সে এক প্রলয়কাল। তখনও ফটাস করিয়া ব্রহ্মকমল ফুটিত, রামদেব্বাবা জন্মগ্রহণ করিতে পারেন নাই কিন্তু জীবক কথিত গাছগাছালি পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিলো, ভীষক-সকল, কবিরাজকুল,ইউনানী, হেকিম, তন্ত্র, মন্ত্র, তাগা, তাবিজ, মাদুলি, বাবাদুলি, ঘুনসি কবচ, কুন্ডল, জলপড়া, তেত্রিশ কোটি প্লাস দেবদেবী কেলি করিতেছেন। বিপদাপন্ন হৈলে মানুষ নিত্যনতুন দেবদেবী তৈয়ার করিয়া, যেমতি ভীম দ্রৌপদীভোগের বরাদ্দ সময় খতম হৈলে অরণ্যকুমারী হিড়িম্বাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিলেন, তেমতিই নিত্যনব দেবদেবী প্রস্তুত করিয়া হাঁকুপাঁকু করিতেছে। অ্যালোপাথুড়ের হাতে রোগ নিধন হৈলেই সেই দেবদেবীরা হিড়িম্বার ন্যায় পরিত্যক্ত হৈতেছেন। (জানি ভগবান আমার জিভ কেটে দেবে তবুও…)
আমাদের দেশের যত পুজো পার্বণ সবই ব্যক্তি স্বার্থে, অথবা অসহায় মানুষের মিথ্যে ভরসার ফল। এই ভাবে, ঠিক এই ভাবেই এক এক করে অজর অমর দেবতা, সে লৌকিক বা পৌরাণিক, যাই হোক মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষের উদরপট থেকে। বড়ো বড়ো বাকতাল্লা দিলেই তো হবে না।এই দীর্ঘতম লেখায় সেটা প্রমাণ করতে হবে। সেই সব দেবতার স্মৃতিতে হাহুতাশানল করতে হবে, তবেই না?(তবেই যে কি হবে কিসিকো না পতা)
প্রথমেই আসা যাক পাঁচু ঠাকুরের কথায় (শ্রী পঞ্চানন্দ বাবায়ৈঃ নমোহ)।
পাঁচুঠাকুর বা পেঁচো উর্ফ পঞ্চানন্দ। ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম পাঁচি ঠাকুরাণী। তিনি যেমন ভয়ানক রাগী, ওনার গিন্নীও তাই। বাচ্চাদের তড়কা (টিটেনাস) বা রিকেট হলে পাঁচুঠাকুর ভরসা ছিলো। এক সময়ে টিটেনাস রোগে লক্ষ লক্ষ শিশু মারা যেতো। এখন ভ্যাক্সিন আসায় মৃত্যুটা বছরে এক হাজারের কাছাকাছি এসেছে (সরকারি তথ্য)।
গর্ভাবস্থায় মা ভ্যাক্সিন নিলে মায়ের টিটেনাসে মৃত্যু হয় না। এবং শিশুকেও জন্মের পরে পরেই ভ্যাক্সিন দিতে হয়। ডব্লিউ এইচ ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে এই বিষয়ে প্রভূত জোর দিয়েছে, সুতরাং এখন পাঁচুগোপাল নামের শিশু কমই হয়। এবং গণেশ পুজো ইত্যাদির চরম বাড়বাড়ন্তের যুগেও পঞ্চানন্দ বাবা হ্রীয়মান, হতমান। যদিও বা আপনি কোনদিন ইঁদুর মারা বিষ দিয়ে ইন্দুর মেরে থাকেন আর মারবেন না। বাবা গণেশজিউ ক্ষুব্ধ হবেন। তবে গণেশ পুজো সবেমাত্র গুপ্ত যুগ থেকে চালু হয় সুতরাং খুব পৌরাণিক দেব্তা উনি নন (গণেশপুরাণ, মুদগলপুরাণ, গণপতি অথর্বশীর্ষ)।
গণেশের কথা বাদ দিয়ে টিটেনাসে ফিরি।
কেটে যাওয়ার পরে ভ্যাক্সিন নিয়ে কোনও লাভ নেই। আগে নিতে হবে। করোনায় যদি আক্রান্তের তিন শতাংশ লোক মারা যায় তাহলে টিটেনাস মারে পঞ্চাশ শতাংশ লোককে।
আর জং বা মর্চে?
মাধ্যমিকেই পড়েছেন মর্চে বা রাস্ট হলো হাইড্রেটেড আয়রণ (Hydrated Iron (III) Oxide, also known as iron oxide (Fe²O³), as it is caused when iron reacts with oxygen and water – this reaction is known as oxidizing.)। এটার সঙ্গে টিটেনাসের কোনও যোগাযোগ নেই-যে জিনিসেই কাটুক, তাতে টিটেনাস জীবাণু থাকলে টিটেনাস হতে পারে। বাঁচার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি (বিশকুটকুট নয়)।
কয়েক দশক আগের কথা তখন ভারতবর্ষে টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কারে বছরে দুই লক্ষ শিশু মারা যায়। বেশীও হতে পারে (তখনও পাঁচুঠাকুরের রমরমা, হায় আজ সেই গৌরবশশী অস্তমিত।) এমনকি বিখ্যাত সাহেব জিম করবেটের লেখাতেও টিটেনাসে মৃত্যুর মর্মন্তুদ ছবি পাই। মুখের খিঁচুনিতে জিভ কেটে যাচ্ছে, দাঁত ভেঙে যাচ্ছে। শরীরের মাংসপেশীর সঙ্কোচনে হাড় ভেঙে যাচ্ছে, চমৎকার না। দুঃখ করবেন না, আপনার হলে আপনারও একই দশা হবে। বরং আপনারা ভ্যাক্সিন না দিয়ে পাঁচুঠাকুরের পূজার নতুনভাবে শুরু করুন। এখনও ষাঠোর্ধদের মধ্যে টিটেনাসে প্রায় পঁচিশ শতাংশ মৃত্যুহার। ষাঠ নিম্নেও প্রায় তার কাছাকাছি। অথচ অতিজ্ঞানী আমরা ভাবি ছোটদেরই শুধু টিটেনাস হয়! বতারপর কিছু হলেই ডাক্তার পেটাই পরোটা হয়। চমৎকার না?
ওলাইচন্ডী, ওলাবিবি (নামেই প্রমাণিত উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েই এই পুজো প্রচলিত ছিলো, ময়াসুরের বৌ, এবং মহিলার বোনেদের নাম যথাক্রমে-ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, আজগাইবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি)
নমোহ্ মাতা ওলাইচন্ডয়ৈ নমোঃ।
ওলাওঠা (এই নামটা শুনলেই আমার পলিনেশিয়ার হুলা হুলা নাচের কথা মনে পড়ে) রোগের এই দেবী। অর্থাৎ কলেরা থেকে বাঁচার জন্য এই দেবীর আরাধনা ও সৃষ্টি (এখানেও সেই স্বার্থ আর অসহায়ত্ব এই পুজোর মূলকথা)। এখন আর ওলাবিবির সেই বাজার নেই।
ইতিহাস:–সময়টা ১৮১৭, তখন ব্রিটিশ সিংহ ভারতে ন্যাজ নাচাচ্ছে। এশিয়াটিক কলেরা প্যান্ডেমিক হলো। ভিয়ৎনামে, চীনে আর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মড়ক লাগলো। এতে কুড়ি লক্ষ ভারতীয় নাগরিক পটলায়িত হলো। শেষে কয়েকজন বিলিতি সৈন্যও কলেরার প্রকোপে মরে’ ঘোস্ট, স্পুক বা যাহোক কিছু একটা হলো। ফলে বিলেতের লোকজন একটু সচেতন হলো। না হলে নিগার কয়েকটা মরলে তাদের বয়েই গেলো (তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়েই গেলো)।
তখন ঘরে ঘরে ওলাবিবি, ওলাইচন্ডী। আমরা জিম করবেট সাহেবের লেখাতে পর্যন্ত কলেরার কথা পেয়েছি। পাতলা জলের মতো পায়খানা বা চাল ধোয়া জলের মতো পায়খানা সঙ্গে বমি।
তাই আমরা চাই দূরতম গ্রামেও যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র মানে একটা পাকা বাড়িতে একটা ডাক্তার নয়। চিকিৎসার সুব্যবস্থা। নার্স, সাপোর্ট স্টাফ, ওষুধ-সব কিছু। যেন ওলাবিবির মতো অসুখী দেবদেবীরা চটপট বিদায় নেয়।
মাতাশ্রী শীতলা দেবী। ইনি কিসের দেবী জানেন?গুটিবসন্তের দেবী।
১৯৭৪ সালে ভারতে গুটিবসন্তের মহামারী হয়। জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে পনেরো হাজার মানুষ মারা যায়। ৬১,৪৮৩ জন মানুষ হয়তো অন্ধ হয় না হলে পঙ্গু হয়ে যায়। তখন কিন্তু গুটিবসন্তের বা স্মলপক্সের টীকা বেরিয়ে গেছে। অনেক অনেক, গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষ মারা না গেলে কবে আর সরকার মানুষের কথা ভেবেছে? জনস্বাস্থ্য? স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ? এসব খায় না মাথায় মাখে? তথাকথিত শিক্ষিত জনগণই এগুলো নিয়ে ভাবে না, তো ভুখা নাঙ্গা মানুষ মরবেই। যথারীতি মহামারীর পর ১৯৭৫ সালে টার্গেট জিরো ফর স্মলপক্স আসে এবং সমস্ত মানুষকে বিনা পয়সায় ঘরে গিয়ে টীকা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। এর ফলে শীতলা মাতার পুজোর উৎসাহে ভাঁটা পড়ে। হয়তো কদিন পরেই দেবী শীতলা বিস্মৃতির অতলে টুপুৎ করে ডুবে যাবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে স্বাভাবিক ভাবে প্রতিদিন সাতাশ হাজার লোক মারা যায় কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে প্রায় তিন লক্ষ বেশী মৃত্যু হয়েছে অজানা জ্বর আর শ্বাসকষ্টে (সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারা হি কাফি হ্যায়)। শুধুমাত্র মে মাসে রাজস্থানেই ৪৮০০০ জন অতিরিক্ত মারা গেছেন। ঐ অজানা জ্বর আর শ্বাসকষ্টে। এই মুহূর্তে বাকি প্রদেশগুলোর তথ্য মনে পড়ছে না।
সুতরাং স্বাস্থ্যের দাবীটা সকলেরই দাবী হয়ে ওঠা উচিত।
মেয়েদের অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ আর সহমরণের, পুরুষের বহুবিবাহ প্রথা যখন চালু ছিলো, তখন মেয়েদের জন্য বা কুমারী মেয়েদের জন্য অনেক ব্রত পার্বণ চালু ছিলো। যাতে সপত্নী (সতিন) না হয়, শিবের মতো বর হয় (দোজবরে বুড়ো, গেঁজেল, পাতাখোর, বুঝি না বাবা), সন্তানাদি হয়, সংসারে (?) সুখ উপচীয়মান হয়। পৃথিবী ব্রত, কুমারী ব্রত (সেঁজুতি ব্রত), পুণ্যিপুকুর ব্রত, সূতিকাষষ্ঠী (আতুড়ঘরে প্রথম দিন সূতিকাষষ্ঠী, ষষ্ঠ দিনে ঘাটষষ্ঠী, এবং একুশ দিনে জলষষ্ঠী) এই ব্রত পালন করা হতো), ইতু পুজো (উমনো, ঝুমনো নামের দুই মেয়ে ওদের বাবার জন্য তৈরি করা দুটো পিঠে খেয়ে নিয়েছিলো বলে তাদের গহীন জঙ্গলে ফেলে রাখা হয়, তখন তারা ইতু পুজো করে বাবার মঙ্গল কামনা করে)। মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধ হওয়া( গরীব বামুন ঈশ্বর চন্দ্র), মেয়েদের শিক্ষা (গরীব বামুন ঈশ্বর চন্দ্র), বিধবা বিবাহ (গরীব বামুন ঈশ্বর চন্দ্র), সহমরণ বন্ধ হওয়া (রাজা রামমোহন), এই সবের পর এই সব হাবড়ি জাবড়ি ব্রত উঠে গেছে।
সব নারী স্বাবলম্বী হোক, স্বাস্থ্য সচেতন হোক বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
খুব ভালো লাগলো ডাক্তারবাবু লেখা টা।
আমাদের দেশের এই অশিক্ষা, কুসংস্কার, ভ্রান্ত বিশ্বাস যতো তাড়িয়ে দেওয়া যাবে ততই সমাজের মঙ্গল।
আর জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মেয়েদের উন্নত মানের শিক্ষা ব্যাবস্থা।
কারণ যে কোন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মা এর কাছ থেকে।
ডাক্তারবাবুর এই সমাজ কে আলোকিত করার প্রচেষ্টা কে সর্বান্তকরণে সমর্থন করি ও সাধুবাদ জানাই ????
ধন্যবাদ।সবাই এগিয়ে আসুন।
লেখা টা অসাধারণ, এমন মজাদার শ্লেষোক্তি কোন লেখায় থাকলে তা উপভোগ্য হতে বাধ্য। তার সাথে তথ্যের সোহাগা যোগ বড় ভালো লাগলো। তবে শেষ টা এমন হঠাৎ করে না করে আরেকটু দীর্ঘায়িত করা যেত কি?
বেশী দীর্ঘ হলে পাঠক পড়বেন না, এরূপ একটি বদ্ধমূল ধারণা আমার ঘিলুতে প্রোথিত আছে।
খুব ভালো লাগল লেখাটা।
ধন্যবাদ ভাই
খুব ভালো লাগলো।
স্পষ্ট, স্বচ্ছ এবং বলিষ্ঠ।
লেখাটি এই প্রজন্মের অনেককে একটু ঝাঁকিয়ে দিলে ভালো হয়।
Antivaxxer( Naturalist) নামে একটি গ্রুপ উন্নত দেশগুলিতে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। এনারা Small pox, Diphtheria, Tetanus দেখেননি। এ সম্ভাবনা আমাদের দেশেও দেখা দিচ্ছে।
ধন্যবাদ