আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে অসংখ্য স্নায়ু কোষের সমন্বয়ে। এই স্নায়ু কোষগুলির মধ্যে এক বিশেষ ধরনের বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হয় যার আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে কোষগুলি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং মস্তিস্ক শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
স্নায়ু কোষগুলির মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত ঠিকমত তৈরি না হওয়ার ফলে যোগাযোগ স্থাপনের পদ্ধতি ব্যাহত হলে খিঁচুনি (সিজার)দেখা দেয়। আর মৃগী (এপিলেপসি) রোগের লক্ষণ হল বার বার খিঁচুনি হওয়া।
পরিসংখ্যান
পরিসংখ্যান বলছে প্রায় প্রতি একশ জন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত।সাধারণ ভাবে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরাই এই রোগে বেশী আক্রান্ত হন।
মৃগী রোগের কারণ
অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের সরাসরি কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত কারণ দায়ী থাকে। শিশু জন্মানোর সময় ও মায়ের পেটে থাকাকালীন শিশুর মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন যাওয়া বা অন্য কোন কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতি বা মস্তিষ্কে আঘাত ইত্যাদি থেকেও এই সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে আবার মস্তিস্কের আঘাত, রক্তপাত, টিউমার, মস্তিষ্কের সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়।
যে সমস্ত শিশুর বুদ্ধি কম বা যাদের অটিজমের সমস্যা আছে তাদের মধ্যে খিঁচুনির সমস্যা বেশি দেখা যায়।
মৃগী রোগের লক্ষণ
মৃগী রোগের মূল লক্ষণ হল খিঁচুনি। খিঁচুনি যেমন শরীরের কোন একটি স্থান জুড়ে হতে পারে, একজায়গায় শুরু হয়ে শরীরের অন্য জায়গায় ছাড়িয়ে যেতে পারে, তেমনি প্রথম থেকেই সারা দেহ জুড়েও হতে পারে। অনেক সময় খিঁচুনির সাথে সাথে চেতনাও লোপ পায়। অনেকের ক্ষেত্রে খিঁচুনি শুরুর কিছুক্ষন আগে থেকে কিছু অস্বাভাবিক অনুভূতি দেখা যায় যেমন কেউ কেউ খিঁচুনি শুরুর আগে নাকে পোড়া টায়ারের গন্ধ পান। খিঁচুনি হবার সময় অনেকের জিভ কেটে যেতে পারে, মাটিতে পড়ে চোট লাগতে পারে, প্রস্রাব হয়ে যেতে পারে। অনেকের আবার খিঁচুনি শেষ হবার কিছুক্ষণ পর অব্দি স্মৃতি লোপ পায় বা আচার- ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়।
রোগ নির্ণয়
মৃগী রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা -নিরীক্ষা আছে। “ই ই জি” পরীক্ষাতে স্নায়ুকোষগুলির থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত ঠিকমত আসছে কিনা তা বোঝা যায়। এছাড়া সিটি স্ক্যান ও এম আর আই পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের গঠনগত ত্রুটি, রক্তপাত, টিউমার, সংক্রমণ ইত্যাদি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়।
মৃগীর চিকিৎসা
দেখা গেছে ঠিকমত চিকিৎসায় থাকলে সত্তর শতাংশ মৃগী রোগীই অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মত জীবন যাপন করতে পারেন।
মৃগী রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলিকে এন্টি এপিলেপ্টিক ড্রাগ বলা হয়। এই জাতীয় কয়েকটি ওষুধের নাম হল-ফেনিটোয়েন, ভ্যালপ্রয়িক এসিড, কার্বামাজেপিন, লামোট্রিজিন, লেভেটাইরাসেটাম ইত্যাদি। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না হলে অপারেশনের দরকার পড়ে।
খিঁচুনি হবার সময় রোগীকে একপাশে কাত করে শুইয়ে দেওয়া উচিত, গলার, দাঁতের ফাঁকে চামচ বা ওই জাতীয় জিনিস ঢোকানো উচিত নয়, নাকে জুতোর গন্ধ ইত্যাদি দেওয়া উচিত না। খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি চললে অথবা বার বার হতে থাকলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।
সাধারণভাবে যেটাকে খিঁচুনি মনে হয় সেটা দুরকম হতে পারে-আসল খিঁচুনি আর মানসিক চাপের কারণে হওয়া খিঁচুনি। খিঁচুনির ধরন দেখে (যেমন খিঁচুনি কতক্ষণ ধরে, কোন কোন জায়গা জুড়ে হচ্ছে, খিঁচুনির সময় জিভ কেটে গিয়েছে কিনা বা অসাড়ে প্রস্বাব হয়ে যায় কিনা?) এবং কিছু পরীক্ষা করে (যেমন ই ই জি, সিটি স্ক্যান) পার্থক্য করা হয়। হিস্টিরিয়া বলতে সাধারণভাবে নকল খিঁচুনিকেই বোঝানো হয়। নানান ধরনের মানসিক চাপ থেকে এই জাতীয় নকল খিঁচুনি হতে পারে। সেক্ষেত্রে সেইসব মানসিক সমস্যাগুলিকে খুঁজে বার করা এবং চিকিৎসার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য দরকার হতে পারে।
মৃগী কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। ভূত প্রেতের প্রভাব থেকেও এই রোগ হয় না। উপযুক্ত চিকিৎসায় থাকলে এই রোগে আক্রান্তরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।