সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে মেডিসিনের জগতে সর্বাধিক মান্য এবং গ্রাহ্য দু’টি জার্নাল হল ল্যান্সেট (লন্ডন থেকে প্রকাশিত) এবং নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন (আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস থেকে প্রকাশিত)। দু’টি জার্নালই ২০০ বছর পূর্ণ করেছে। এরা দুজনেই আত্মসমীক্ষা শুরু করেছে। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত হচ্ছে কিভাবে এর জন্মের লগ্নে ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদের সপক্ষে বিভিন্ন সময়ে সওয়াল করেছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর একেবারে সাম্প্রতিক সংখ্যায় দাসব্যবস্থার পক্ষে কিভাবে জার্নালে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হয়েছে। অতি সচেতনভাবে আত্মধিক্কার থেকে জার্নাল দু’টি নিজেদের অতীতকে উদ্ঘাটিত করতে চাইছে মানুষের কাছে অকপটে অতীতের ভুলগুলোকে খোলামেলা তুলে ধরার জন্য। আমিও আমাদের পরিবেশ ভাবনা এবং “স্বাস্থ্যের নাগরিকত্ব” নিয়ে ইতিহাস খুঁড়ে কিছু ভিন্ন ভাবনা রাখার চেষ্টা করছি।
১২ ডিসেম্বর, ১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন, মতামত চান। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকনমিস্ট নোটটি প্রকাশ করে “লেট দেম ইট পলিউশন” শিরোনামে।
নোটটির মোদ্দা কথা ছিল ধনী বিশ্বের পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখবার জন্য ওখানে শিল্পজাত সমস্ত প্রাণঘাতী, দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা তথা কম উন্নত দেশগুলোতে পাচার করতে হবে। এজন্য একটি স্বাস্থ্যের যুক্তিও দিয়েছিলেন সামার্স। তাঁর বক্তব্য ছিল আমেরিকার মতো দেশে ১,০০,০০০ জনে ১ জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের জন্য প্রোস্টেট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলেও আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে যেখানে ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার ১০০০-এ ২০০জন আমেরিকার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে পাচার করতে হবে এই বিষাক্ত বর্জ্য। এরকম কাজের পুরস্কার হিসেবে ক্লিন্টন প্রশাসনে ৭ বছর ইউএস ট্রেজারি সেক্রেটারি পদে ছিলেন। সে মেয়াদ শেষ হলে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
আমরা যদি স্বাস্থ্যের চোখ দিয়ে দেখি তাহলে বুঝবো স্বাস্থ্যের জগতে দু’ধরনের নাগরিকত্ব বা হেলথ সিটিজেনশিপ (আবার অন্যদিক থেকে দেখলে পরিবেশগত বা এনভায়রনমেন্টাল নাগরিকত্বও বটে) তৈরি হল। একটি পূর্ণ রাশি, আরেকটি ০ রাশি। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও এরকম ইনটেজার-এ দেখা হয় – হয় ০, কিংবা ১। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। যেমনটা আজকের ভারতে এবং বিশ্বে দেখছি আমরা। যারা ভগ্নাংশ কিংবা নেতিবাচক ইনটেজার হিসেবে নির্ধারিত হয় তাদের জন্য রাষ্ট্রের নির্মাণ করা ভাষ্যে স্বাস্থ্য, পরিবেশ কিংবা রাষ্ট্রিক নাগরিকত্বের প্রশ্নটিতে কোন পরিসর বরাদ্দ থাকেনা। যেমন এখানকার তথা বিশ্বের জনজাতি কিংবা প্রান্তবাসী মানুষ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্যে এবং পরিবেশের দুনিয়ায় একজন নাগরিক নৈতিকভাবে স্বাস্থ্যের বা পরিবেশের সমস্ত সুবিধে ভোগ করার অধিকারী, রাষ্ট্রের সমস্ত রাজনৈতিক ঘোষণা এবং শ্লোগানের বাইরে অবস্থান করেও। কারণ এগুলো প্রাকৃতিক অধিকার বা ন্যাচারাল রাইটসের মধ্যে পড়ে। লরেন্স সামার্সের চিঠি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শক্তিশালী দেশগুলো এবং কর্পোরেটদের কার্যক্রমের মাঝে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জগতেও নাগরিকত্বের এই দ্বিত্বতা যথেষ্ট প্রকটভাবে রয়েছে।
এবার অন্য আরেকটি প্রসঙ্গে আসি। কথিত যে, ১৮৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রেড ইন্ডিয়ানদের সাস্কোয়ামিশ উপজাতির প্রধান চিফ সিয়াটল আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট আমাদের জানিয়েছেন যে, তিনি আমাদের জমি কিনতে চান। কিন্তু জমি বা আকাশকে কিভাবে কেনা বা বেচা যায়? এটা আমাদের কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। এই পৃথ্বীর প্রতিটি অংশ, কণা আমাদের কাছে পবিত্র। এগুলো সব আমাদের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতায় ঈশ্বরপূত। নদীরা আমাদের ভ্রাতা, আমাদের তেষ্টা মেটায়। আমাদের কাছে কেবলমাত্র জল নয়, আমাদের পিতৃপুরুষের প্রবাহিত শোণিত। আমরা সমস্ত কিছু তোমাদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা এদেরকে ভালোবেসে রক্ষা করতে পারবে তো? মানুষের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে তো?” কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী লোভের যুগে কিছুই বাঁচেনি। পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনের অরণ্যকে খনিজ সম্পদের লোভে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিসেম্বরের ৬, ২০১৯, তারিখে নেচার-এর মতো পত্রিকায় বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “ল্যান্ডস্কেপ অফ ফিয়ার ফোর্সেস ব্রাজিলিয়ান রেইনফরেস্ট রিসার্চার্স ইনটু অ্যাননিমিটি” – কর্পোরেট দস্যুদের আতঙ্কে গবেষকরা নিজেদের নামে প্রবন্ধ ছাপতে ভয় পাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, ১৮২০-৩০-এর দশক থেকেই বিশেষত ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকায় অতি ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরাশক্তির জরাজীর্ণ অবস্থা জমিতে সার প্রয়োগের চাহিদা বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুললো। ১৮২৩ সালে ইংল্যান্ডে হাড়ের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪,৪০০ পাউন্ডের। ১৮৩৭ সালে সেটা বেড়ে হল ২৪,৬০০ পাউন্ড (£)। একইসঙ্গে বিভিন্ন পাখির নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ মলের (guano) চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। ১৮৪১ সালে লিভারপুল বন্দরে ১,৭০০ টন গুয়ানো আমদানি করা হয়েছিল, ১৮৪৭-এ ২২০,০০০ টন। শুধু গুয়ানোর সরবরাহ অবাধ রাখার জন্য আমেরিকা ১৮৫৬ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে শিল্পপতিদের চাপে Guano Island Act পাশ করিয়ে ফেললো। ১৮৫৬ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ৯৪টি দ্বীপখণ্ড এবং পাহাড় দখল করে নিল। যদিও সরকারিভাবে ৬৬টির কথা স্বীকার করা হল। ২০২২ সালেও আমেরিকার দখলে থাকা এরকম দ্বীপের সংখ্যা ৯টি। (Hungry for Profit: The Agrobusiness Threat to Farmers, Food, and The Environment, ed. Fred Magdoff, John Bellamy Foster and Frederick H. Buttel, 2000, পৃঃ ৪৪)
শুধু গুয়ানোর সরবরাহ অবাধ রাখার জন্য আমেরিকা ১৮৫৬ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে শিল্পপতিদের চাপে Guano Island Act পাশ করিয়ে ফেললো। ১৮৫৬ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ৯৪টি দ্বীপখণ্ড এবং পাহাড় দখল করে নিল। যদিও সরকারিভাবে ৬৬টির কথা স্বীকার করা হল। ২০২২ সালেও আমেরিকার দখলে থাকা এরকম দ্বীপের সংখ্যা ৯টি। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫)
আমরা যদি সময়কাল খেয়াল করি তাহলে দেখব, যে সময়ে চিফ সিয়াটল চিঠি লিখছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সেরকম সময় দিয়ে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। পূর্বোদ্ধৃত দীর্ঘ চিঠিতে এরকম ইঙ্গিতই বারংবার করেছেন রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি। তাঁদের কয়েক শতাব্দি-সিঞ্চিত অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন জমির সাথে জমির দখলদারদের এক চিরকালীন বিচ্ছেদ জন্ম নিচ্ছে। পূর্বোক্ত পুস্তকে মন্তব্য করা হচ্ছে – “The decline in natural soil fertility due to the disruption of the soil nutrient cycle accompanying capitalist agriculture, the growing knowledge of the need for specific soil nutrients, and limitations in the supply of both natural and synthetic fertilizers that would compensate for the loss of natural fertility, all contributed, therefore, to a widespread sense of a crisis in soil fertility.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫)
মানুষ এবং ভূমির মধ্যে এরকম চিরকালীন বিচ্ছেদকে মার্ক্স অভিহিত করেছেন “metabolic rift” বলে – “irreparable rift in the interdependent process of social metabolism”। বেলামি ফস্টার মন্তব্য করছেন – “To insist that large-scale capitalist society created such a metabolic rift between human beings and the soil was to argue that the nature-imposed conditions of sustainability had been violated. “Capitalist production,” Marx observed, “turns towards the land only after its influence has exhausted it and after it has devastated its natural qualities.” (John Bellamy Foster, Marx’s Ecology: Materialism and Nature, 2000, পৃঃ ১৬৩)
১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হল মার্ক্সের চিরকালের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ও কমরেড ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের ডায়ালেকটিকস অফ নেচার । বইটি অসম্পূর্ণ চেহারায় ছিল। প্রকৃতির সাথে মানুষের ডায়ালেকটিকাল সম্পর্ক নিয়ে এ পুস্তকে তিনি মৌলিকভাবে আলোচনা করেন। এ পুস্তকে তিনি বলছেন – “যখন আল্পস পর্বতের ইতালীয়রা দক্ষিণের ঢালের পাইন বনকে সম্পূর্ণত ব্যবহার করে নিঃশেষ করে ফেলল, এবং পরে উত্তরের ঢালেও, তখন তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা যে একাজ করার ফলে তারা তাদের অঞ্চলের ডেয়ারি শিল্পের গোড়া ধরে কেটে ফেলছে। আরও কম ধারণা ছিল যে এরফলে প্রায় সারা বছর ধরে প্রবাহিত পাহাড়ি ঝর্ণার জলধারা শুকিয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এদের অনুমানেও ছিলনা এর ফলশ্রুতিতে বর্ষার সময় সমতল অঞ্চলে ভয়ংকর জলের প্লাবন নেমে আসবে।” (Dialectics of Nature, Progress Publishers, Moscow, ১৯৮৬, পৃঃ ১৮০)
এঙ্গেলস আরও বলেন – “এভাবে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিদেশী মানুষদের ওপরে আমরা যেভাবে বিজয়ীর কর্তৃত্ব কায়েম করি সেভাবে প্রকৃতির ওপরে শাসন চালাতে পারিনা – যেন কেউ একজন প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রভুত্ব চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের মাংস, রক্ত এবং মস্তিষ্ক নিয়ে প্রকৃতির এক অংশ হিসেবে অস্তিত্ব ধারণ করি। এবং প্রকৃতির ওপরে আমাদের সমস্ত প্রভুত্বের ভিত্তিতে রয়েছে এই বাস্তবতা যে অন্য সব প্রাণীর তুলনায় আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান হল আমরা প্রকৃতির নিয়মকানুনকে আমরা শিখে নিতে পারি আর সঠিভাবে সেগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮০)
২০১৩ সালে এবোলা মহামারি হবার পরে “Did Ebola Emerge in West Africa by a Policy-Driven Phase Change in Agroecology? Ebola’s Social Context” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় (Environment and Planning A 2014, volume 46, pages 2533 – 2542)। এখানে দেখানো হয়েছে ব্রিটিশ পরিচালিত নেভাদার কোম্পানি “ফার্ম ল্যান্ড অফ গিনি লিমিটেড” ৯,০০০ হেক্টর জমি গিনিতে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয় – ভুট্টা এবং সয়াবিন চাষের জন্য। এরপরে সে জমিতে palm oil উৎপাদন শুরু হয়। এরপরে প্রবেশ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানি।
পাম তেল বেশ কিছুদিন অতি লাভজনক আন্তর্জাতিক ব্যবসা। দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিরা দুভাবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে – (১) সরাসরি বিভিন্ন দেশের ওপরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক চাপ সৃষ্টি করে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এর ফলন ঘটায়, কিংবা (২) দরিদ্র বা মধ্য কৃষকদের নগদ মুনাফার লোভ দেখিয়ে জমিতে চাষের ধরণ রূপান্তরিত কর। যেভাবেই করুক, শেষ অব্দি বহুজাতিকের বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়। অন্যদিকে কৃষির চরিত্র বদলে যায়। কৃষকের সামাজিক মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটে।
২০১৪ সালে কয়েকজন গবেষক EcoHealth জার্নালে (২৩.০৫.২০১৪) এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন “Anthropogenic Land Use Change and Infectious Diseases: A Review of the Evidence” শিরোনামে। এ গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে – “জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে সে পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে রোগের dynamics-কে প্রত্যক্ষত বা অপ্রত্যক্ষত বদলে দেবার। জমির প্রসারণের ফলে বেশি করে অণুজীবেরা মানুষের বসবাসের অঞ্চলে প্রবেশ করবে। জমি ব্যবহারের পরিবর্তনের ফলে জনসমষ্টির বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটছে, চরিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে, ইমিউনিটির প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক সংযোগের অর্থাৎ রোগের বাহক ভেক্টর এবং মানুষের এবং রোগের ধারকদের ধরন বদলে যাচ্ছে।”
খুব সহজ প্রশ্ন উঠবে – জমির ব্যবহারে পরিবর্তন (ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জ) কারা করলো? কি উদ্দেশ্যে? যে উদ্দেশ্যে (খনিজ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্পদের জন্য) ব্রাজিলের রেন ফরেস্টের ২৫% পুড়িয়ে দেওয়া হয় সে উদ্দেশ্যে? শিল্প বিপ্লব পরবর্তীতে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, এবং ক্রমাগত নিওলিবারাল অর্থনীতির প্রায়-একমাত্র হয়ে ওঠার পরে, প্রকৃতির উপরে প্রভুত্ব এবং পুঁজির প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষময় ফল আমরা ভোগ করছি।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত (এপ্রিল ২, ২০২০) প্রবন্ধে (“Escaping Pandora’s Box – Another Novel Coronavirus”) বলা হচ্ছে – “আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে যে ৭.৮ বিলিয়ন (৭৮০ কোটি) মানুষের থিকথিকে ভিড়ে ভরা পৃথিবীতে বিভিন্ন ঘটনার একসাথে ঘটা – যেমন, মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন, পরিবেশের পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্যের অপ্রতুল মেকানিজম – বিভিন্ন অস্পষ্টভাবে লুকিয়ে থাকা প্রাণী জগতের ভাইরাসকে মানুষের দুর্দৈব করে তুলেছে।” মানুষের চরিত্রের পরিবর্তনের মাঝে মুনাফার উদগ্র আকাঙ্খা এবং আধিপত্যের দুর্মর বাসনাও অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০১৯ সালে (১১ জুন, ২০১৯) নেচার-এ প্রকাশিত রিভিউ আর্টিকলের শিরোনাম ছিল “Emerging human infectious diseases and the links to global food production”। এখানে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনুমিত ১১০০ কোটি মানুষের জন্য জুনোটিক রোগ কি কাণ্ড ঘটাতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক বার্তা রয়েছে।
Mark Hamilton Lytle তাঁর The Gentle Subversive (2007) পুস্তকে র্যাচেল কারসনের দুনিয়া কাঁপানো বই সাইলেন্ট স্প্রিং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “কারসন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্টদের নজর পরিবেশের দিকে যাতে নিবদ্ধ হয় সে কাজে সাহায্য করেছিলেন। র্যাচেলের পেস্টিসাইডের ওপর আক্রমণের মধ্যে এই অ্যাক্টিভিস্টরা আরও বেশি করে খুঁজে পেয়েছিল কর্পোরেট ক্যাপিটালিজমের বিভিন্ন শয়তানি। লাভের জন্য উদগ্র বাসনা, তাদের অভিমত অনুযায়ী, কোন জনহিতকর কাজ নয়, বরঞ্চ কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করেছিল আরও বেশি বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করতে, যা পৃথিবীর অধিকতর ক্ষতিসাধন করবে। তাদের বিজ্ঞাপনের কুহক জালে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কি মূল্য চোকাতে হচ্ছে সেটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই বিদ্রোহীরা কারসনের বিশ্বাসকে প্রসারিত করেছে – “জনগণের” অধিকার আছে সেসমস্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার যেগুলো জীবনের জন্য ক্ষতিকর।” (পৃঃ ২০৭)
র্যাচেল কারসন তাঁর সাইলেন্ট স্প্রিং (১৯৬২, ২০০২) গ্রন্থে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন কেঁচোর কথা – ডারউইনের The Formation of Vegetable Mould, through the Action of Worms, with Observations on Their Habits-কে উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, কেঁচোরা জমির স্তর ইঞ্চি ইঞ্চি করে বাড়িয়ে তোলে এবং জমির উর্বরা শক্তিকে রক্ষা করে। কোথায় গেল কেঁচোরা? অনেকটা “Where have all the flowers gone”-এর মতো।
নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ “How Humanity Unleashed a Flood of New Diseases” (Ferris Jabr, জুন ২৫, ২০২০) অনুযায়ী, মানুষের শরীরের ৬০ থেকে ৭৫% রোগ আসে প্রাণী জগত থেকে। লেখক বলেছেন – “যে সমস্ত অণুজীবেরা আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করে (Zoonotic pathogens) তারা আমাদের খুঁজে খুঁজে বের করেনা কিংবা কাকতালীয় ভাবে আমাদের ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়েনা। যখন প্রাণীদের থেকে মানুষে রোগের প্রবেশ ঘটে কিংবা উল্টোটা হয়, এর কারণ সাধারণত আমরা আমাদের ‘shared ecosystem’-কে নতুন করে গড়ে নিয়েছি এমন এক ভাবে যে পারস্পরিক স্থানান্তর (transition) অনেক বেশি সম্ভাব্য করে তোলে। অরণ্য নিধন, খনি খনন করা, নিবিড় চাষ এবং শহরের লাগামহীন ভাবে বিস্তার ঘটা এদের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস করে দেয়। বনের জীবদের বাধ্য করে মানুষের সমাজে ঢুকে পড়তে।”
কৃষি এবং পশু ফার্মিং-এর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নিদর্শন ধরা আছে ইয়ুভাল হারারির স্যাপিয়েনস পুস্তকে – “দুগ্ধখামারগুলোতে একটু অন্যরকম উপায়ে পশুদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাভী, ছাগী কিংবা ভেড়ী শুধুমাত্র বাছুর বা বাচ্চা জন্মের পরেই দুধ উৎপাদন করে, তাও ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ তাদের সন্তানদের সেটা দরকার হয়। এখন, খামারে দুধের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য যেটা করা হয় সেটা হল সেইসব বাছুর, ছাগলের বাচ্চা কিংবা ভেড়ার বাচ্চাদের জন্মের পরেই হত্যা করা হয়। আর তারপর যতদিন সম্ভব ততদিন ধরে মায়েদের দুধ দোয়ানো হয়। তারপর আবার তাদের অন্তঃসত্ত্বা বানানো হয়। এটা এখনও খুবই প্রচলিত একটা পন্থা। এখনকার অনেক দুগ্ধখামারে একটা দুধ দেয়া গাভীকে হত্যা করার আগে মোটামুটি বছর পাঁচেক বাঁচে। এই পাঁচ বছর সময়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই সে অন্তঃসত্ত্বা থাকে। তাকে প্রতি ৬০ কি ১২০ দিন পর পর নিষিক্ত করা হয় যাতে সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। তার সন্তানকে জন্মের পরপরই তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। গাভীগুলোকে লালন পালন করা হয় পরের প্রজন্মের দুধ উৎপাদনকারী হিসেবে আর ষাঁড়গুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাংসের খামারে।” (অনুঃ মোস্তাক আহমেদ, শুভ্র সরকার, সুফিয়ান লতিফ এবং রাগিব হাসান, বাংলাদেশ, পৃঃ ৯০)
এরপরে আর নতুন করে কি বলার থাকতে পারে? সমস্যাকে আদ্যোপান্ত হৃদয়ঙ্গম করা, গভীরে ভাবা এবং সামাজিক সংলাপ শুরু করা ছাড়া আর বিশেষ কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয়না। পরবর্তী প্রজন্মের যদি হৃদয় এবং বৌদ্ধিক জগত সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হয়ে কেবলমাত্র প্রকৃতিগ্রাসী কোন প্রাণীর মতো না হয় তাহলে তারা আমাদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাবে – আমরা অন্তত ৩০০ বছর ধরে চলা এই অপরাধগুলোর প্রজন্মগত সাক্ষী ও নীরব মদতদাতা।
আরণ্যক উপন্যাসের গোড়াতেই বিভূতিভূষণ জানিয়েছিলেন – “স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনও ক্ষমা করিবেন না জানি। নিজের অপরাধের কথা নিজের মুখে বলিলে অপরাধের ভার শুনিয়াছি লঘু হইয়া যায়। তাই এই কাহিনীর অবতারণা।” এরকম এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমাদের বিশেষ করে ভাবা দরকার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের নাগরিকত্ব নিয়ে। বুঝতে হবে, ইনটেজার-ই রাষ্ট্রিক নাগরকিত্বের একমাত্র পরিচয় কিনা।
এরপরে বিচারের ভার যুক্তি-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাতে। সমাজকর্মীদের হাতে – এমনকি চিকিৎসকদের হাতেও।
The article throws light on exactly the issues we need to know…future will be bleak faster than we can imagine if course correction is not done. Thanks and regards to Dr Jayanta Bhattacharya!
মানুষের দুর্দম লোভের কারনে এই পৃথিবী কত দিন মানুষের বাসযোগ্য থাকবে?
প্রকৃতির ভারসাম্য বিনাশ প্রাথমিক ও পরবর্তীতে সাধারণ পরে উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ১৭০০ সালের পর থেকে তথাকথিত উন্নত ও সভ্য দেশগুলিই করেছে এবং করে যাচ্ছে। আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় পুরনো জনজাতি প্রায় নিশ্চিহ্ণ করা হয়েছে, আমাদের নীলচাষ করতে হয়েছে, জঙ্গল ও প্রাণীদের বিলোপ করে বসত বানানো হয়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর তত্ত্বে পশুপালিত জন্তুদের হত্যা করা হচ্ছে। আফ্রিকাকে ডাস্টবিন বানানো হয়েছে, সক্ষম মানুষদের দাস বানানো হয়েছে আগেই।
একেই কি বলে সভ্যতা!
অসাধারণ লিখেছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। আমার নমস্কার।
অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ লেখনীর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এখনও আমরা উদাসীন… ভয়ঙ্কর পরিনতির আর বেশি দেরী নেই।