ধরুন, আপনি গিয়ে পড়েছেন হিরোশিমা-য়। মেরামত হয়ে নতুন করে গড়ে ওঠা আজকের হিরোশিমা শহরে নয়, ধরা যাক আপনি গিয়েছেন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। পারমাণবিক বোমা পড়ার পর বছরদশেক সবে অতিক্রান্ত। আপনি পৌঁছেছেন হিরোশিমা নামের কোনও শহরে নয়, একটা শহরের ধ্বংসস্তূপে। পোড়া চামড়ার দমবন্ধ করা গন্ধ তখনও ঢাকা পড়তে পারেনি ডিওডোরেন্ট, সুগন্ধি ও নতুন নির্মাণের টাটকা রঙের ঝাঁঝালো গন্ধে। আপিস-ইশকুল কারখানা, যার ভেঙে পড়া দেওয়ালের গায়ে আটকে গিয়েছিল পুড়ে গলে যাওয়া মানুষের মাংস – তখনও সেসব চিহ্ন মুছে প্রলেপ দিয়ে নতুন দেওয়াল তোলা সম্ভব হয়নি। সেই শহরের রাস্তার ধ্বংসাবশেষে কালচে ছায়া দেখলে আপনি তখনও ধন্দে পড়ছেন, সে কি প্রবল তাপে রাস্তার সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষের দেহের চিহ্ন, না কি স্রেফ গাছের ছায়া। তাছাড়া গাছগুলো তো তখনও নিষ্প্রাণ – দু’চারটে গাছে একটি দুটি করে কচি পাতা গজানোর চেষ্টা ঘটেছে বটে, কিন্তু সে পাতা নতুন প্রাণ হয়ে উঠতে পারেনি। পারবেই বা কী করে! আপনার সঙ্গে থাকা গাইগার কাউন্টার আপনাকে সমানে জানান দিয়ে চলেছে, এখানে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ এখনও বিপদসীমার নিচে নামেনি। এ অঞ্চলে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো একেবারেই নিরাপদ নয়।
দীর্ঘশ্বাস চেপে আপনি ফিরে আসছেন। একরকম বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে চাইছেন বটে, কিন্তু মনে মনে আপনি বুঝতে পারছেন, আজকের পরে আপনার মনের একটা অংশ এই হিরোশিমা নামক ভগ্নস্তূপের দৃশ্যের মতো করেই বিবর্ণ হয়ে রইল, পাকাপাকিভাবে। ফিরে আসছেন। দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারলেও মনের গভীরে প্রশ্নটা আর লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। আহ্, এই তবে বিজ্ঞান! বিজ্ঞানের উৎকর্ষের অন্যতম দিকচিহ্ন বলতে তাহলে এ-ই!!
একই প্রশ্ন আপনি করতে পারতেন, আউশভিৎস-এ দাঁড়িয়ে৷ কম খরচে চটজলদি বেশি মানুষ মেরে ফেলা যাবে, একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে তার উপযোগী রাসায়নিক গ্যাস তৈরি করে একনায়কের হাতে তুলে দিয়েছিলেন যিনি, ‘শুদ্ধ বিজ্ঞান’-এর দৃষ্টিতে দেখতে চাইলে তিনি তো কিছু কম বড় বিজ্ঞানী ছিলেন না! আহ্, বিজ্ঞান বলতে তবে এ-ও!!
বা প্রশ্নটা করতে পারেন অধুনা পরিত্যক্ত জাপানি ক্যাম্পেও – যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মানুষকে গিনিপিগ করে চালানো হয়েছিল অজস্র ‘পরীক্ষানিরীক্ষা’। না, অনেকে যেমন মনে করেন, একনায়কের আদেশে তাঁরা এসব পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, এমন কখনোই নয়। তাঁদের ‘প্রথাভাঙা গবেষণা’ ছিল রীতিমতো স্বতঃপ্রণোদিত – বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের নেশায় ব্যাপৃত।
প্রশ্নটা অযৌক্তিক, এমন কখনোই নয়। কিন্তু ধরুন, তখুনি কেউ বলে উঠলেন, বিজ্ঞানী তো পরিণামের হিসেব কষে গবেষণা করেন না। তাঁর আবিষ্কার ভালো বা খারাপ, দুভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে। গবেষণার ফলের অপব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীকে বা সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানকে দায়ী করার যুক্তি আছে কি? আর তাঁর সেই বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে কেউ বললেন – বাঃ! সুফল পাওয়া গেলেই বিজ্ঞানীর কৃতিত্ব, আর ফল বিষময় হলেই বিজ্ঞান দোষগুণ বিচারে উর্ধ্বে!! আচ্ছা, এমনটা আপনারা কেন বিশ্বাস করতে – এবং করাতে – চাইছেন, যে, প্রচলিত সামাজিক ধ্যানধারণার উর্ধ্বে উঠে বিজ্ঞানের লক্ষ্য নির্বিকল্প সত্যের সন্ধান? বা বিজ্ঞানের লক্ষ্য তেমনটাই হওয়া উচিত? সারা বিশ্ব – অন্তত নিজেদের ‘সভ্য বিশ্ব’ বলে যাঁরা অহঙ্কার করেন (আর ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ তো মূলত তাঁদের হাতেই নির্মিত) – সেই তাঁরা যখন দু’পক্ষে ভাগ হয়ে মারামারি খুনোখুনি করছেন, তখন বিজ্ঞান-ই বা সেই রেষারেষির বাইরে কাজ করবে কী করে? এ তো বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ নয়, এ হলো এক গোলমেলে সময়ে যেমন বিজ্ঞানচর্চা প্রত্যাশিত (বাঞ্ছিত হোক বা না হোক), ঠিক তেমনটাই।
সত্যিই তো! তৎকালীন বিশ্বে ঔচিত্যবোধের পরিবেশ এমনই দাঁড়িয়েছিল, যে, সেখানে দাঁড়িয়ে এমন বিধ্বংসী বোমা তৈরি করা বা মানুষের উপর এমন নিষ্ঠুর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়াটা সম্ভব তো বটেই, এমনকি অপ্রত্যাশিতও নয়। দায় একা বিজ্ঞানের নয়, অবশ্যই। কিন্তু বিজ্ঞান-কে প্রচলিত সামাজিক ভাবনাচিন্তা বা উচিত-অনুচিতের বোধের উর্ধ্বে মহত্তর কিছু একটা বলে বিশ্বাস করতে চাওয়া, সে-ও, বোধকরি, ঠিক নয়।
প্রশ্নটা তাহলে করেই ফেলা যাক। সমকালীন নীতিবাস্তবতার প্রেক্ষিতের উর্ধ্বে বিজ্ঞানের অবস্থান – শুদ্ধ বিজ্ঞান বা প্রায়োগিক বিজ্ঞান, অথবা উভয়ই – এমন বিশ্বাসের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে কি? নাকি, বিজ্ঞানীর নীতিবোধ – সমগ্রের হিসেবে যা বিজ্ঞান-গবেষণার নীতিবোধ-ও – তা সমকালীন নীতিবোধের ভাবনা দ্বারাই পরিচালিত হয়?
প্রশ্নটা করে ফেলা কঠিন না হলেও, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়াটা আমাদের পক্ষে সহজ নয়, কেননা, বিজ্ঞানীর গবেষণার ধরনধারণ বা সামগ্রিকভাবেই বিজ্ঞান কীভাবে ঘটে – যাকে ইংরেজি লব্জ ধার করে বলা যায়, হাউ সায়েন্স ইজ ডান – সে বিষয়েই আমাদের ধারণা বেশ ঝাপসা।
#####
বিজ্ঞান কী? বা, বিজ্ঞান কী খোঁজে?
উত্তর। প্রশ্নের উত্তর। নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান কোনও বিশেষ প্রশ্নের উত্তর – মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্যই হোক বা নিতান্ত দৈনন্দিন ঘটনাবলী, তার কারণ বা ব্যাখ্যা – খোঁজে।
বেশ কথা। কিন্তু অনুসন্ধানের পথ বিজ্ঞানের চাইতে ভিন্ন হলেও, ধর্ম-ও তো তা-ই খোঁজে, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু বিজ্ঞান হলো এমন সন্ধান, যাকে ভুল প্রমাণ করা যায়। কথাটা আমার নয়, গত শতকের বিখ্যাত বিজ্ঞান-দার্শনিক কার্ল পপার-এর। ভুল প্রমাণ করা সম্ভব – এর অর্থ কিন্তু বিজ্ঞান মাত্রেই ভ্রান্ত, এমন নয়। এর অর্থ, একটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি করে। নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে যদি সেই দাবিগুলোকে ভুল প্রমাণ করা যায়, বা যদি সেই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত কোনও উদাহরণ দেখা যায়, তাহলে সেই তত্ত্বটিই ভুল, এমন মেনে নেওয়া হয়।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। আরেকদিকে, ধর্মের কথা দেখা যাক। ঐহিক সমৃদ্ধির বাইরেও জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য খুঁজতে যায় যে ধর্ম, বা অস্তিস্ত্বের দৈনন্দিনতার অধিক তাৎপর্যের অনুসন্ধানে ব্রতী যে ধর্ম, সেই ধর্মের কথা আপাতত সরিয়ে রাখছি। কিন্তু আশেপাশে ধর্ম বলতে যা দেখি, বা বাজারচলতি ধর্মগুরুদের বক্তব্য থেকে ধর্ম বলতে শেষমেশ আমরা যা বুঝি, তার ক্ষেত্রেও এই ‘ভুল প্রমাণ করে ফেলা যায়’ এমন ক্রাইটেরিয়া প্রয়োগ করা যায় কি?
ধর্ম বলতে যদি আধ্যাত্মিকতা বুঝি, তাহলে তাকে বিজ্ঞানের জগতে মান্য যেসব সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, তার কোনোটি দিয়েই সেই ধর্মকে প্রমাণ বা বাতিল করা সম্ভব নয় (সম্ভবত, এক্ষেত্রে বাতিল/প্রমাণ কোনোটিই জরুরি নয়, কেননা ধর্মকে এই অর্থে ধরলে তার সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাতের সম্ভাবনা সীমিত)। কেননা, তা একান্ত উপলব্ধি সঞ্জাত – বহির্জগতের নির্দিষ্ট সূত্র দিয়ে তাকে প্রমাণ বা বাতিল কোনোটিই করা যায় না। উপনিষদে তো ব্রহ্ম-কে স্পষ্টভাবেই অপ্রমেয় বলে জানানো হয়েছে।
কিন্তু ধর্ম বলতে যদি কিছু আচার-এর সমষ্টি ধরি বা সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি বা বক্তব্যের সমাহার বুঝি, তাহলে সেই আচারের সারবত্তা বা বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ বা বাতিল, দুইই করা সম্ভব। ধর্মের ক্ষেত্রে তেমনটি সম্ভব হয় কি? ধরুন, একটি বিশেষ ধর্মের নাম করে কেউ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েকশো লোক মেরে ফেলল। বা, আরেক ধর্মের নামে কেউ একজনের বাড়ি চড়াও হয়ে মানুষজন সমেত বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিল। এ তো কোনও কষ্টকল্পনা নয়, আশেপাশে আকছার ঘটছে। তাহলে তো ধর্ম মানেই শান্তির বাণী বা ধর্ম মানেই মানুষে মানুষে মিলেমিশে থাকা, এমন নয় – বরং উপরোক্ত উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট, অন্তত এই ক্ষেত্রে, আর কিছু নয়, ধর্ম-ই হিংসা-মারামারি-কাটাকাটির কারণ। এবং তা-ই যদি মানেন, তাহলে ধর্ম শান্তির বার্তাবাহী, এই দাবি মিথ্যা। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে একথা বললেই উত্তর পাবেন, না না, ধর্ম ব্যাপারটা মূলগতভাবে ভালো, এসব ঘটনা স্রেফ বিকৃতিমাত্র। অনুরূপ উদাহরণ এদেশের জাতিভেদ প্রথা অথবা ইসলাম-ধর্মাচার বা মধ্যযুগীয় খ্রিষ্ট-ধর্মাচারে নারীদের অবদমন নিয়েও দেওয়া যায়, কেননা এর প্রতিটিই সম্ভব হয়/হয়েছিল ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে অথবা ধর্মগুরু/ধর্মপ্রতিষ্ঠান – যাঁরা কিনা ধর্মের অছি হিসেবে নিজেদের দাবি করেন ও ধর্মবিশ্বাসীরা সেই দাবি মেনেও নেন – তাঁদের নির্দেশ অনুসারেই। কিন্তু, ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন, এমনকি যাঁরা উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলোকে অনুচিত ভাবেন তাঁরাও, এগুলোকে ধর্মের অন্তর্গত খামতি হিসেবে মানতে চাইবেন না। অর্থাৎ, আপনি যে উদাহরণই নিন না কেন, বাজারচলতি ধর্মকে ভুল প্রমাণ করা বা ধর্মাচারের মূল দাবিগুলোকে অসার প্রমাণ করা অসম্ভব।
একই কথা জ্যোতিষ-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যতই বলুন, জ্যোতির্বিজ্ঞানে রাহু-কেতুর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি – বা প্রশ্ন করুন, মানবদেহে বা মানুষের ভাগ্যে শুক্র-মঙ্গল-বৃহস্পতির প্রভাব যদি এত তীব্র হয়, তাহলে বেচারা ইউরেনাস বা নেপচুন কেন সে কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হবে – অথবা চোখে আঙুল দিয়ে দেখান যে, জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণী মেলার চাইতে না মেলাটাই দস্তুর – অথবা প্রশ্ন করুন, রেল/বিমান দুর্ঘটনায় মৃত প্রতিটি মানুষেরই জন্মক্ষণে ওই নির্দিষ্ট দিনটিতে অপঘাতে মৃত্যু কি নির্ধারিত ছিল – জ্যোতিষ যে মূলগতভাবে ভ্রান্ত, জ্যোতিষবিশ্বাসীকে একথা কিছুতেই আপনি বিশ্বাস করাতে পারবেন না।
বিপরীতে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরো আলাদা। যত বিখ্যাত বিজ্ঞানী যত জোরের সঙ্গে যে দাবি-ই করুন না কেন, বিপরীত প্রমাণ বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেই আগের ধ্যানধারণা বাতিল হয়ে যেতে বাধ্য। কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা বাতিল হয়ে গেল কোপারনিকাসের তত্ত্ব আসার পর। রাতারাতি বাতিল হয়নি অবশ্য – হয়ত আরেকটু তাড়াতাড়ি হয়ে যেত, যদি না তৎকালীন ধর্মপ্রতিষ্ঠান পুরোনো চালু ধারণার পক্ষে আদাজল খেয়ে নামতেন – কিন্তু হাজার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াসের পরও পৃথিবী-কেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা টিকিয়ে রাখা গেল না, কোপার্নিকাসের তত্ত্বটিই মান্যতা পেল। আবার স্রেফ কোপার্নিকাস বলে গেছেন বলেই সেই মডেল চিরকাল চলল, এমনও তো নয়। কোপার্নিকাস বলেছিলেন, সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে বৃত্তাকার কক্ষপথে। কিন্তু কেপলার বললেন, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘোরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। যখনই কেপলার-এর বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া গেল, কোপার্নিকাসের বৃত্তাকার কক্ষের ধারণা বাতিল হয়ে গেল। অর্থাৎ, কোপার্নিকাস কেপলার থেকে নিউটন আইনস্টাইন অবধি, বিজ্ঞানের তত্ত্ব যিনিই দিন, বিপরীত প্রমাণ পাওয়া গেলে সে তত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে – বা বাতিল হয়ে গিয়েছে। কেউই নতুন পাওয়া প্রমাণের বিপক্ষে গিয়ে আগের তত্ত্বকে ওটা ছিল বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা বা অপপ্রয়োগ, এমন যুক্তি খাড়া করে নিজেকে হাস্যাস্পদ করবেন না – এমনকি, যাঁর তত্ত্ব বাতিল হয়ে যাচ্ছে, সেই বিজ্ঞানীও না। রাদারফোর্ড-এর যে পরমাণু মডেল, তা বিজ্ঞানের নিয়মে মেনে স্থায়ী হতে পারবে না – এই কথা বলে নিলস বোর যে নতুন মডেলের ধারণা দিলেন, স্বয়ং রাদারফোর্ড-ও সেই ব্যাখ্যা অস্বীকার করেননি।
তবে সবসময় কি বিপরীত প্রমাণ মিললেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এককথায় বাতিল হয়ে যায়? না। তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষার ফল কেন মিলছে না, সে কথা যাচাই করে দেখাটাও বিজ্ঞানচর্চার অঙ্গ। শুধু অমুক মন দিয়ে খোঁজেনি বা তমুক উপলব্ধির গভীর স্তরে পৌঁছায়নি, এটুকু বললেই কাজ সারা হয়ে যায় না। যেমন, নিউটন তাঁর মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে গ্রহদের কক্ষপথ বিষয়ে আগাম ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, ইউরেনাস-এর কক্ষপথ সেই হিসেব মানছে না। তাহলে? তবে কি মহাকর্ষ সূত্রটিই ভুল। ব্যাখ্যা খুঁজতে বসলেন বিজ্ঞানীরা। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী অ্যাডামস আর ফরাসি বিজ্ঞানী লেভেরিয়র, দুজন আলাদা আলাদাভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, যে, এমন একখানা গ্রহ রয়েছে, যার অভিকর্ষজ বল ইউরেনাসের কক্ষপথ প্রভাবিত করছে, কক্ষপথের হিসেবে না মেলার কারণ সেটিই। শুধু তা-ই নয়, এঁরা দুজন রীতিমতো আঁক কষে সেই অনাবিষ্কৃত গ্রহের সম্ভাব্য ভর, অবস্থান ইত্যাদির আগাম আন্দাজও দিলেন। নেপচুন আবিষ্কার হয় এর কিছুদিন বাদেই এবং দেখা যায়, অ্যাডামস ও লেভেরিয়র-এর অঙ্কে ভুল ছিল না।
(চলবে)