পুরুষরা কি স্বভাবতই বহুগামী?
• পুরুষ এলিফ্যান্ট সিলের আকার স্ত্রীর পাঁচগুণ।
• পুরুষ গোরিলার আকার স্ত্রীর দ্বিগুণেরও বেশি।
• শিম্পাঞ্জি পুরুষ স্ত্রীর চাইতে বেশ বড়।
• মানুষের সম্ভাব্য পূর্বসূরি অস্ট্রালোপিথেকাস-দের মধ্যে পুরুষরা ছিল স্ত্রীদের চাইতে দেড়গুণ।
• আর মানুষ? গড়পড়তায় পুরুষ মানুষ নারীর চাইতে শতকরা ১৫ ভাগ বড়, কিন্তু পুরুষের পেশি অনেকটাই বেশি। তাদের শরীরের ঊর্ধাঙ্গের পেশি নারীর চাইতে শতকরা ৪০ ভাগ বেশি।
কেন?
পুরুষ এলিফ্যান্ট সিলের হারেম থাকে। সুলতানদের মত হারেম, তাতে অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। অবশ্য সব পুরুষ হারেম রাখতে পারে না, সেরা পুরুষ পারে। তাকে বলে আলফা মেল। এক নম্বর ছবিতে দেখুন, আলফা পুরুষের পাশে তার হারেমের এক স্ত্রী—নেহাতই ক্ষুদে।
দু-নম্বর ছবিতে দুটো পুরুষ সিল, মারামারি করতে উদ্যত। খাদ্যের জন্য নয়, হারেমের দখল নিতে।
তিন নম্বর ছবিতে দুটি পুরুষ সিলই আহত, কিন্তু লড়াই চলছে। যে বাঁচবে, সে হারেমের দখল পাবে।
জীববিজ্ঞানীদের ভাষায় এলিফ্যান্ট সিল হল টুর্নামেন্ট স্পিসিস। টুর্নামেন্ট প্রজাতির পুরুষরা ফুটবল টুর্নামেন্টের মত ট্রফি পাবার জন্য লড়ে। স্ত্রীরা হল ট্রফি। বংশানুক্রমে পুরুষেরা আরও বড়, আরও শক্তিশালী, আরও ধারালো দাঁতের অধিকারী হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা বলেন, এগুলো যৌন নির্বাচনের ফসল। স্ত্রীরা এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে না, তারা ছোটখাট থেকে যায়।
গোরিলা আরেক টুর্নামেন্ট প্রজাতি। পুরুষ গোরিলার আকার স্ত্রীর পাঁচগুণ হয় না, তবে দ্বিগুণ হামেশাই হয় (চার নম্বর ছবি)।
সর্দার গোরিলা সাধারণ স্ত্রীর আড়াই-তিনগুণ হয় (পাঁচ নম্বর ছবি), আর আকারে বড় বলেই সে সর্দার।
গায়ের জোরে সর্দার অন্য পুরুষদের হারিয়ে দিতে পারে। অন্য পুরুষেরা দলছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়, বা সর্দারের অধস্তন হয়ে থাকে। স্ত্রী গোরিলারা সব সময়ে সর্দারের সঙ্গেই গোপন কর্মটি করে, নইলে তার কপালে অনেক দুঃখ। তবে কিনা কবি লিখেছেন চোরি পীরিতি লাখগুণা রঙ্গ। স্ত্রী গোরিলা দলের অন্য পুরুষদের সঙ্গেও সুযোগ সুবিধা বুঝে … নাই বা মুখে বললাম কথাটা। দলের বাইরে বিতাড়িত পুরুষেরা নিজেদের দল বেঁধে থাকে বা একা-একা থাকে। তাদের কেউ একসময়ে সর্দারকে চ্যালেঞ্জ করে (ছয় নম্বর ছবি); জিতলে রাজ-সিংহাসন এবং রাজকন্যে। রাজকন্যে একটি নয়, অনেকগুলি।
সুতরাং এলিফ্যান্ট সিলের মত গোরিলা পুরুষরদেরও যৌন নির্বাচন তাদের বৃহৎ ও বলশালী করে তোলে।
.
শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের আকারে প্রভেদ কম (সাত নম্বর ছবি, আহা, যেন সুখী দম্পতি)।
কিন্তু সেখানেও পুরুষ দলপতি, ও তার হাতে ক্ষমতা অনেক। স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা সামনা-সামনি তার অনুগত, দলের অন্য পুরুষরাও তাই। কিন্তু বনের মধ্যে তো আর জায়গার অভাব নেই, আর সর্দার সব জায়গায় সিসিটিভি রাখতে পারে না। অতএব, অন্য শিম্পাঞ্জিরাও কয়েকটি সন্তানের পিতা হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
মজার কথা হল, এলিফ্যান্ট সিল আর গোরিলার টেসটিস বা শুক্রাশয় দেহের তুলনায় খুব ছোট, সেখানে শুক্রাণু উৎপাদন কম হয়। আর শিম্পাঞ্জির টেসটিস অনেক বড়, সেখানে বেশি সংখ্যায় শুক্রাণু উৎপন্ন হয়, সেগুলো বেশি জোরে দৌড়াতে পারে। স্ত্রী-জননাঙ্গের মধ্যে দুই শিম্পাঞ্জি পুরুষের শুক্রাণুরা প্রতিযোগিতা করে। যার শুক্রাণু সংখ্যায় বেশি, দৌড়ে পটু, তার সন্তান বেশি হয়। এও যৌন প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
মানুষের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ কেমন? মানুষ কি টুর্নামেন্ট প্রজাতি? নাকি সে পেঙ্গুইনের মত একগামী সম্পর্কে আবদ্ধ প্রজাতি? পেঙ্গুইন পুরুষ আর স্ত্রীকে সাইজ দেখে আলাদা করা যায় না (চিত্র আট দেখুন)।
বাচ্চার যত্ন নেয় বাবা-মা মিলে। একটা প্রজনন ঋতুতে তারা একগামী। মানুষ কি সেই রকম?
জুটি-বাঁধা, বাবা মা উভয়ের দ্বারা সন্তানের যত্ন এবং দুই পুরুষ ও নারীর আকারে তেমন ফারাক না থাকা, এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য একগামী সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে নারী ও পুরুষের দেহের গঠনে ভিন্নতা রয়েছে। তাছাড়া আকারে ফারাক স্বল্প হলেও আছে; বিশেষ করে পুরুষের পেশি নারীর চাইতে অনেকটা বেশি। এই বৈশিষ্ট্যগুলি এক পুরুষের সঙ্গে বহু নারীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, সম্ভবত একই নারীর সঙ্গে বহু পুরুষের মিলন হত কম। ফলে সঙ্গম পরবর্তী যৌন নির্বাচনের চাপ পুরুষ মানুষের ওপর কম ছিল। নারীর শারীরিক বিভঙ্গ সম্ভবত নারীর ওপর যৌন নির্বাচনের ফলে উৎপন্ন হয়েছে। পুরুষের চোখে সব নারীর যৌন আবেদন সমান নয়। নারীর স্বাস্থ্য ভাল হলে ও বেশি সন্তানের জন্ম দেবার ক্ষমতা থাকলে পুরুষের কাছে সে বেশি কাম্য। অন্য কথায়, নারীর যৌন আবেদন প্রাথমিকভাবে তার সুস্বাস্থ্য ও প্রজনন-ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। অবশ্য এ দিয়ে বর্তমান সমাজে নরনারীর অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা যায় না। সাংস্কৃতিক বিবর্তন, বিশেষ করে মানুষের সমানাধিকারের ধারণা, মানুষকে তার জৈবিক প্রবণতার দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।
প্রাইমেট প্রজাতিতে স্ত্রী বহুগামী হলে পুরুষদের কিছু বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। অন্য প্রাইমেটদের সঙ্গে পুরুষ মানুষের এই বৈশিষ্ট্যের তুলনা করলে দেখা যায়, মানুষের অণ্ডকোষ তার শরীরের অনুপাতে ছোট; মানুষের দেহে শুক্রাণু তৈরির হার অনেক ধীর; কয়েকবার যৌনমিলনের পরে মানুষের বীর্যে শুক্রাণু সংখ্যা খুব কমে যায়; তার শুক্রাণুর গতি কম ও শুক্রনালীর পেশির জোরও কম। বহুগামী প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষ অনেক কম বার সঙ্গম করে। শিম্পাঞ্জির মত বহুগামী প্রজাতির তুলনায় নেহাতই কম। পুরুষের লিঙ্গের গঠন জটিল বা অলঙ্কার-যুক্ত নয়; মানুষ ও শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষের লিঙ্গে কাঁটার মত গঠন (চিত্র ৯, বিড়ালের পেনাইল স্পাইন) ছিল। সেই জিন মানব-বংশে অকেজো হয়ে গেছে।
অবশ্য এই বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্ত। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ মানব সমাজ একগামী বিবাহ বা এক-পুরুষ বহুনারী বিবাহ চালু। যেখানে পুরুষের বহুবিবাহ অনুমোদিত, সেখানেও অধিকাংশ পুরুষ বাস্তবত তা করতে পারে না। অতীতকালের মানুষের সমাজে নারী-পুরুষের একগামিতা ও বহুগামিতা কেমন ছিল, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। প্রজনন অঙ্গের বৈশিষ্ট্য থেকে মনে হয়, মানুষ বিবর্তনগতভাবে মূলত একগামী, বা কখনোসখনো ‘বহু-স্ত্রী এক-পুরুষ’ সম্পর্কের বংশধারায় উদ্ভূত হয়েছে, এবং শারীরিকভাবে তেমন সম্পর্কের জন্য সে তৈরি।
এই কথাটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার, মানুষের শারীরবৃত্তীয় প্রবণতা বর্তমান সামাজিক নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একমাত্র নির্ণায়ক হতে পারে না।
তথ্যসূত্র
.
১) Dixson AF. Copulatory and Postcopulatory Sexual Selection in Primates. Folia Primatol 2018;89:258–286
২) https://www.nationalgeographic.com/culture/article/110309-humans-men-penises-spines-dna-genome-science
৩) Dixson BJW. Sexual Selection and the Evolution of Human Physique. 2010