“নিয়ম কানুনের একটা জায়গাতেও লেখা নেই যে কয়লাখনিতে দুর্ঘটনার ফলে কোনো অসুস্থতা বা মৃত্যু হলে খনি মজুরেরা কোনো বিশেষ ভাতা পাওয়ার অধিকারী হবে। খনি দুর্ঘটনার ফলে প্রতিবন্ধী হয়ে গেলে পেনশনের হার বৃদ্ধির ও কোনো উল্লেখ নেই।” আজ্ঞে না, এই লাইনগুলো আজ উদ্ধার পাওয়া শ্রমিকদের সম্পর্কে লেখা নয়, লেখা হয়েছিল অনেক দিন আগে,১৮৬৯ সালে। সেই সময়ের জার্মানির স্যক্সনির কয়লাখনির শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক সংগঠনের সভ্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন এবং মার্ক্সের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করেন। মার্ক্স তাঁর পরম সুহৃদ আরেক বিখ্যাত বিপ্লবী নেতাকে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন লিখতে অনুরোধ জানান। সেই বিপ্লবী সেইটা লিখে জমা দেন। সেইটাই মার্ক্স ২৩ শে ফেব্রুয়ারির সভায় পড়ে শোনান। এবং কয়েকটি সংবাদ পত্রে পাঠান লেখাটি প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে, কেউ কেউ যেমন ডার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট–এরা প্রকাশ করলেও টাইমস, ডেইলি নিউজ, মর্নিং এডভার্টাইজার লেখাটি প্রকাশ করতে অসন্মত হয়। পুঁজিবাদের শোষণের নগ্ন স্বরূপ উন্মোচন করা অমন বিস্ফোরক লেখাটা প্রকাশ করাটা ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কাল সংবাদপত্রে বড় বড় করে প্রকাশিত হবে সুড়ঙ্গ শ্রমিকদের উদ্ধার কাজের বিবরণ। তাঁরা অক্ষত দেহে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে ধন্যবাদ জানানো হবে অনেককেই। মানবিকতার জয় গানে ভরপুর একটা গল্প। বলিউড টলিউড কিনেও নিতে পারে সেই গল্প। আগামী পুজোর সময় শুভমুক্তি হবে পাশের প্রেক্ষাগৃহে। অক্ষত দেহের পাশাপাশি ওই শ্রমিকরা অক্ষত মনে বেরিয়ে আসতে পারলেন কিনা, ওই ভয়ানক সুড়ঙ্গে দিনের পর দিন কাটানোর ফলে তাঁদের কত জন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার নামক মানসিক রোগের শিকার হয়ে গেলেন বাকি জীবনটার মতো, সেই খতিয়ান হয়তো থাকবে না। থাকবে না এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে কাটানোর জন্য তাঁরা কি ধরনের ক্ষতিপূরণ পাবেন, সেটা পরিমাণে যথেষ্ট কিনা, থাকবে না এই ঘটনার জন্য দায়ী কারা, তাদের কোনো শাস্তি বিধান আদৌ হবে কিনা, থাকবে না দেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রায় সব বিধি বিধান মুনাফার লোভের জন্য শিকেতে তুলে দেওয়া মালিকদের আর তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলগুলির নির্লজ্জতার কথা। থাকবে না তার কারণ কালকের প্রতিবেদন লেখকদের কারুর নাম ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নয়। তারা সব কর্পোরেট হাউজের ভাড়া করা কলমচি।
মার্ক্স এঙ্গেলস বাতিল বুড়ো ঘোড়াদের দলে বলে যাঁদের মনে হয়, তাঁরা একটি বার কষ্ট করে পড়ে দেখুন এঙ্গেলসের সেই অসামান্য প্রতিবেদন। স্থান, কাল আর পাত্রের জার্মান নামগুলো পালটে দিলে মনে হবে ওটা আজ রাত্রেই লেখা। এতটাই প্রাসঙ্গিক, হ্যাঁ, এখনও। ১৮৬৯-এর লড়াই আজ এই ২০২৩ সালের শেষের দিকে এসেও লড়তে হয়, কারণ শ্রমিকরা তাঁদের ন্যায় দাবি দাওয়া আজও আদায় করে নিতে পারেন নি। সেই লড়াই সংগ্রামের পথে অবিস্মরণীয় একটি নাম এঙ্গেলস। আজকের এই অবিস্মরণীয় সংকট মোচনের দিনে হিরোদের নামে জয়ধ্বনির পাশাপাশি বর্ষিত হোক ভিলেনদের জন্য একরাশ ঘেন্না। হিরো আর ভিলেন চিনতে যেন ভুল না হয়। চিনতে ভুল করলে চিনিয়ে দেবেন এঙ্গেলস। আজ তাঁর জন্মদিন।
২৮ শে নভেম্বর, ২০২৩