স্টেরয়েড মলমের অযৌক্তিক অপব্যবহার ডেকে এনেছে এক ভয়াবহ মহামারী, লিখছেন ডাঃ কৌশিক লাহিড়ী
ধরুন কারো জ্বর হলো, সেটা টাইফয়েড হতে পারে, ম্যালেরিয়া হতে পারে, টিবি অথবা ব্লাড ক্যান্সার, ডেঙ্গু অথবা চিকুনগুনিয়া অনেক কিছু থেকেই হতে পারে তাই তো ?
এখন সেক্ষেত্রে ডাক্তার না দেখিয়ে, জ্বরের সঠিক কারণ না জেনে কেউ যদি একটু ম্যালেরিয়ার ওষুধ, একটু টাইফয়েডের ওষুধ, একটু টিবির ওষুধ, একটু ব্লাড ক্যান্সারের ওষুধ মিশিয়ে খায় এবং খেয়ে চলে কেমন হবে ? তাতে রোগ সারবে কি ? না বেড়ে যাবে ?
সঠিক রোগ নির্ণয় না করে ঐসব প্যান্ডার্ম, ফোর্ডার্ম মার্কা ওষুধ লাগানো ব্যাপারটা ওইরকমই !
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এই অবৈজ্ঞানিক ককটেল ওষুধ গুলিতে আবার স্টেরয়েড থাকে !
না জেনে , দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড (বিশেষত মুখে এবং শরীরের চাপা অংশে) অপরিমিত এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করলে বিপদ হতেই পারে !
এ হলো খাল কেটে কুমীর আনার মতো অবিবেচকের কাজ!
বোকামি !
স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার আমাদের দেশে প্রধানত তিনভাবে হয়
১. দাদের মলম হিসেবে- যেমন কোয়াড্রিডার্ম, ফোর্ডার্ম, প্যান্ডার্ম, টোটালডার্ম, ক্যান্ডিডার্মা, ক্যান্ডিড টোট্যাল, সার্ফাজ এস যেন, বেটনোভেট জি এম, লোবেট জি এম জাতীয় দানবীয় গজকচ্ছপ গোছের ওষুধ
এই সমস্ত ককটেল ক্রিম ভারতবর্ষ ছাড়া কোথাও মেলে না !
দাদের মহামারী দেখা দিয়েছে এই গুলি মেখে !
সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে দুরারোগ্য দাদ ! স্কিন ফেটে গিয়ে স্ট্রেচ মার্কের শাখা প্রশাখা ছড়াচ্ছে শরীরে !
2. ফর্সা হবার ক্রিম হিসেবে -যেমন মেলাকেয়ার, স্কিনলাইট, স্কীনশাইন, নোস্কার এগুলির মধ্যে থাকে শক্তিশালী স্টেরয়েড, হাইড্রোকুইনোন নামে একটি ব্লিচ আর ট্রেটিনয়েন নামে একটি ওষুধ.
3. এছাড়া প্যান্ডারম প্লাস কোস্ভেট জিএম, লোবেট জিএম, বেটনোভেট জিএম, নুফোর্স জি এম এগুলিও অনেকে মুখে মাখেন ফর্সা হবার উদগ্র ইচ্ছায় ! এই গুলি আসলে একটি এন্টিবায়োটিক, একটি এন্টিফাঙ্গাল এবং অত্যন্ত শক্তিশালী একটি স্টেরয়েডের ভয়ঙ্কর ককটেল !
এগুলি প্রাথমিক ভাবে দাদের মলম হিসেবেই তৈরী হয়েছিল, কিন্তু অপব্যবহার হচ্ছে লি বা অন্য স্টেরয়েড না জেনে মুখে বা অন্যত্র মাত্রাছাড়া ভাবে মাখলে স্কিন পাতলা হয়ে যায়, লাল হয়ে , রক্তনালী দেখা যায়, ব্রণ বেরোয়, মেয়েদের মুখে অবাঞ্ছিত লোম বের হয়!
স্টেরয়েড এডিকশন বা নেশার শিকার হয় মানুষটি !
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা খুব জরুরি ।
স্টেরয়েড মানেই কিন্তু খারাপ নয় !
এটি অন্তত প্রয়োজনীয় একটি ওষুধ যা শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শেই ব্যবহার করা যায় ।
স্বচিকিৎসা কখনোই নয়!
এই স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার আমাদের দেশের লজ্জা !
অভিশাপ !
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যে তাবিজ বশীকরণ কবচ, স্বপ্নাদিষ্ট লকেট, গ্রহের প্রতিকারের গ্যারান্টিযুক্ত নবগ্রহ আংটি বা মদিনার-মাটি-মাখা-মাদুলি আর সর্বরোগহর মালিশ বা ক্যাপসুল, ডায়াবেটিস থেকে ক্যান্সার সারিয়ে দেওয়ার গোপন-গবেষণা লব্ধ অব্যর্থ ওষুধ
বা টাকে চুল গজানোর আর তিন দিনে ফরসা করার আশ্চর্য মলমের বিজ্ঞাপনী দামামা;
আর টিভি র পরদায়, ইন্টারনেট-ইউটিউবের জালে বেদ, বাইবেল বা কুরানের
ঠিকাদার স্বঘোষিত বাবাজী, মাতাজী, মৌলভি, রেভারেন্ড, আর জ্যোতিষ-আচার্যদের অলীক কুনাট্য সেগুলি শুধু অনৈতিক নয় সরাসরি বেআইনি !
ভ্রুণের লিঙ্গনির্ধারণ যে কারণে নিষিদ্ধ ঠিক একই কারণে ইচ্ছে মত পুত্র সন্তান উৎপাদনের বিজ্ঞানবিরোধী, ক্ষতিকারক বিজ্ঞাপন প্রকাশও সার্বিক ভাবে বর্জনীয় !
বেঁটে থেকে লম্বা বা কালো থেকে ফর্সা করার ওষুধের বিজ্ঞাপন সরাসরি Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act, 1954 এর পরিপন্থী।
কিন্তু প্রতিদিন প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে, টিভিতে, ইউটিউবে আমরা দেখতে পাচ্ছি ফর্সা হবার ক্রিমের বিজ্ঞাপন !
প্রেসক্রিপশন লাগে এমন কোনো ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না ! তবুও রমরমিয়ে চলছে দাদের মলমের চটকদার বিজ্ঞাপন !
মর্গ্যান স্ট্যানলির হিসেব মতো ভারতে প্রতি একশজন ক্রিম/মলমের ক্রেতার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষ কেনেন ফর্সা হবার ক্রিম হিসেবেই !
ফল হয়েছে ভয়ঙ্কর !
১.শক্তিশালী স্টেরয়েড মেশা ক্রিম অকারণে মুখে মেখে পাতলা হয়ে যাচ্ছে ত্বক, হয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত সূর্য-সংবেদী, বেরোচ্ছে ব্রণ, অবাঞ্ছিত লোম, সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে ত্বকের !
আবির্ভুত হয়েছে টপিক্যাল স্টেরয়েড ড্যামেজড ফেস(TSDF) নামে এক নতুন লজ্জাজনক অসুখ !
২.আর স্টেরয়েড মেশানো তথাকথিত দাদের মলমের যথেচ্ছ ব্যবহারে ধ্বসে যাচ্ছে ত্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতা, বদলে যাচ্ছে ছত্রাকের চরিত্র, বহুগুণিত হচ্ছে তার আগ্রাসী প্রভাব, কাজ করছে না ছত্রাক বিরোধী ওষুধ !
দাদ আজ দুরারোগ্য, দানবীয় ! যে কোনো হাসপাতালে চর্মরোগ বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে শতকরা পঁচিশজনই দাদের রোগী !
এই অভূতপূর্ব ছত্রাক মহামারীর আসল কারণ কিন্তু ওই স্টেরয়েডের যথেচ্ছ অপব্যবহার !
আসুন সবাই সচেতন হই !
সবাই সচেতন হলে এই সব স্টেরয়েড ককটেলের দুহাজার কোটি টাকার অপসাম্রাজ্য টা এবার ধ্বসে যাবে !
২০০৬ থেকে লড়ছি, আরো লড়বো, এই অভিশাপের শেষ দেখে ছাড়বো !
বা! সুনির্দিষ্ট।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর আলোকপাত । জরুরী লেখা ।
খুব ভালো লাগলো
ভালো এবং জরুরী লেখা।
অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতি।