পূর্ব প্রকাশিতের পর
বিজ্ঞান যদি কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে – বা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাই যদি বিজ্ঞান হয় – তাহলে শুরুর সেই প্রশ্নটির প্রশ্নকর্তা, অর্থাৎ গবেষণার অভিমুখের নির্ধারক ঠিক কে? বিজ্ঞানী স্বয়ং? নাকি অন্য কেউ? এই প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু সরল তো নয়ই নয়, বরং রীতিমতো জটিল।
মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয়ের নির্ধারক দুরকম – সমকালীন সমাজব্যবস্থার চাহিদা এবং বিজ্ঞানীর নিজের আগ্রহে। এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিই প্রাথমিক। বিজ্ঞানীর গবেষণা বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে কীভাবে স্থান পাবে, তা এই প্রথমটির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কিন্তু, দিনরাত এক করে, বাকি সবকিছু তুচ্ছ করে – বিজ্ঞানী তথা বিজ্ঞানসাধক বলতে যে ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে – যেভাবে বিজ্ঞানী গবেষণা চালিয়ে যান, তার কারণ দ্বিতীয়টি।
নিউটনের আগ্রহ যে পুঞ্জীভূত হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানে, তা কোনও কাকতালীয় কারণে নয়। সামগ্রিকভাবে তাঁর সময়ে সেটিই ছিল সর্বাধিক আগ্রহের বিষয়, কেননা সমুদ্রপথে দূরদূরান্ত অবধি পাড়ি দেওয়ার সময় অবস্থান বুঝতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান খুবই কার্যকরী হতো। মাইকেল ফ্যারাডে যখন চৌম্বকত্বের সঙ্গে তড়িৎপ্রবাহকে মেলানোর গবেষণায় ব্রতী হলেন, তার পেছনেও ফ্যারাডে-র ব্যক্তিগত আগ্রহের চাইতে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সে সময় মানুষ শক্তির নতুন নতুন উৎস খুঁজতে চাইছে। ঠিক এ কারণেই, বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আমরা কিছু বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত কৃতিত্বের সমষ্টি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হলেও, কোনও ব্যক্তি বিজ্ঞানী ঠিক সেই সময় অমুক আবিষ্কারটি না করে বসলেও সেই আবিষ্কার, প্রায় নিশ্চিতভাবেই, পরের বছরকয়েকের মধ্যে ঘটে যেত – তথাকথিত জিনিয়াস বিজ্ঞানীর অনুপস্থিতিতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়ত ওই বছরকয়েক পিছিয়ে যেত, তার বেশি নয় – কেননা একই সময়ে অনেক বিজ্ঞানীই নিজের নিজের মতো করে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে চলেছিলেন। যে কারণে, ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়লেই আমরা দেখতে পাব, ফিনিশিং লাইন প্রথম স্পর্শ করেছিলেন যিনি, শেষমেশ তাঁর কথা আমরা মনে রাখলেও একাধিক বিজ্ঞানী কয়েক বছরের মধ্যেই একই উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। যেমন, নিউটন আর লেইবনিৎজ ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন খুব কাছাকাছি সময়ই।
আবার অনেক সময় – বিশেষত বর্তমান যুগে, যখন গবেষণা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠান-নির্ভর – গবেষণার বিষয় নির্ধারিত হয় প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার ও চাহিদা মেনে। যেমন, বর্তমান সময়ে, ডায়াবেটিস-এর ওষুধ খোঁজার জন্য যতখানি শ্রম ও অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার সামান্য ভগ্নাংশই ব্যয় হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধির ওষুধ খোঁজার পেছনে, কেননা, বিশ্বের জনগণের যে অংশ স্বচ্ছল, জনস্বাস্থ্যের উন্নতির সুবাদে তাঁদের সংক্রামক ব্যাধিতে ভোগার সম্ভাবনা কম এবং দ্বিতীয়ত, ডায়াবেটিস জাতীয় অসুখে মানুষকে ওষুধ খেতে হয় অনেকদিন, সুতরাং কোম্পানির ওষুধ বিক্রিও হবে বেশি। আবার বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যান্টিবায়োটিকের গবেষণা অগ্রাধিকার পেয়েছিল, কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সৈন্যের প্রাণ যাচ্ছিল শুধুমাত্র ক্ষতস্থানে সংক্রমণের কারণে।
সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদা এবং ব্যক্তিগত আগ্রহ, এর বাইরেও আরেকটি বিষয় থাকে। পূর্বতন গবেষণা। এ প্রসঙ্গে বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করার চাইতে নিউটনের কথাটি মনে করিয়ে দেওয়াই ভালো – যদি আমি বাকিদের চাইতে বেশিদূর অবধি দেখতে পেয়ে থাকি, তার কারণ, মহান বিজ্ঞানীদের কাঁধে চড়ে দূরের পানে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অর্থাৎ গবেষণা এগোতে পারে আগের বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতেই – আচমকা ভুঁইফোড় জ্ঞান সম্ভব নয়। গ্যালিলিও-র সময় জন্মে বসলেও আইনস্টাইনের পক্ষে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না, কেননা নিউটন তখনও জন্মাননি। সুতরাং, যখন যন্ত্রচালিত বাহন মাটির রাস্তায় চলছে না, তখন দূরে পাড়ি দেওয়ার মতো উড়োজাহাজ তৈরির গবেষণা অসম্ভব। অথবা, যখন ধাতুর পারমাণবিক গঠনই জানা যায়নি, তখন একটি ধাতুকে বদলে সোনা-য় রূপান্তরিত করে ফেলতে পারাটা অস্বাভাবিক। বিভিন্ন সভ্যতায় অতীত গৌরব নিয়ে বিভিন্ন মিথ থাকে – বিজ্ঞানের চোখে, বা বিজ্ঞানের বাস্তবতার নিরিখে সেসব গল্পকথাকে সত্য বলে মানতে পারা মুশকিল।
######
অথচ বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনেকাংশে নৈর্ব্যক্তিক। মানে, অনুসন্ধিৎসার বিষয় যা-ই হোক, পদ্ধতিটা খানিকটা এক। অন্তত গাণিতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কথাটা তো খুবই প্রযোজ্য। কিন্তু সেখানেও ‘শুদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণা’ সম্ভব হয় কি?
স্রেফ নিখুঁতভাবে মেপে ফেলতে পারলেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর সমাধান করে ফেলা সম্ভব, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এমন একটা ধারণা প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। শুধু গাণিতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় নয়, এই ধারণা আক্রান্ত করতে থাকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাপ্রশাখাকেও। বিবর্তনের বিজ্ঞানের সঙ্গে এই পরিমাপযোগ্যতার ধারণাকে মিলিয়ে ভয়াবহ এক বৈষম্যবাদের চর্চা শুরু হয়, যাঁকে অনেকেই বিজ্ঞান বলে বিশ্বাস করতেন (কেউ কেউ এখনও করে থাকেন)।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যাঁরা নিজেদের গবেষণা চালিয়ে যেতেন, তাঁরা সকলেই কি বর্ণবিদ্বেষী বা কূট-উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত বিজ্ঞানী? সম্ভবত না। পল ব্রোকা-র কথা-ই ধরুন। ফরাসি চিকিৎসক। এবং তুখোড় গবেষক-ও। সেসময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু বিজ্ঞানী – অন্তত তৎকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম তো বটেই – মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি, তার কম-বেশি এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন। মোটামুটি ধরেই নেওয়া হয়েছিল, বুদ্ধির আধার যেহেতু মস্তিষ্ক, সেহেতু মস্তিষ্কের মাপ থেকে বুদ্ধির পরিমাপ সম্ভব। পল ব্রোকা অত্যন্ত নিবিষ্টভাবে সেই গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন। ব্রোকা-র নামটি, আর কিছু না হোক, অমর হয়ে থাকবে অন্তত একটি কারণে। মানব-মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশের নামকরণ তাঁর নামেই য়েছে – ব্রোকা’স এরিয়া, অংশটি প্রথম চিহ্নিত করেন তিনি – যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনায় পল ব্রোকা-র ব্রোকা’স এরিয়া চিহ্নিত করার ঘটনাবলী অবান্তর। বরং আমরা দেখব, কী নিবিষ্টভাবে পল ব্রোকা-র মাপের গবেষক মানুষের মাথার মাপজোখ করে চলেছিলেন। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, প্যারিসের নৃতত্ত্ববিজ্ঞান বিষয়ক সংগঠনের সভায় এক তরুণ সভ্য যখন বলেন, যে, মানবমস্তিষ্কের ওজন দিয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষটির বুদ্ধির পরিমাণের আন্দাজ পাওয়া সম্ভবই নয়, পল ব্রোকা রীতিমতো চটে যান। বলেন, তা যদি সম্ভবই না হয়, তাহলে তো আমাদের এত পরিশ্রম, এতদিনের এত গবেষণা, সবই মিছে!
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পল ব্রোকা-র মতো সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞানী পাওয়া মুশকিল। তাঁর মাপজোখ ছিল নিখুঁত, তথ্য-সংরক্ষণের নিষ্ঠা ছিল উদাহরণযোগ্য। যাঁরা মাপজোখের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের অধিকতর বুদ্ধিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন ও সেই লক্ষ্যে মাপজোখে গরমিল করতেন এবং যাঁরা গরমিল করতেন বিপরীত উদ্দেশ্য নিয়ে, অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের মস্তিষ্কের মাপে ভেদাভেদ নেই এমন সাম্য প্রমাণের লক্ষ্যে – দুই পক্ষকেই পল ব্রোকা তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ধর্মীয় লক্ষ্য বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দ্বারা চালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। তাহলে?
পল ব্রোকা-র গবেষণার খামতি ছিল শুধু একটিমাত্র জায়গায়। তাঁর পূর্বসিদ্ধান্তে। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, স্রেফ মস্তিষ্কের আয়তন ও ওজনের ভিত্তিতে মানুষের বুদ্ধির আন্দাজ পাওয়া সম্ভব, এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতিকে উন্নত থেকে অনুন্নত, এমন ক্রমতালিকায় সাজিয়ে ফেলা সম্ভব।
কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন অনিবার্য। তাহলে আমরা কি সবসময় নিশ্চিত হতে পারি, যে, আমাদের এই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে যে বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গবেষণার কাজ করে চলেছেন, তাঁদের কারও কারও গবেষণার কোনও না কোনও ক্ষেত্রে এমনই কোনও পূর্বসিদ্ধান্ত লুকিয়ে নেই!!
#######
বিজ্ঞানীরা কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছান? যুক্তিবিজ্ঞান বা লজিকের কাঠামো এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন ধরুন, বন্ধ ঘরে রাখা গাছ মরে যায় কেন, এই প্রশ্নের উত্তর যদি খুঁজি, তাহলে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যাটা এভাবে সাজিয়ে থাকেন :
সাধারণ নিয়ম – গাছের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যের আলো প্রয়োজন, কেননা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে গাছ তার নিজের খাবার তৈরি করে।
এই বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তথ্য – বন্ধ ঘরে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না।
সিদ্ধান্ত – বন্ধ ঘরে সূর্যালোকের অভাবে সালোকসংশ্লেষ সম্ভব হয়নি বলে গাছটি মরে গেছে।
এভাবেই পল ব্রোকা-র যুক্তিক্রমকে যদি সাজিয়ে দেখি –
সাধারণ নিয়ম – বুদ্ধি বা ইন্টেলিজেন্স বলতে আমরা যা বুঝি, তার আধার মস্তিষ্ক।
এই বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্য – মাথার ঘের ও বিভিন্ন মাপজোখ থেকে মস্তিষ্কের আয়তনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব এবং মেয়েদের মাথার ঘের ছেলেদের তুলনায় কম।
সিদ্ধান্ত – মেয়েদের বুদ্ধি ছেলেদের চাইতে কম। (একইভাবে, কৃষ্ণাঙ্গ বা উপজাতীয় মানুষজনের বুদ্ধি শ্বেতাঙ্গদের চাইতে কম)
মুশকিল হলো, দুটি যুক্তিক্রম একইরকম দেখতে লাগলেও দুটোর মধ্যে ফারাক আছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে – অর্থাৎ পল ব্রোকা-র ক্ষেত্রে – সাধারণ নিয়ম এবং প্রাপ্ত তথ্য দুটিই নির্ভুল হলেও উপনীত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা ভুল, কেননা বুদ্ধির আধার মস্তিষ্ক হলেও এবং ছোট ঘেরের মাথার মধ্যেকার মস্তিষ্কের আয়তন কম হলেও, মস্তিষ্কের আয়তনের অঙ্ক কষার মাধ্যমে বুদ্ধির কমবেশি প্রমাণিত হওয়ার মতো কোনও যোগসূত্র পাওয়া যায় না। পরীক্ষার আগেই ব্রোকা পূর্বসিদ্ধান্ত হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, যে, মস্তিষ্কের আয়তনের সঙ্গে বুদ্ধির কমবেশি হওয়া সরাসরিভাবে যুক্ত – এবং মানুষের বুদ্ধি পরিমাপযোগ্য। এই পূর্বসিদ্ধান্ত ব্রোকা সম্ভবত সচেতনভাবে গ্রহণ করেননি, বরং তৎকালীন সমাজভাবনা অনুসারে এমন সিদ্ধান্ত তেমন অস্বাভাবিক ছিল না। গবেষণার মুহূর্তে অবচেতনে কী কী পূর্বসিদ্ধান্ত সংশয়াতীত ও স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে সচেতন থাকাটা বিজ্ঞানীর দায়িত্ব বইকি!
এখানে, খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই, দুইধরনের লজিক-এর যুক্তির প্রসঙ্গও খানিক বলে রাখা যাক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক।
ডিডাক্টিভ লজিক :
১. ‘ক’-রোগে ভোগা সব মানুষই ‘খ’ ওষুধে সেরে ওঠেন।
২. ‘গ’-বাবু ‘ক’-রোগে ভুগছেন।
সুতরাং, ‘খ’ ওষুধ প্রয়োগ হলেই তিনি সেরে উঠবেন।
বিজ্ঞানের প্রমাণ হিসেবে ডিডাক্টিভ লজিক-ই সর্বাধিক মান্য। কিন্তু, গাণিতিক বিজ্ঞান বাদে বাকি শাখার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা আছে। সসীম/সীমিতসংখ্যক পরীক্ষালব্ধ বা পর্যবেক্ষণযোগ্য তথ্য থেকে কখনোই প্রথম ধরনের পূর্বসিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কেননা এক লক্ষ সাদা রাজহাঁস দেখার পরেও আপনি কখনোই বলতে পারেন না, যে, রাজহাঁস মাত্রেই সাদা, কেননা একটিমাত্র কালো রাজহাঁস আপনার সেই বক্তব্যকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। অতএব, হাজার কি লক্ষ রোগীর ক্ষেত্রে সত্য হলেও, ‘ক’-রোগে ভোগা সব রোগীই ‘খ’ ওষুধ খেয়ে সেরে যান, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা বিভ্রান্তিকর।
ইন্ডাক্টিভ লজিক :
১. ‘ক’-রোগে ভোগা একশজন মানুষ ‘খ’-ওষুধ খেয়ে সেরে উঠেছেন।
২. ‘গ’-বাবু ‘ক’-রোগে ভুগছেন।
সুতরাং, ‘খ’ ওষুধ খেলে ‘গ’-বাবু সেরে উঠবেন।
স্বাভাবিকভাবেই, ডিডাক্টিভ লজিকের তুলনায় এই দ্বিতীয় যুক্তিকাঠামো বেশ খানিকটা নড়বড়ে। কেননা, একশজন সেরে উঠলেও ‘গ’-বাবু সেরে উঠবেনই, এমন নিশ্চয়তা নেই, কেননা সেখানে আরও অনেক ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে (‘গ’-বাবুর শারীরিক অবস্থা, ওষুধ তাঁর পাকস্থলী থেকে রক্তে ঢুকল কিনা ইত্যাদি প্রভৃতি)। বাস্তবক্ষেত্রেও, বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তথ্যের ভিত্তিতে – বিশেষত অপর এক মহাদেশের রোগীদের উপর সফল পরীক্ষার মাধ্যমে লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে – নতুন ওষুধটি আপনার সামনে উপস্থিত একজন রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবসময় কাঙ্ক্ষিত ফল দেবেই, এমন না-ও হতে পারে। কিন্তু ইন্ডাক্টিভ লজিকের যুক্তি বাদে প্রায়োগিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার – যেমন, চিকিৎসাবিজ্ঞান – এগোতে পারা মুশকিল। দৈনন্দিন জীবনেও ইন্ডাকটিভ লজিক বাদে এগোনো মুশকিল। গতকাল বা পরশু সকালে সূর্য উঠেছিল, তার আগের দিনও, স্মরণকালের মধ্যে প্রতিদিনই ওঠে – এর ভিত্তিতে আগামীকাল সকালে সূর্য উঠবেই, এমন বলা যায় না ঠিকই, কিন্তু সেটুকু ভরসা ছাড়া কোনও কাজই যে সম্ভব নয়, সে তো বলাই বাহুল্য।
(চলবে)