মানুষের উদ্ভবের একটি বিবর্তিত-চিত্র
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা তৈরির জন্য একটা ছবির রকমফের খুব ব্যবহৃত হত, এমনকি এখনও হয়। বিজ্ঞানমেলা, স্কুলের সায়েন্স মডেল প্রদর্শনী, পুজোর সময়ে প্যান্ডেলের আশেপাশে বইয়ের স্টলে, এবং বইমেলা—কোথায় না এই ছবি দেখেছি! সারা পৃথিবীতে বিবর্তনের ধারণা তৈরির পেছনে এই ছবির ভূমিকা অনস্বীকার্য।(চিত্র ১)
শিল্পী রুডলফ জালিংগার এই ছবিটি আঁকেন ১৯৬৫ সালে। ছবির নাম ‘মার্চ অফ প্রোগ্রেস’, সেটা ছাপা হয়েছিল ‘লাইফ নেচার লাইব্রেরি’ পত্রিকায়। তারপর এই চিত্রটি অসংখ্য পত্রিকা ও বইতে বহুভাবে বিবর্তিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন এখানে চিত্র (২) তে দেখা যাচ্ছে। ছয়টি প্রাণী হাঁটার ভঙ্গিমায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। সবার পিছনে একটি প্রায়-বানর, সামনের হাত দুটো কোনোভাবে ওপরে তুলে দুপায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। তার পরে একটি শিম্পাঞ্জি-জাতীয় প্রাণী, দুপায়ে হাঁটলেও সামনের ‘হাতে’ তাকে ভর রাখতে হচ্ছে। সামনের দিকে চিত্রগুলি ধারাবাহিকভাবে একটু লম্বা, একটু কম কুঁজো এবং বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সবার সামনে হল বুক-উঁচু করে পুরোপুরি খাড়া আধুনিক মানুষ বা ‘হোমো সেপিয়েন্স’। তাদের হাতের হাতিয়ারও ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। মানুষের বিবর্তনকে চিত্রিত করার জন্য সহজবোধ্য এবং সর্বজন-গ্রাহ্য এই ছবিটি সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক চিত্র।
সমস্যা একটাই। ছবিটি ভুল। বনমানুষ বা এপ থেকে মানুষ এত সরলরেখার মত পথে উদ্ভূত হয়নি।
‘ডারউইনের বুলডগ’ নামে খ্যাত বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলি ১৮৬৩ সালে তার বই ‘এভিডেন্স অ্যাজ টু ম্যানস প্লেস ইন নেচার’ বইতে ‘এপ’ ও মানুষের বিবর্তনের কথা লেখেন। তিনি অনুমান করেছিলেন, এরা কোনও এক সাধারণ পূর্বসূরী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তার বছর আষ্টেক পরে ডারউইন লিখলেন ‘দ্য ডিসেন্ট অফ ম্যান’। তিনি বললেন, আফ্রিকার গোরিলা আর শিম্পাঞ্জি এই দুই এপ শরীর ও স্বভাবে মানুষের কাছাকাছি, এদের আর মানুষের সাধারণ পূর্বসূরী ছিল এক।
ডারউইনের পরে অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও শিক্ষিত সমাজের বড় অংশ মেনে নিয়েছিলেন যে, আধুনিক মানুষ আর এপরা একই সাধারণ পূর্বসূরী থেকে উদ্ভূত। তবে তারা ভেবেছিলেন, সেই সাধারণ পূর্বসূরী থেকে মানব বংশের উদ্ভব হল একমুখী ‘উন্নতি’, সেই উন্নতির সোপান হল এক আধা-এপ আধা-মানব। সেই কল্পিত প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মিসিং লিঙ্ক’—হারানো যোগসূত্র।
এই যে ধাপে ধাপে নিম্নতর জীব থেকে উচ্চতর জীব মিসিং লিঙ্ক হয়ে উচ্চতম জীবে পৌঁছানো, এটা হল খানিকটা ল্যামার্কিয় ধারণা। উঁচু গাছের পাতা খাবার জন্য জিরাফ চেষ্টা করে বলে বংশ-পরম্পরায় তার গলা লম্বা হয়। মানুষ বুদ্ধির সাধনা করে বলে বংশ-পরম্পরায় বুদ্ধিমান হয়। আবার এই ধারণা পুরনো আব্রাহামিক ধর্মের ধারণার আধা-বৈজ্ঞানিক রূপান্তরও বটে। ওল্ড টেস্টামেন্ট বলেছে, ঈশ্বর নিম্নতর জীব সৃষ্টি করার পরে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথমদিকের ডারউইনবাদীরাও অনুরূপভাবে ভেবেছিলেন, জীবসৃষ্টি হল এক লম্বা শিকলের মত। তার প্রতিটা আংটা হল একটা জীব, আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আংটা হল মানুষ। এই ধারণাটি ‘গ্রেট চেইন অফ বিইং’ বা ‘সৃষ্টির মহান শৃঙ্খল’ নামে খ্যাত।(টীকা ১)
ডারউইন নিজে এরকম ক্রমোন্নতির ধারণায়, বা একটা প্রজাতি থেকে উন্নততর প্রজাতির উদ্ভবের অনিবার্যতায়, বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ভাবতেন সমস্ত জীবদের মধ্যে সম্পর্ক হল গাছের কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার মতো, গাছের কিছু শাখা টিকে আছে, কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ডারউইনের ধারণা অনুসারে, একই সাধারণ পূর্বসূরী থেকে বহু উত্তরসূরী বেরিয়েছে। তার একটি থেকে এসেছে মানব, অন্যদিকে নানা এপ। সব উত্তরসূরী টিকে থাকেনি, এবং বিবর্তনের অভিমুখ মানব-জন্মের দিকে একমুখীভাবে ধাবিত হয়নি।
বিগত এক শতকেরও বেশি সময় ধরে মানব-বিবর্তনের পথে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের জীবাশ্ম ও তাদের ব্যবহার করা নানা জিনিস পাওয়া অমূল্য তথ্য, ও অধুনা জিন বিশ্লেষণের তথ্য একত্রিত করে বোঝা গিয়েছে, মানব-শিম্পাঞ্জি-বনোবো-গোরিলা, এদের এক সাধারণ পূর্বসূরী ছিল। তার থেকে প্রথমে গোরিলা-বংশ প্রায় ৯০ লক্ষ বছর আগে পৃথক হয়ে যায়। মানুষ-শিম্পাঞ্জি-বনোবো, এদের সাধারণ পূর্বসূরী থেকে মানব-বংশ মোটামুটি ৭০ লক্ষ বছর আগে আলাদা হয়ে যায়। মানব-বংশে প্রথমে অনেকগুলো নরবানর ধরনের প্রাণী এসেছে। তারা প্রায় সবাই উত্তরসূরী না রেখেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তবে তাদের কোনও এক বা একাধিক প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে নানা ধরনের ‘আদিম মানুষ’। আদিম মানুষদের একটির উত্তরসূরী হলাম আমরা, আধুনিক মানুষ। বাকিরা কোনও উত্তরসূরী না রেখে হারিয়ে গেছে।
রুডলফ জালিংগারের এই চিত্র অনুসারে, বিবর্তন একটি একমাত্রিক প্রক্রিয়া। বিবর্তনে সরলরৈখিক অগ্রগতির ফলে ধীরে ধীরে এবং নিশ্চিতভাবে জীবের ‘উন্নতি’ হয়। ‘মানুষ’ হল উন্নতির চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই ধারণা দুটি কারণে ভুল।
প্রথমত, বিবর্তন সরলরৈখিকভাবে নতুন প্রজাতি তৈরি করে না। বিবর্তনের ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ও বিলোপ ঘটতে থাকে। সব মিলিয়ে বিবর্তনের রূপরেখা হল ঝোপের মত, যেখানে অধিকাংশ ডাল চূড়োয় পৌঁছানোর আগেই শেষ হয়ে গেছে। ‘জীবন-বৃক্ষের’ কিছু ‘শাখা’ বিলুপ্ত হয়, কয়েকটি টিকে থাকে।
দ্বিতীয়ত, বিবর্তন ‘উন্নত’ বা ‘উচ্চ-বিবর্তিত’ জীব উৎপন্ন করার লক্ষ্যে কাজ করে না। যেসব প্রজাতি উদ্ভূত হয় এবং টিকে থাকে, তারা কেবলমাত্র ‘ভালভাবে বিবর্তিত’ হবার ফলে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, এমন নয়। আকস্মিক ঘটনা তাদের টিকে থাকা ও বিশেষ দিকে বিবর্তিত হওয়াকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে, সেটা ছিল আকস্মিক ঘটনা। ডাইনোসরের বিদায়ের ফলে স্তন্যপায়ীদের বাড়বাড়ন্ত হয়, এবং স্তন্যপায়ী বংশে মানুষ আসে। মানুষের উদ্ভব কোনও পূর্ব-পরিকল্পিত ঘটনা নয়, জীবজগতের অন্তিম পরিণতিও নয়।
ডারউইন নিজে ক্রমোন্নতি ও তার ফলে মানুষের উদ্ভবের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রজাতির উদ্ভব সম্পর্কে ‘জীবন-বৃক্ষের’ প্রথম ধারণা তিনিই দিয়েছিলেন। ডারউইনের ধারণা অনুসারে, একই সাধারণ পূর্বসূরী থেকে একদিকে এসেছে বিভিন্ন এপ, অন্যদিকে এসেছে মানব। কিন্তু সেই সাধারণ পূর্বসূরীর বংশ থেকে বহু উত্তরসূরী বেরিয়েছে। বিবর্তনের অভিমুখ মানব-জন্মের দিকে একমুখী ভাবে ধাবিত হয়নি।
চিত্রটি বিবর্তন সম্পর্কে অতি-সরল ধারণার জন্ম দেয়। তবে এ কথা সত্যি যে, একধরণের এপ থেকেই মানুষের উদ্ভব হয়েছিল, তবে সেই এপ বর্তমানে টিকে নেই।
টীকা
১) ‘গ্রেট চেইন অফ বিইং’ শব্দগুচ্ছ মহাবিশ্বের তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। প্রথমত, প্রাচুর্য বা পূর্ণতার নীতি। এই নীতি অনুসারে, অসম্ভব বা স্ব-বিরোধী নয় এমন সমস্ত কিছুই মহাবিশ্বে আছে। দ্বিতীয়ত, ধারাবাহিকতার নীতি। এই নীতি বলে, মহাবিশ্ব অসীম সংখ্যক ধাপের সমাহার, প্রতিটি ধাপ তার কাছের ধাপের সঙ্গে একটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে যুক্ত। তৃতীয়ত, উন্নতির নীতি, যার প্রতিপাদ্য হল যে তুচ্ছতম জিনিসের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে নিখুঁত অর্থাৎ ঈশ্বর পর্যন্ত একটি শৃঙ্খল রয়েছে। এই ধারণাটি গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর অবদান। তবে রেনেসাঁ-র সময়ে ইউরোপে এটি একটি মানব-কেন্দ্রিক রূপ নেয়। কারণ মানুষ, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান মানুষ, পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য ঈশ্বরপ্রেরিত।
চিত্র
১) ‘মার্চ অফ প্রোগ্রেস’ নামক এই চিত্রটি ১৯৬৫ সালে ‘লাইফ নেচার লাইব্রেরি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
২) ‘মার্চ অফ প্রোগ্রেস’ চিত্রের অনুসরণে অঙ্কিত বিবর্তনের (অ-)বৈজ্ঞানিক একটি চিত্র।
৩) মানব-পূর্বসূরীদের পরিবার ঝোপ (হোমিনিন পরিবার)
তথ্যসূত্র
Su D. F. The Earliest Hominins: Sahelanthropus, Orrorin, and Ardipithecus. Nature Education Knowledge 2013;4(4):11