য বেশি সময় থাকে না। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, র্যানিটিডিন, আইভারমেক্টিন ইত্যাদি অসংখ্য ওষুধের নামে বাজার কেঁপেছে। যদিও কখনোই এসব ওষুধকে মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এসব ওষুধ দেদার বিকিয়েছে। বাজার থেকে ওষুধ উধাও হয়ে গেছে। চিকিৎসক মহলে এমন একটা ঠাট্টা প্রচলন হয়ে গেছিল- একটা ওষুধ-বিজ্ঞানের বই নিয়ে চোখ বুজে যে কোনও পাতায় পেনের কালি দিলে যেখানে কালি পড়বে সেটাই করোনার ওষুধ। যদিও যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসায় বিজ্ঞানই শেষ কথা বলে। রোগটা সম্পূর্ণ জানার পরে এসব ওষুধ আর কখনো ব্যবহার হয়নি। সাধারণ ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি অক্সিজেন বা অন্য শ্বাস দেওয়ার মেশিন, স্টেরয়েড, রক্ত তরল করার ওষুধ, অ্যাসপিরিন, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, প্রয়োজন হ’লে অ্যান্টিবায়োটিক বা সামান্য অন্য কিছু ওষুধ। মোটামুটি এই হ’ল করোনার চিকিৎসা। টিকা আসার পরে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেকগুণ সহজ হয়েছে। টিকাকরণের বিরুদ্ধাচারণকারীরা নানারকম অপবাদের সুর চড়িয়েছেন। তাঁদের কথায় কান না দেওয়ার অভ্যেস করে নিয়েছি। আজকের দিনে করোনার চিকিৎসা জলভাত। কিন্তু শুরুর অসহায় দিনগুলোয় বিজ্ঞান একাই লড়েছিল। বিজ্ঞানকে দোরে দোরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চিকিৎসক, পুলিশ, সাফাইকর্মী, ফার্মাসিস্ট, হাসপাতালের পরীক্ষাগারের কর্মী কিংবা অন্যান্য আপৎকালীন পরিষেবার সাথে যুক্ত গুটিকয়েক মানুষ লড়াই করেছিলেন। খুব সম্ভবত তাঁদের কেউই হাততালি, থালা বাজানো, ফুল ছোঁড়া ইত্যাদি অতিনাটকীয় ব্যাপার চাননি।
জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে গেছে। করোনা বিধ্বস্ত পৃথিবীকে আবার একটু একটু করে গড়ে নেওয়ার পালা। ডাক্তার পেটানোর সেই জনপ্রিয় খেলাটাও আবার শুরু হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগের কথা। ডাক্তারের নাম… থাক। নামে কী বা আসে যায়… ওই নামটা যে কোনও ডাক্তারের হতে পারে। ডাক্তারের দোষ ছিল এরকম- বুকের ব্যথাকে হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ করে তিনি স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। রাস্তায় রোগীর মৃত্যু হয়। নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। তারপর যথারীতি যা হয়, ডাক্তার পেটানো হ’ল। ভাঙচুর হ’ল। ডাক্তারের দোষও যে সাংঘাতিক! সামান্য একটা হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা বাড়িতে বসে করা গেল না? হাসপাতাল যেতে বলে, সাহস কম নয়? করোনা অতিমারী শেষের পথে। হয়তো এর পরেও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়াবে। তবে খুব সম্ভবত দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো ভয়ংকর পর্যায়ে যাবে না। তালি-থালির দিনও শেষ। অবসর বিনোদনের জন্য ডাক্তারের পিঠ তো রইলোই। চাইলেই বাজানো যায়।
‘মারীর দেশ’ সিরিজের এটাই শেষ লেখা। পয়লা বৈশাখ নতুন বছরেই লেখাটা দেবো বলে ভেবেছিলাম। সেদিন গায়ে জ্বর নিয়ে ডিউটি করছি। সকালেও প্যারাসিটামল খেয়েছি। গায়ে-হাতে ব্যথা। ডিউটি থেকে ফিরে আর লিখতে ইচ্ছে হয়নি। আজ আরশির জন্মদিনে লেখা শেষ করলাম। আগেও বলেছি, এ লেখা শুধুই কোভিডকালের ব্যক্তিগত দিনলিপি। কেউ পড়বেন ভাবিনি। অনেকগুলো বছর পরে পেছন ফিরে তাকালে লেখাগুলো মনে পড়বে। লেখাগুলো ছুঁয়ে দেখবো। অনাগত আগামী পৃথিবীকে গল্প শোনাবো, জয়ের গল্প। মারীতে আমরা হারিনি। মুখ ধুবড়ে পড়েছি বারবার। প্রত্যেকবার উঠে দাঁড়িয়েছি। মারীর চোখে চোখ রেখে বলেছি, অমৃতের সন্তান হারে না। হারতে পারে না। আগামীর পৃথিবীতে তুলসীতলার শাঁখের আওয়াজ থাকবে, ভোরের আজান থাকবে, রবি ঠাকুরের গান থাকবে, শাবল-গাঁইতির ঠং থাকবে, ধর্মতলার ভিড় থাকবে, প্রিয় বই আর চায়ের কাপ থাকবে, পরিচিত হাত থাকবে, স্কুলের মাঠ থাকবে, নবজাতকের কান্না থাকবে। মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সময়। সে সময়ের গায়ে আমাদের ঘাম লেগে আছে।
(সঙ্গের ছবিটা প্রথমবার পিপিই পরার ছবি। ফেসবুকে দিইনি। অতিমারী শেষ হ’লে দেবো বলে জমিয়ে রেখেছিলাম। ‘মারীর দেশ’ সিরিজের লেখাগুলো আজ শেষ। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কতদিন লেখাগুলোর সাথে আমিও হাঁটছিলাম…)