জোড়া যমজ ও জিন-পরিবেশ পর্ব ১
এক বছর হল বালিয়া মারা গেছে।(তথ্যসূত্র ১)
বালিয়া কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। ওড়িশার সাধারণ ঘরের বাচ্চা বালিয়া মারা যাবার ঘটনাটি খবরের কাগজে ঠাঁই পাবার মত কিছু নয়, যদি না …
যদি না বালিয়ার ওপরে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ ২০১৭ সালে এমন এক অপারেশন করা হত যার জন্য তাকে, বা তাদের, পরের দু’বছর হাসপাতালে কাটাতে হত। এই অপারেশনটি ছিল ভারতে প্রথম সফলভাবে দুটি মাথা-জোড়া যমজ শিশুকে আলাদা করার অপারেশন। (চিত্র ১, জগা ও বালিয়া মাথা-জোড়া অবস্থায়। চিত্র ২, অপারেশনের পরে তারা আলাদা বসে আছে।)
জগা আর বালিয়া জন্মেছিল মাথা-জোড়া যমজ হিসেবে। এদের মাথা দুটি আলাদা করার অপারেশনের সাফল্যের হার খুব কম। বালিয়াকে তার জোড়া যমজ ভাই জগা-র থেকে আলাদা করা হয়েছিল তাদের দু’বছর বয়সে। অপারেশনের পরে তারা দুজনেই বেঁচে ছিল। কিন্তু মাথায়-মাথায় জোড়া লাগা যমজ দুজনকে বড় বয়সে আলাদা করা এখনও দুঃসাধ্য কাজ। লাদান ও লালেহ নিজেদের জীবন দিয়ে তার প্রমাণ রেখেছে।
ইরানি দুই বোন লাদান ও লালেহ বিজানি—এদেরও মাথা দুটো জোড়া ছিল (চিত্র ৩)।
জীবনের ২৯টা বছর জোড়া থাকার পরে তারা স্থির করে, এবার তারা আলাদা হবে। ডাক্তারেরা জানান, অপারেশন করে আলাদা করার চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু মস্তিষ্ক জোড়া আলাদা করা সহজ কর্ম নয়, তাদের মৃত্যু হতে পারে। লাদান ও লালেহ বলে, মরে গেলে যাব, আলাদা করার চেষ্টা করতেই হবে। ২০০৩ সালে সিঙ্গাপুরে তাদের অপারেশন হয়—কেউ বাঁচেনি। (তথ্যসূত্র ২)
বিজানি বোনেদের সংযুক্ত মস্তিষ্ক দুটোকে অপারেশন করে আলাদা করতে রাজি এমন নিউরোসার্জন সহজে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা সারা বিশ্ব খুঁজেছে। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের নিউরোসার্জনের ডা. কিথ গো অপারেশনটি করতে রাজি হন। সম্ভবত ডা. গো অপারেশনটি না করলেই ভাল করতেন। সেই সময়ে তিনি বলেছিলেন, সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল শূন্যের কাছাকাছি। আমরা এখানে ডাক্তারের নৈতিক ভুল নিয়ে আলোচনা করব না। বরং আমরা দেখব, সারা বিশ্বের সমস্ত নামকরা নিউরোসার্জন যেখানে বলেছিলেন, অপারেশনের সম্ভাব্য ফল হল মৃত্যু, সেখানে বিজানি যমজদ্বয় কেন আলাদা হতে আক্ষরিক অর্থেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
.
বিজানি বোনেরা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ছিল। তারা যে জীবন যাপন করছিল, তা আদর্শ জীবনযাপন না হতে পারে, জীবনের পরিপূর্ণতা থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল, এমনও বলা যায় না। তাদের মাথার খুলি জোড়া ছিল, রক্ত সংবহন ছিল মিশ্রিত। তবু তারা সমাজের অংশ হিসেবে থাকতে পারত। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল, এবং আইনের ডিগ্রি অর্জন করেছিল। তারা বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করত, তাদের সঙ্গে ডিনার পার্টিতে যেত। এমন নয় যে অপারেশন করে আলাদা না হলে তাদের জীবনে হারানোর মত কিছুই ছিল না; তাদের হারানোর অনেক কিছু ছিল। তারা যা যা করতে পেরেছিল, আফগানিস্তানের মেয়েরা তার অনেক কিছুই এখন করতেই পারে না।
.
তবুও, তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চেয়েছিল। “হঠাৎ জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল /কোন্ ভূত?” এর মত তারা কোনও অবোধ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়নি। তাদের জোড়া লাগা জীবনকে তারা নিয়ত যন্ত্রণাবিদ্ধ মনে করত, এবং তার যুক্তিসহ কারণ ছিল। অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সর্বদা, সদা-সর্বদা, বসবাসের জন্য প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে আপস করতে হয়। কিন্তু যখন দুজন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ‘এক ব্যক্তি’ হিসাবে থাকতে বাধ্য হয়, তখন আপস ভেঙে পড়ে।
.
বিজানি বোনেদের আকাঙ্খা এবং ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিরাট ফারাক ছিল। লাদান চেয়েছিল আইনজীবীর পেশা বেছে নিতে, আর লালেহ চেয়েছিল সাংবাদিক হতে। লাদানের পছন্দ ছিল কম্পিউটার গেম খেলে সময় কাটানো, আর লালেহ সেই সময় প্রার্থনা করতে পছন্দ করত। এরকম দুটো কাজ জোড়া-দেহে করা অসম্ভব ছিল, তাই দুজনেই নিজের জীবন ও স্বাধীনতার উপর বিশাল বিধিনিষেধ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তারা বুঝেছিল তাদের বিয়ে ও সন্তানধারণ অসম্ভব।
লাদান ও লালেহ-র দত্তক পিতা আলিরেজা সাফাইয়ান সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাতকারে জানান, দুজনের মধ্যে লাদান ছিল বেশি কর্তৃত্বপূর্ণ এবং স্পষ্টভাষী। সে আইন নিয়ে পড়াশুনো করার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিল। অন্যদিকে লালেহ ছিল তুলনায় শান্ত, চিন্তাশীল এবং বেশি ধার্মিক; আর সে সাংবাদিক হতে চাইত। কিন্তু সে আইন পড়তে বাধ্য হয়। তাদের ব্যক্তিত্ব ও রুচি ছিল ভিন্নরকম। লালেহ হলুদ পছন্দ করত, লাদান নীল পছন্দ করত। লালেহ যে খাবার খেতে ভালবাসত, লাদান সেটি পছন্দ করত না। সাফাইয়ান বলেছেন, “রাতে যখন বাসায় যেতাম, দেখতাম একজন ঘুমাচ্ছে ও অন্যজন খবরের কাগজ পড়ছে। বা, একজন সেলাই করছে, অন্যজন অঙ্ক করছে।” (তথ্যসূত্র ৩)
(ক্রমশ)
চিত্র পরিচিতি
১) জগা ও বালিয়া, মাথা জোড়া লাগা অবস্থায়
২) জগা ও বালিয়া, অপারেশন করে আলাদা করার পরে
৩) লালেহ ও লাদান
.
তথ্যসূত্র
১) The Indian Express, 26 November, 2020
২) Independent, Wednesday 09 July 2003
৩) A father feels the pain of separation. The Age, July 13, 2003