রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল ভোটপর্ব অবশেষে সমাপ্ত। শেষটুকু আর দেখা হয়নি অবশ্য, কেননা এই রাজ্যে বসবাস করে জোচ্চুরি জুয়াচুরি এমনকি পুকুরচুরি দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেলেও ডা সুদীপ্ত রায়ের নেতৃত্বাধীন ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’-দের প্যানেল কর্তৃক যে নির্বাচনী প্রহসন – যাকে অত্যন্ত দক্ষ হাতে পরিচালনা করলেন মেডিকেল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার তথা এই নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মানস চক্রবর্তী মহাশয় – তা সবরকমের প্রত্যাশা অতিক্রম করে গিয়েছে। দুপুরের দিকেই জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ভোটগণনা বয়কট করে বেরিয়ে আসে। তাতে অবশ্য ইতর-বিশেষ কিছু হয়নি।
রাতের অন্ধকারে জোচ্চুরি তো বটেই, গতকাল একাধিক কাউন্টিং অফিশিয়ালকে আমরা হাতেনাতে ধরি – তিনি যত্নসহকারে আমাদের প্যানেল ভোটের ব্যালটে বাড়তি ক্রস চিহ্ন মারছিলেন। আমরা তখনও বেরিয়ে আসতে পারতাম।
পরশু যখন দেখা গেল, গণনায় ক্যানসেলড চিহ্নিত ব্যালট আবার গণনার জন্য উপস্থিত – অর্থাৎ কিনা গোনা হয়ে যাওয়া ব্যালটই আবার গোনার জন্য টেবিলে আসছে – তখনও বেরিয়ে আসতে পারতাম।
অথবা যখন তৃণমূলপন্থী তরুণ চিকিৎসক কাউন্টিং টেবিলে বসে পঁচিশের গোছার শুরুর ব্যালট দেখেই, ওঃ, এতে তো পঁচিশটাই আমাদের প্যানেল বা আরে, এটাতে তো পঁচিশটাই ক্যানসেল হবে এমন ভবিষ্যৎবাণী করছিলেন – এবং অনিবার্যভাবে কথাগুলো মিলেও যাচ্ছিল – বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে তিনি বলছিলেন, জানেন না, আমি তো জিনিয়াস!! – তখনও না হেসে বেরিয়ে আসতে পারতাম।
বেরিয়ে আসিনি। কেননা আমরা চেয়েছিলাম, নির্বাচনটা হোক। তদুপরি যে হাজারে হাজারে চিকিৎসক সবরকম আলস্য-সঙ্কোচ-ভয়-প্রলোভন জয় করে আমাদের ভোটটা দিলেন, তাঁদের সেই আবেগের প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা সম্মানবোধ দায়বদ্ধতা আমাদের বেরিয়ে আসতে দেয়নি।
বিশ্বাস করুন, গণনা শুরুর দ্বিতীয় দিনে জোচ্চুরির নতুন রাস্তাগুলো দেখে ফেলার পর আমরা এতটুকু অবাস্তব আশায় ছিলাম না যে আমরা জিতব।
কেননা, জোর করে ব্যালট ছিনতাই করা বা জাল ব্যালট ছাপিয়ে জমা করা বা রিটার্ন ব্যালটের ট্রাঙ্ক খুলে সেই ব্যালট জমা করা – এসব যে অল্পবিস্তর হবেই, আমরা জানতাম। অল্প নয়, বিস্তরই হবে, তাও জানতাম। তারপরও জানতাম, আমরা জিতবই। প্রতিপক্ষ শিবিরের এক চিকিৎসক একান্তে যেমন বলেই ফেললেন, দাদা, আমাদের হিসেব ছিল সিক্সটি-ফর্টি, মানে তোমরা সিক্সটি পার্সেন্ট ভোট পাবে, আমাদের সেই অনুযায়ী ম্যানেজ করতে হবে। কিন্তু গোনা শুরু হতে দেখি, তোমরা এইট্টি পার্সেন্টের বেশি পাচ্ছো!!! তখন…
আমরা সেকথা জানতাম। মানে, ধরেই নিয়েছিলাম, ভোটের তিরিশ শতাংশ জুয়াচুরি হলেও বাকি সত্তর শতাংশের তিন-চতুর্থাংশ ভোট আমরা পেলেই জিতে যাব।
কিন্তু গণনার দ্বিতীয় দিনে – ‘নিরবচ্ছিন্ন’ ভোটগণনায় যখন সাত-ঘণ্টার বিরতি ঘোষিত হলো, এবং যে সাত ঘণ্টা কাউন্সিলের কর্মী ও কাউন্টিং অফিশিয়াল বাদে আমাদের সবাইকে বের করে দেওয়া হলো – তার পর থেকেই যখন দেখলাম যে আমাদের প্যানেল-ভোটের ব্যালটে বাড়তি চিহ্ন জুড়ে ক্যানসেল করানোর খেলা শুরু হয়েছে, তখনই ফলাফলের আন্দাজ পাওয়া গিয়েছে। বিশেষত দ্বিতীয় দিনের নৈশ বিরতির পর গণনা শুরু হতে যখন দেখলাম যে আমাদের প্রাপ্ত ভোটের চাইতে ‘নতুন পথে ক্যানসেল করানো’ ব্যালটের সংখ্যা বেশি, তখনই খুব একটা সংশয়ের প্রশ্ন ছিল না। সত্যি বলতে কি, জনসমর্থনের সুনামির কারণে, তারপরও, প্রত্যেকদিনই দিনের শেষে আমরা বেশ ভালো অবস্থায় ছিলাম – অন্তত প্রতিযোগিতায় ছিলাম – কিন্তু আমি জানতাম – অন্তত আমার মনে তিলমাত্র সংশয় ছিল না – এই ভালো অবস্থায় থাকার অর্থ আমাদের জয়ের সম্ভাবনা বাড়া নয়, এর অর্থ শাসকপক্ষের যে দায়বদ্ধ সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে কাজ করতে ভালোবাসে, তাদের নৈশ কাজের প্রেশার বাড়া বই অন্য কিছু নয়।
অর্থাৎ, আমরা এমনকি পঁচানব্বই শতাংশ ভোট পেলেও আমাদের প্রার্থীরা কেউই জিতবেন না। না, পঁচানব্বই শতাংশ ভোটার আমাদের সমর্থনে, এমন দাবি কখনোই করছি না। কিন্তু এমন জোচ্চুরির ভোটেও যখন দেখি শেষমেশ আমাদের সঙ্গে ওদের ভোটের ফারাক আড়াই হাজারের (আমরা যতক্ষণ ভেতরে ছিলাম, ততক্ষণ ব্যবধান ছিল বাইশশো ভোটের – বেরিয়ে আসার পর, বলাই বাহুল্য, খেলা হয়েছে অবাধে) এবং আমাদের প্যানেল-ভোট বাতিলের সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশি – মনে করিয়ে দিই, ওদের পক্ষে অজস্র জাল ব্যালটও ছিল – তখন আমাদের পক্ষে সমর্থনের পরিমাণটা আন্দাজ করা যায়।
তো যা-ই হোক, বেরিয়ে এসেছি। ফল ঘোষণা হয়ে গিয়েছে৷ প্রত্যাশিত ভাবেই, আমরা হেরে গিয়েছি। হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলতেই পারি – কিন্তু বাকি কথা আদালত বলবেন।
অ্যাড-হক কমিটির চেয়ারম্যান ডা সুদীপ্ত রায় এবং রিটার্নিং অফিসার মানস চক্রবর্তী, দুজনের নামে বিধাননগর থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আর আদালত শুধু খোলার অপেক্ষা।
আপাতত বিরতি। আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি ইত্যাদি প্রভৃতি। টানাপোড়েন আবেগ-ভালোবাসা হতাশার এই দিনগুলোর স্মৃতি চট করে ভুলব না। প্রথমে ছেলের অসুস্থতা, শেষের দিনকয়েক নিজেও বাজেরকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, এখনও বেশ নড়বড়ে – যতখানি সময় আমার ওখানে দেওয়ার কথা ছিল – দেওয়া উচিত ছিল – তার কমই দিতে পেরেছি। সহযোদ্ধাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ইন ফ্যাক্ট, অনেক কিছু শিখলাম। আদর্শের জন্য দাঁতে দাঁত লড়াই, মাটি কামড়ে পড়ে থাকা – এসব বইয়ে যত ঘনঘন পড়া যায়, বাস্তবে ততখানি নয়। সৌভাগ্যক্রমে, হাতেকলমে দেখার সুযোগ পেলাম – শিখে উঠতে পারলাম কিনা, নিশ্চিত নই। কয়েকজনের কথা পরে হয়ত লিখব, আজ আপাতত বড্ডো ক্লান্ত।
সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা। একটু ক্ষমাও চেয়ে নিই, আরও বেশিক্ষণ পাশে থাকতে পারিনি বলে। শারীরিক ক্লান্তি নিয়ে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে খিটখিটিয়ে কথা বলেছি বলে।
তারপর যেটুকু জানানোর, তা হলো, আবারও – কুর্নিশ। অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
হ্যাঁ, তাঁদের মধ্যে আপনিও ছিলেন। শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন, আপনিও এই লড়াইয়ে সহযোদ্ধাই। পরের বার নিশ্চয়ই সামনাসামনি আলাপটাও হয়ে যাবে।