তারস্বরে ফোন বাজছে ভোরবেলা। আধঘুমে তাকিয়ে দেখি মেয়ের ফোন। মেয়ে কলকাতার বাইরে, হস্টেলনিবাসী, একা থাকে, ফলে অসময়ে ফোন বাজলে এক লহমায় ঘুম ছুটে যায়। ফোন কানে দিয়ে শুনি মেয়ের গজগজে কণ্ঠস্বর – “কোথায় থাকে, কোথায় যায়, ফোন ধরে না…”
আমার হ্যালো শুনে বলল, “মা কোথায়!” প্রশ্ন নয়, চ্যালেঞ্জ।
তাকিয়ে দেখি তার মা বিছানায় নেই। বললাম, “কী হয়েছে?”
“আরে, তাড়াতাড়ি করো, শাড়ি পরতে হবে!”
ওহ্, জীবনমরণ সমস্যা নয়, কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর কলেজের বেশি দেরি নেই। তাই ধরফরিয়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “নাও… শাড়ি পরতে হবে…”
পরে জানতে চাইলাম, “শাড়ি পরা হল? আজ কলেজে এথ্নিক্ ডে?”
ছেলে বসেছিল ওখানেই। বলল, “ও, তাই ঘুমের মধ্যে শুনছি মা বলছে, ডান দিকে আঁচল, বাঁদিকে আঁচল, তাতে চাবির গোছা!”
চাবির গোছা!
জানা গেল, কলেজের ‘এথ্নিক্ ডে’ উদ্যাপনের জন্য সবাইকে বলা হয়েছে, দিশি পোশাকে আসতে। এবং শুধু দিশি না, একেবারে প্রদেশি! অর্থাৎ, মেয়েরা শুধু শাড়ি পরলে চলবে না, বাঙালি মেয়ে বলে বাঙালি শাড়ি পরতে হবে বাঙালি ঢঙে, কাঞ্জিভরম বা ইক্কত পরলে হবে না, সে থাকবে দক্ষিণ ভারতীয় বা গুজরাতিদের জন্য তোলা।
“শাড়ি পেল কোথায়?”
“বা-রে, আগের বারেই তো ধনেখালি নিয়ে গেল একটা – আমার আলমারি থেকে।”
করিৎকর্মা মেয়ে!
ছেলে বলল, “আরে আমাকেও তো ন’শো টাকা দিয়ে ওই বিদেশ বিভুঁইয়ে বাঙালি পাঞ্জাবি কিনতে হয়েছিল, মনে নেই – যে পাঞ্জাবিটা গড়িয়াহাটে তিন-চারশো টাকায় কেনা যেত…”
মনে হলো, ভাগ্যিস এমন একটা কলেজে পড়তে হয়নি! আমাকে যদি ধুতি পরতে হত – সে এক কাণ্ড হত! বিয়ের সময়েই… আচ্ছা থাক।
তবে কলেজে ধুতি পরা নিয়ে একটা ব্যাপার হয়েছিল বটে। সে কথাটা মনে পড়ে গেল।
মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবার সময়ে কর্তৃপক্ষ আমাদের নানারকম কাগজপত্র দিয়েছিল, তার মধ্যে একটা ছিল সাদা কাগজে কালো কালিতে ছাপা একটা বই, তার নাম ‘প্রস্পেক্টাস’। বারো পয়সা দাম ছিল। আমার ধারণা বইটা ১৮২২ সালে ছাপা, ‘নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন’ যখন তৈরি হয়েছিল, পরে মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গল তৈরি হবার পরে ১৮৩৫-এ একটা এডিশন হয়। সেটাই হয়ত এখনও ছাত্রদের কিনতে হয় প্রতি বছর, ভর্তির সময়।
কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে, ছুটির দিন দুপুরে পড়াশোনা না-করার ফাঁকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম বইটা। বারো-চোদ্দ পাতার বই। লতপতে কাগজে ছাপানো। এটা সেটা লেখা, সেগুলো সবই ১৯ শতকের নিরিখে অর্থপূর্ণ – ১৯৮০ সালে হাস্যকর। হঠাৎ আঁতকে উঠে প্রায় বিছানা থেকে পড়েই যাই আরকি! দেখি সে বইয়ে বেঙ্গলি হিন্দু (Bengali Hindoo) ছাত্রদের একটা ইউনিফর্ম-এর কথা লেখা রয়েছে! সে ইউনিফর্মের বাহার দেখে আমার চোখ ছানাবড়া।
বইটা গুছিয়ে রাখা ছিল, এখনও হয়ত আছে – কিন্তু সে কোথায় আর মনে নে বলে স্মৃতি থেকেই লিখছি – সন্দেহ হলে আমার সহপাঠীদের কাছ থেকে কেউ জেনে নিতে পারেন।
বেঙ্গলি হিন্ডু ছাত্ররা (ছাত্রীরা নয়) পরবে, dhoti and shirt, the shirt should be tucked into the dhoti, black laced leather shoes with white socks, a coat may be worn over the shirt, in which case a belt should be worn over the coat. অর্থাৎ, ধুতি আর শার্ট, যে শার্ট থাকবে ধুতির নিচে গোঁজা, ফিতে দেওয়া কালো চামড়ার জুতো, সঙ্গে সাদা মোজা। চাইলে কোট পরা যেতে পারে, কিন্তু তাহলে কোটের ওপর একটা বেল্ট পরতে হবে।
হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম। তখনকার সাহেবরা নেটিভদের মানুষের সমান জ্ঞান করত না সেটা জানতাম, কিন্তু গল্পকথায়, এবং সিনেমায় দেখে। নিজের হাতে তার একটা জলজ্যান্ত প্রমান দেখে খানিকক্ষণ খাবি খেলাম বসে। বুঝলাম, ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের ডাক্তারি শেখানোর সঙ্গে সাহেবরা খানিক হাসাহাসিও করত। সেই সঙ্গে রাগ হল, যে বাঙালি হিন্দুদেরই বিরুদ্ধে এমন ডিস্ক্রিমিনেশন দেখে। মেয়েরা শাড়ি পরতে পারবে, মুসলমান বা বৌদ্ধ হলে শেরওয়ানি বা আলখাল্লা, মারাঠি হলে তাদের মতো জামাকাপড় (মারাঠিরা তখন কী পরত?) – আর আমার মতো হলেই তাদের সং সেজে যেতে হত? ইয়ার্কি?
পরদিন প্রস্পেক্টাসটা নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের দেখালাম। কিছুদিনের মধ্যে দেখি সবাই ওই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে। এমনকি কয়েকজন সিনিয়রও। এর আগে কেউ খুলে দেখেইনি কী লেখা আছে। আজ হয়ত কারওর মনে নেই যে ওটা আমিই প্রথম দেখিয়েছিলাম, এবং এ-ও হতে পারে, আমরা অনেকেই আবিষ্কার করেছিল, কেউ হয়ত আমারও আগে।
যাই হোক, সবাই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতে শুরু করল। এবং খুব শিগগিরই কেউ বলতে শুরু করল, চ’ না, একদিন ক্লাসে যাই ওই পোশাকে। এক দিন সারা দিন ওই পোশাক পরে ঘুরে বেড়াই। কেউ বললে প্রস্পেক্টাস খুলে দেখিয়ে দেব। বেশ হবে।
ক্রমে দেখা গেল সারাদিন ধরে ওই ধরাচূড়ো পরে থাকা কারওরই খুব মনঃপূত হচ্ছে না। বিশেষত অ্যানাটমি বা ফিজিওলজির ক্লাসে বা প্র্যাকটিকালে যাবার সাহস কারওরই নেই। পড়ে রইল বায়োকেমিস্ট্রি। যে কারণেই হোক বায়োকেম শিক্ষকদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কম ছিল, ভয় পেতাম কম। ফলে স্থির হল, একদিন সকালে আটটার ক্লাসে ক্লাসশুদ্ধ ছেলে ধুতি, শার্ট, বুটজুতো পরে, কোট চড়িয়ে তার ওপরে বেল্ট বেঁধে আসবে। তারপরে ক্লাস শেষ হলে ধুতিটুতি খুলে প্যান্ট শার্ট পরে পূণর্মূষিক হয়ে যাবে।
না, ঠিক বললাম না। ক্লাসশুদ্ধ ছেলে না। কিছু ছেলে। অনেকেই এই প্ল্যানে সায় দেয়নি। কেউ কেউ সায় দিলেও যোগ দেয়নি। আমি দ্বিতীয় দলে। কারণ আমি ধুতি পরতে পারতাম না। এখনও পারি না। বিয়ের সময়ে ছোটোমামা… আচ্ছা থাক।
এর পরে কেউ বলল, আচ্ছা, আমরা যদি ভোরের ক্লাসে ধুতি পরে গিয়ে বসে থাকি, আর ক্লাস শেষ হলে ধুতি খুলে ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টে যাই, তাহলে তো কেউ জানতেও পারবে না। তাহলে আর মজা হল কই?
তাহলে?
সমস্যার সমাধান হল এই, যে ক্লাস শুরু হবার আগে তারা ঢুকবে না। ক্লাস শুরু হয়ে জমে যাবার পরে আসবে। আমাদের ক্লাসগুলো ছিল লেকচার থিয়েটার, গ্রিক থিয়েটারের মতো – ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতো উঠে গেছে সামনের রো থেকে পেছনের রো-তে। লোকসভায় যেমন। অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো এই থিয়েটারের সামনে টিচারের এলাকা। পেছনের দেওয়ালে বোর্ড।
বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস সিলেক্ট করার ফলে একটা সমস্যা দেখা দিল। অ্যানাটমি আর জেনারেল লেকচার থিয়েটারে প্রবেশদ্বার টিচারের পাশ থেকে বা পেছন থেকে। ফলে কেউ ঢুকলে তাদের টিচারের এলাকা পার করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সিটে গিয়ে বসতে হয়। কিন্তু বায়োকেম লেকচার থিয়েটারের প্রবেশ টিচারের সামনে দিয়ে, অর্থাৎ বসার সিটের পেটের ভেতর দিয়ে। সেখান দিয়ে ঢুকেই পাশে সিঁড়ি, অর্থাৎ, বেশিক্ষণ ধুতি দেখান যাবে না।
স্থির হল, ক্লাস শুরু হবার পরে সবাই একে একে ঢুকবে, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বসতে যাবে না। টিচারের ডেস্ক-এর সামনে দিয়ে, গোটা ক্লাসের সামনে দিয়ে ক্লাসের ডানদিক থেকে বাঁ দিকে যাবে (বা বাঁ দিক থেকে ডান দিকে) এবং সে দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেছনে বসবে। ফলে সবাই অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা দেখতে পারবে।
এই ফার্স-এর কথা শুনে কিছু ছাত্র বলল, না, এর মধ্যে আমি নেই, কিন্তু অন্য কেউ কেউ যোগ দিল।
যোগাড় হল ধুতি, কোট, বেল্ট। তবে সবার ফিতেওয়ালা কালো জুতো নেই। তারা যা পরত – কাবুলি জুতো, বা স্লিপ অন (সে নামটা সবে আসছে। অনেকেই পাম্প-শু বা পামশু বলত) ইত্যাদি পায়ে এসেছে। কিছু জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ লোক জোগাড় হল, যারা ধুতি পরাতে পারে – তারা সবাইকে ধুতি পরতে সাহায্য করল। অর্থাৎ আমার মতো আরও লোক ছিল।
নির্দিষ্ট দিনে ক্লাসে সবাই এসেছিল বলেই আমার ধারণা। বায়োকেমিস্ট্রির হেড ক্লাস নেবেন। অন্যান্য দিন ওঁর ক্লাসে বেশি লোক হত না। সেদিনও ভীড় বেশি নেই। কারণ প্রায় তিরিশ চল্লিশজন তখনও ধুতি পরছে। ভদ্রলোক জানেনও না, কী হতে চলেছে, ঘুমভাঙা সকালে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। আমরাও নোট নিতে নিতে এক চোখ রাখলাম দরজায়, কখন আসে বাকি বদমাইশের দল।
সেইদিনের ক্লাসের চেয়ে একাধারে বেশি বোরিং এবং উত্তেজক ক্লাস বেশি করিনি। ঘড়ির কাঁটা টিকটিকিয়ে চলেছে তো চলেছেই। কিন্তু কারওর দেখা নেই। শেষে, সাড়ে আটটা পেরিয়ে ঘড়ি প্রায় পৌনে নটার কাছাকাছি, হঠাৎ ক্লাসের দরজা থেকে তারস্বরে, শোনা গেল, “নমস্কার!”
প্রফেসর বোর্ডে লিখছিলেন, ঘুরতে ঘুরতে ঘড়ি দেখে নিলেন। সম্ভবতঃ, “মাই বয়, ইউ আর টু আর্লি ফর দ্য নেক্সট ক্লাস,” জাতীয় কিছু কড়া কথা বলার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু দরজায় দাঁড়ানো শুভঙ্করকে দেখে থমকে গেলেন। বড়োসড়ো চেহারার ছেলেটা বিজাতীয় ধুতি, শার্ট, কোট পরে দাঁড়িয়ে, হাতে আবার একটা গোলাপ ফুল।
হাতে চক, মুখে হাঁ, প্রফেসরের অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে শুভঙ্কর “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার,” বলে ঢুকে পড়ল, পেছনে পেছনে অন্যান্যরা। সে দলে রয়েছে সুকুমারও – সুকুমারকে মনে আছে নিশ্চয়ই? ওই যে, মোটোরবোট করে কলেজ এসেছিল… হ্যাঁ, সে-ই।
সুকুমারের পরণে কেবল ধুতি-জুতো-কোট নয়, কোঁচা হাতে একেবারে। এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কেউ বলেছিল, “সাহেবদের সময়ে ছাত্ররা নিশ্চয়ই কোঁচানো ধুতি পরে আসত না, ওদের তো ল্যাবে কাজ করতে হত।”
তার উত্তরে সুকুমারের মতো যারা কোঁচানো-পন্থী, তারা বলেছিল, “কেন, সাহেবরা তো বলেনি মালকোঁচা মারতে হবে, অবশ্যই কোঁচা হাতে যাওয়া যাবে।”
সুকুমার ওই অবস্থাতেই বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল তাতে স্যার নানা খাদ্যের ওজনের সঙ্গে তার খাদ্যগুণ পড়াচ্ছিলেন। থেমে বলল, “ডিমের ওজন কি খোসা সমেত, স্যার?”
উত্তরটা স্যার দিয়েছিলেন কি না আমার মনে নেই। ক্লাসের বসে থাকা ছাত্রদের মধ্যেও খুব কম সংখ্যক ছাত্রই ব্যাপারটা জানত। মেয়েরা হয়ত কেউই জানত না। তারাও হতভম্ব। তবে সে ভাব কাটতে দেরি হল না। উল্লাস, হাততালি, সিটি, এবং (তখন হাতে গোনা লোকের ক্যামেরা ছিল – তাও ফোনে নয়) ফ্ল্যাশবাল্ব জ্বেলে ছবি! ধুতি পরিহিত ছাত্ররা – কজন এখন ঠিক মনে নেই, জনা পঞ্চাশ – অর্থাৎ ক্লাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – লেকচার থিয়েটারে ঢুকে স্যারের ডেস্কের সামনে দিয়ে হেঁটে পুরো ক্লাস অতিক্রম করে ও-ও-ও-ই দিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে একেবারে পেছনে বসল সারি বেঁধে। অনেকেই অনেক কিছু করেছিল। শুনলাম দেবদত্ত নাকি নকল গোঁফ লাগিয়েছিল হিটলারি স্টাইলে। আমার মনে ছিল না। মনে আছে কিরীটীর ধুতি খুলে গিয়েছিল। কোঁচাটা বেঞ্চের কোনে আটকে গিয়ে ফরফর করে খুলে গেল, দেখা গেল নিচে হাফপ্যান্ট। এই ভয়ে অনেকে ফুলপ্যান্টের ওপরেই ধুতি পরেছিল। সেটাও দেখা গেছিল ধুতির নিচে।
এর পরেও স্যার পড়াতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে ক্লাসটা স্যারের হিসেবেই হয়েছিল, আমাদের হিসেবে নয়।
কলেজে হইচই হয়েছিল কিছুদিন। নাক উঁচু কিছু সিনিয়র ছাত্র আপত্তি করেছিল, “এ আবার কী নাটক,” গোছের মন্তব্য করে। তাদের বলা হয়েছিল, কেন তোমরা প্রস্পেক্টাস পড়নি? আমাদের শিক্ষকরাও পড়েননি কেন? কেন ১৮৩৫ সালের প্রস্পেক্টাস আমাদের ঘাড়ে চাপান হল… ইত্যাদি।
পড়েননি কেউ। প্রস্পেকটাসে শেষের দিকে মেডিক্যাল কলেজের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এবং তাদের হেডদের নাম ছিল – আধুনিক। কিন্তু তার আগে যা লেখা, সেটা নিয়ে কারওরই মাথাব্যথা ছিল না – নয়ত ভেবেছিলেন, এটা ঐতিহ্য, তাই থাক।
এই ঘটনাটা প্রথমবার লিখে যখন আমাদের ক্লাসমেটদের সঙ্গে আলোচনা করলাম, তখন ক্রমে দুটো আরও ব্যাপার জানতে পারলাম। আমাদের চেয়ে কিছু বড়ো একটা ব্যাচ, হয়ত তিন বা চার বছরের সিনিয়র, প্রেসিডেন্সি কলেজে এই কাণ্ড করেছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ, এমনকি হয়ত কয়েক মাস ধরে। তাদেরও নাকি কোথাও এমন একটা ইউনিফর্মের কাহিনী ছিল। তারা সেই নির্দেশ পালন করে দিনের পর দিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, গায়ে চাদর বা শাল জড়িয়ে, মোজা সহ পাম্প-শু পরে, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে পাট পাট করে চুল আঁচড়ে ক্লাস করতে যেত। শিক্ষকরা দেখেও দেখতেন না। বোধহয় ভাবতেন, এই নিয়ে কিছু বলতে বা জিজ্ঞেস করতে গেলে যদি সাপ বেরোয়, থাক বাবা! আর দ্বিতীয়টা, অনুব্রত আমাদের মনে করাল, যে আমাদের সেই অধ্যাপক সম্ভবত মেডিক্যাল কলেজের একমাত্র অ-ডাক্তার, কেমিস্ট্রিতে পি-এইচ-ডি অধ্যাপক ছিলেন। ফলে তিনি আসতেন, ক্লাস নিতেন, চলে যেতেন – অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে (এমনকি নিজের ডিপার্টমেন্টেও) বিশেষ লেনা-দেনা ছিল না। ফলে তিনি হয়ত ব্যাপারটা নিয়ে কারওর সঙ্গে আলোচনা করেননি, এমনকি ভাবেনও নি।
শিক্ষকরা যে অনেক ব্যাপার নিয়ে ভাবেন না, সেটা কেমিস্ট্রি-র অধ্যাপকের সেদিনের রি-অ্যাকশনেই বোঝা গেছিল। সবাই বসে পড়ার পরে আমরা দেখলাম তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন, আর হাতের চক দিয়ে টুক-টুক করে সামনের টেবিলে টোকা দিচ্ছেন। হইচই থামল, সবাই এবারে উদগ্রীব, স্যার কী বলবেন, অনেকে প্রস্পেক্টাস খুলছে… দেখিয়ে দেবে… স্যার টোকা থামিয়ে বললেন, “আই অ্যাডমায়ার ইওর পেট্রিওটিজম, বাট হোয়াই ডিড ইউ কাম টু ক্লাস সো লেট?”
অর্থাৎ, তোমাদের দেশভক্তিকে আমি প্রশংসা করি, কিন্তু ক্লাসে দেরি করে এলে কেন?
বলে আবার পেছন ফিরে বোর্ডে গিয়ে লিখে লিখে পড়াতে শুরু করেছিলেন।