সেখ সাজাহানের দৌলতে সন্দেশখালি নামটা এখন সুপরিচিত। তবে, আমার সঙ্গে সন্দেশখালির পরিচয় পঞ্চাশ বছরেরও আগে। বন্যায় রিলিফ দেবার জন্য পিপলস্ রিলিফ কমিটি (পি.আর.সি.) থেকে পাঠিয়েছে, এদিকে ডাক্তারির জ্ঞানশূন্য কারণ সম্ভবতঃ তখন ফার্স্ট বা সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্র। পিকে ব্যানার্জীর মতো ভোকাল টনিক বা পেপ টক দিয়ে সিনিয়ররা পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে, সম্ভবতঃ একজন সিনিয়র সঙ্গে ছিল। এক জায়গায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কৃষকনেতা ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য্য। ছোটখাট চেহারা, একটা চোখে সমস্যা আছে..সময় নষ্ট না করে আমাদের নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। আমার ধারণা ছিল (এখনও একটু হলেও আছে) হাঁটা বা দৌড়ানোতে আমি যথেষ্টই পারদর্শী। সেই আমি তখনও ‘টীন’ (teen) পার হইনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আধা দৌড় আধা হাঁটা-দৌড় করে তো প্রায় বিপর্যস্ত! সঙ্গী সিনিয়রের অবস্থা তো আরও খারাপ। একটাই ভরসা যে মাঝে মাঝেই উল্টোদিক থেকে যেই আসছিল, দাঁড়িয়ে গিয়ে কুশল প্রশ্ন করছিল আর ক্ষুদিরামবাবুকেও সাময়িক বিরতি দিতে হচ্ছিল’, আর আমাদের জন্য হাঁপ ছাড়ার অবসর। পরপর তিনদিন ঐভাবে হাঁটা আর মাঝে মাঝে বিশ্রাম ও রোগী দেখা; রাস্তা মানে একেবারেই গ্রামের উঁচু নীচু, জায়গায় জায়গায় প্রায় আলের কাছাকাছি। তৎকালীন সময় কিন্তু প্রাক পঞ্চায়েত বা সড়ক যোজনার পূর্ববর্তী অধ্যায়!!
দ্বিতীয়বার সন্দেশখালি যাত্রা কোনও একটা কৃষক সম্মেলন উপলক্ষ্যে কোনও একটা নদীর ধারে (নদীর নামটা মনে নেই), সময়টা বর্ষাকালে।বর্ষাকালে কাদা যে কী জিনিস হতে পারে বিশেষ করে এই অঞ্চলে, এর আগে সে সম্বন্ধে আমার কোনও রকম ধারণাই ছিল না, যদিও এমন নয় গ্রাম সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অনভিজ্ঞ!! এতো পিচ্ছিল, আঁঠালো কাদা অন্যত্র কোথাও আছে কিনা ঘোর সন্দেহ! জুতো তো অনেক আগে পদচ্যুত, তার পরেও কতবার আছাড় খেয়েছি গোনা সম্ভব নয়। আসলে পায়ের পাতা ও আঙুলগুলোর মাটিকে ‘গ্রিপ’ করার টেকনিক ও অভ্যাসটাই আলাদা, যেটা এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে প্রায় অক্লেশ অনায়াসলব্ধ। সম্ভবতঃ, ওদের পায়ের পাতা ও বুড়ো আঙুলের গঠনটাই কিছু ভিন্নতর রূপ পরিগ্রহ করে দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে!!
যাহোক, নদীতে নৌকোয় উঠতে ও নৌকো থেকে পাড়ে উঠতে বেশ কয়েকবার পপাত ধরণীতল হবার পরে সম্মেলনস্থলে গিয়ে দেখি স্বমহিমায় কমরেড ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য্য! যে ঘরে আমাদের ওষুধপত্র সমেত বসতে (এবং রাতে শুতেও) বলা হলো, সেটাই সাময়িকভাবে ওনার মূল অফিস বা information centre। সারাক্ষণ মাইকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন almost non-stop !! না বসে বসে নয় টানা দাঁডিয়ে।
একে তো কাদা মেখেই থাকা, কারণ থাকার জায়গার মেঝেও কাদার ; পা ধুলেও আবার কাদা!! তার ওপর সারাক্ষণ মাইকের তারস্বরে ঘোষণা..সব মিলিয়ে অতি করুণ অবস্থা। পরের দিন সকালে প্রাতকৃত্য করতে একটু জনবিরল জায়গায় যেতে গিয়ে নদীতীরের পলিতে প্রায় আমূল গেঁথে যাওয়ার অবস্থা! কাউকে কিছু না বলে নিজের ব্যাগ নিয়ে নদী পেরিয়ে সোজা চম্পট!! জীবনে পালানো এই প্রথম বা এই শেষ কোনটাই নয়। পণ্ডিতরাই তো বলেছেন ‘যঃ পলায়তি স জীবতি’!!
ঠিকই, পলায়ন করে একবার সত্যি করেই জীবনরক্ষা ঘটেছে বটে, আর সেই ঘটনায় প্রায় মৃত্যুমুখে পড়েছিল’ ধ্রুবজ্যোতি রায়, পরিণত বয়সে যার রেশ তাকে এখনো বহন করে যেতে হচ্ছে। যাক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
তবে, আমি পলায়ন করলেও ক্ষুধিরাম ভট্টাচার্য্যরা তো পালান নি, ‘৬০-৭০ এর সময় থেকে আরম্ভ করে ‘৭৭ পর্য্যন্ত লাগাতার সন্ত্রাস, হয়রানি ও প্রাণনাশের ব্যাপক সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেই…….
আমার মূল প্রশ্নটা হলো, ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য্যের মতো কৃষকনেতারা যে অঞ্চলগুলিতে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেই সন্দেশখালি, হারোয়া, হাসনাবাদ, কাকদ্বীপ-এর কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস তো বিশাল; শুধু তেভাগা আন্দোলন নয় তার আগেও বৃটিশ শাসনের সময় থেকেই। তাহলে, কী এমন ঘটলো যে সেই সব অঞ্চলে এখন দাপটে রাজত্ব করে সেখ সাজাহান বাহিনী প্রায় একাধিপত্যে?? জমিদার-জোতদার, গুণ্ডাবাহিনী,পুলিশ প্রশাসন এক সময়ে যাদের নিয়ন্ত্রণে একান্ত ব্যর্থ.., আজ কোন মন্ত্রবলে সেখানে রাজত্ব করছে লুটেরা বাহিনীর বস!! হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন এর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে সন্দেশখালি!! এটা ঠিকই যে অভূতপূর্ব সন্ত্রাস, আর তার সঙ্গে মিথ্যা মামলার পাহাড় চাপিয়ে যতভাবে সম্ভব বিপর্যস্ত করা হয়েছে সম্ভাব্য প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে; বিলানো হয়েছে লুন্ঠিত ধনসম্পদের কিয়দংশ মনুষ্যক্রয়ের উদ্দেশ্যে। এটাও ঠিক যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও urbanisation & consumerism-এর প্রভাব মানুষকে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে এমনকি সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষকেও। এলাকার ব্যাপক মানুষ কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছে অন্যত্র বিশেষতঃ আয়লা ও আমফান পরবর্তী সময়ে।
কিন্তু, এই কারণগুলোই কী যথেষ্ট একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তনে.., সামাজিক বা রাজনৈতিক মননে ও কার্যকলাপে?? যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা ধারাবাহিকতা থাকে, তা সে যত দ্রুতই ঘটুক আর কার্যকারণ বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যাই হোক না কেন!! তাহলে এই ব্যাপক পটপরিবর্তনে ধারাবাহিকতার (continuity) বিভিন্ন ‘স্টেপ’ গুলো কি কি?? একটা পরিবর্তন শুরু হওয়ার আগে থেকেই আরম্ভ হয় তার ক্ষেত্র প্রস্তুতির কাজ। সেটার প্রারম্ভ কোন সময় থেকে..?
মুশকিল হল’, আমাদের দেশে সামাজিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তথ্যের থেকে তত্ত্বের গুরুত্ব অনেক বেশি থাকে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হল’ তথ্যের অপ্রতুলতা বা ঘাটতি। তাছাড়া, তথ্যের বিষয়েও unbiased survey বা নির্মোহ অনুসন্ধানের মানসিকতারও অভাব রয়েছে ভীষণভাবেই। আসলে, আমাদের দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মূলতই ‘বিষয়ীগত’ বা subjective ও তাত্ত্বিক..,বাস্তবতার সঙ্গে যার যোগাযোগ সব সময়ে সমানভাবে দৃঢ় বা শক্তিশালী নয়। পৃথিবীর নানা দেশে রাজনৈতিক দলগুলি এখন পেশাদার সংস্থাগুলি সাহায্য নেয় তথ্যের খাতিরে এবং কৌশল ও রণনীতি নির্ধারণে। আমাদের দেশে বামপন্থী দলগুলির এ বিষয়ে যথেষ্ট আপত্তি ও অনীহা দুইই আছে। মূলতঃ তাত্ত্বিক এবং কিছুটা আর্থিক কারণেও বটে। কিন্তু, সেক্ষেত্রে তো সেই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে নিজেদেরকেই, বোঝানোর থেকে এক্ষেত্রে বোঝাটাই বেশি জরুরি…….
যুব সংগঠনের সাম্প্রতিক পদযাত্রা ও জমায়েতের কারণে এই মুহূর্তে বামপন্থীমহল যথেষ্ট উৎসাহী। এটাও তো ঠিক, দায়িত্ব যুবসমাজকেই নিতে হবে আগামীদিনের। তাহলে, তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, মানুষের কাছ থেকে নিরাসক্ত পক্ষপাতহীন (unbiased) তথ্যানুসন্ধান ও সংকলনে, যাতে সমাজজীবনের একটা পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে আগামীদিনের আন্দোলনের রূপরেখা ও পথনির্দেশের জন্য।
আমাদের দিন ও সময় শেষ। দেখা যাক পরবর্তী প্রজন্ম কোন পথ বেছে নেয়; তবে, গুণ্ডাতন্ত্র ও লুটেরারাজ অবসানই যে অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা উচিত, সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র কোনও সন্দেহের অবকাশ আছে বলে তো মনে হয় না…… ❗❗