[ প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলাম আমার করোনা সংক্রমণ, আইসোলেশন ইত্যাদি বিষয়ে নিছক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই লিখব ‘করোনা যাপন’ শিরোনামে। সেরকমই লিখতে শুরু করেছিলাম। তা প্রায় শেষ হয়ে এলে মনে হচ্ছে আর একটু বেশী কিছু লিখি — বিগত দশ মাসের ঘটনা প্রবাহ এবং আমার সামান্য পর্যবেক্ষণ। সেও তো এক অর্থে করোনা যাপনই। একটু অনিয়মিত হবে হয়তো। দেখা যাক। ]
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবী এবং তার সঙ্গে আমাদের দেশেও করোনার প্রকোপ কমছে। সংখ্যাগতভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুইই একটু একটু করে কমার দিকে। কোথাও কোথাও সংখ্যার ওঠানামা থাকলেও মোটের উপর পৃথিবী সুস্থতার দিকে যাচ্ছে বলে অনেকেরই ধারণা। কিন্তু এই ধারণার মধ্যেই বিপদের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি সেই সম্ভাবনাকেই সমর্থন করছে। বাকি দুনিয়ার কথা বাদ দিয়ে শুধু আমাদের দেশ নিয়েই ভাবা যাক।
একটা প্রাথমিক খটকা থাকেই। দৈনিক সংক্রমিতর সংখ্যা যখন প্রত্যেকদিন গড়ে প্রায় এক হাজার করে বাড়ছিল, তখন নয় হাজারে এসে সংখ্যাটি একটু থমকে যায় এবং দশ হাজারে যেতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগে। তারপর আবার হু হু করে বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যা কুড়ি-পঞ্চাশ-আশি-নব্বই হাজার পার হয়ে যায়। দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা যখন এক লক্ষ ছুঁই ছুঁই অবস্থা, ঠিক তখন থেকেই তা কমতে শুরু করে। নিঃসন্দেহে খুব ভালো লক্ষণ। সরকারি পরিসংখ্যানের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ ঠিক নয়। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে এই পরিসংখ্যান সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও ধরে নিচ্ছি, লেখচিত্রের এই নিম্নগতি স্বাভাবিক, পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্রকেই তুলে ধরছে। কিন্তু প্রশ্ন হল – এই স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে তো? সারা দেশেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানোর চেষ্টা চলছে। আনলকের পঞ্চম পর্ব স্বমহিমায় গতিশীল। কিন্তু একটু তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না তো? দৈনন্দিন কাজের পরিধি বাড়াতে হবে, অবশ্যই। সমস্যা হলো, তার সঙ্গে অকাজের পরিধিও বাড়ছে। ফলে অচিরেই ভারসাম্য রক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের রাজ্যে কিন্তু ইতোমধ্যেই সেই সম্ভাবনা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। হ্যাঁ আসন্ন উৎসবের মরসুমের কথা বলছি। বস্তুত উৎসব শুরু হয়েই গেছে। আমাদের সবার ধারণা ছিল, এবারের দুর্গোৎসব কোন রকমে সমাধা করা হবে। রাজ্যে এবং দেশের অন্যত্র অন্যান্য উৎসবের ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখেছি — রথযাত্রা, গণেশ চতুর্থী, ঈদ, মহরম ইত্যাদি। অথচ এই রাজ্যের বৃহত্তম উৎসবটিকে সংক্ষিপ্ত করার কোনো চেষ্টা তো সরকার করলোই না, উপরন্তু লাগাতার উৎসাহ দিয়ে চলেছে। পূজা কমিটিগুলোকে নীতি এবং সংবিধান বহির্ভূতভাবে আর্থিক অনুদান দেওয়ার মধ্যেই প্রকট হয়ে আছে সরকারের উদ্দেশ্য। আমার নিজের এলাকার চিত্র এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, একটি ছদ্ম স্বাভাবিকতা তৈরি করার অপচেষ্টা চলছে। মানুষও সেই সরকারী উদ্যোগে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। যেন নোভেল করোনা ভাইরাস বিদায় নিয়েছে। বা একটু আধটু থেকে থাকলেও কারো কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই মানসিকতার ফলাফল যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। চিকিৎসক সংগঠনগুলো বারংবার সরকারকে সতর্ক করছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, বিজ্ঞান সংগঠন মানুষকে এবং সরকারকে অনুরোধ করছে উৎসবে রাশ টানার জন্য, বিধিনিষেধ বজায় রেখে উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোন হেলদোল আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূজা কমিটি এবং দর্শনার্থীদের জন্য সরকার থেকে বেশ কিছু নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে, ঠিকই। তবে সবার কাছে তা নিছক কথার কথা বলেই মনে হচ্ছে।
করোনা সংক্রান্ত অবশ্য পালনীয় বিধি-নিষেধগুলোর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। আর তা বজায় রাখতে গেলে কোনভাবেই কোন স্থানে বেশি মানুষের জমায়েত করা যাবে না। অথচ দুর্গোৎসব মানে হাজার হাজার মানুষের একত্র সমাবেশ। এবং তা পরপর কয়েক দিন। সরকারি উদ্যোগ এবং মুখ্যমন্ত্রীর পুজো উদ্বোধনের সূচি দেখে মনে হচ্ছে এবারেও মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েক উৎসব চলবে। অথচ এবারে সময়কাল ন্যূনতম করা উচিত ছিল। আসলে চিরকালীন সত্য হলো, রাজনীতির আঙিনায় রোগ-শোক, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, যুক্তি-বিজ্ঞান এসবই গৌণ। মুখ্য হলো ভোট, ক্ষমতা দখল এবং তার ব্যবহার ও অপব্যবহার। বোঝাই যাচ্ছে, বিধানসভা ভোটের আগে সরকার কোনো ঝুঁকি নেবে না। তাই অতিমারির এই আবহে সারা রাজ্য আজ উৎসবে মেতে উঠেছে। মেতে থাকবে মাসব্যাপী।
করোনা স্বাস্থ্যবিধির অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল পরিচিত বিষয় হলো, মাস্ক পরিধান এবং হাত ধোয়া। এমনিতেই এ দুটি অভ্যাস মানুষ ত্যাগ করতে পারলে বাঁচে, দুটিই বিরক্তিকর সন্দেহ নেই। এবং ঘটনা হলো, ইদানীং অনেকেই আর মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার – এই দুটোর ব্যবহারই খুব একটা করছেন না। করলেও তা অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক ভাবে। সেটা অবশ্য আগাগোড়াই। বাজারে অনেক ধরনের নিম্নমানের মাস্ক ও স্যানিটাইজার প্রথম থেকেই বিক্রি হচ্ছে। মাস্কের গুণগত মান তাও দেখে কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব, স্যানিটাইজারের ক্ষেত্রে তাও নয়। তার সঙ্গে ব্যবহার বিধির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত ঢিলেঢালা ভাব। আমার তো প্রথম থেকেই মনে হয়েছে কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে মাস্ক একটা বড় মাধ্যম। বারবার খোলা-পরা, হাত দেওয়া, পকেটে রাখা, অপরিচ্ছন্নতা, ইত্যাদি কারণে মাস্ক ব্যবহারে লাভের চেয়ে সম্ভবত ক্ষতিই হয়েছে বেশী। তবে সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সরাসরি রোগ ছড়ানো রোধ করতে মাস্কের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানা সম্ভব নয় কে করোনা সংক্রমিত, তাই মাস্ক আপাতত আমাদের সবাইকেই পড়তে হবে এবং তা যথাযথ নিয়ম মেনে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এ সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি ফলপ্রসূ হবে তখনই, যদি ভিড় এড়ানো সম্ভব হয়।
বিশ্বকর্মা পূজা ও মহালয়ার পর থেকেই রাজ্যের সংক্রমণ সংখ্যা দ্রুত ঊর্ধ্বগামী। করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদাসীনতার পরেও ঊর্ধ্বগামী। সংখ্যাগতভাবে পরীক্ষার পরিধি বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের বৃহদংশ পরীক্ষা প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। সংক্রমিত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের বাধ্যতামূলক পরীক্ষা হচ্ছে না। আমার ক্ষেত্রে হয়নি। এলাকার অন্যান্য ‘পজিটিভ কেস’-এর ক্ষেত্রেও না। ধরে নেওয়া যেতে পারে, সর্বত্র মোটামুটি এই নীতিই অনুসৃত হচ্ছে। আবার উপসর্গ যুক্ত অনেক ব্যক্তি বা পরিবার পরীক্ষা করাচ্ছেন না। উপসর্গ গোপন করছেন। কিছুদিন বাড়িতে থেকে একটু সুস্থ বোধ করলেই বেরিয়ে পড়ছেন। বিশেষত ‘পুজোর আনন্দ’ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই পরীক্ষা এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রায় সবার এখন ধারণা হয়েছে, কোভিড আক্রান্ত হলেও খুব ভয়ের কিছু নেই। সাধারণভাবে অল্পের উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু এতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে বয়স্ক এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, অর্থাৎ কোমরবিডিটি যুক্ত ব্যক্তিদের। হঠাৎ করে তাঁদের গুরুতর উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং এভাবে বাড়তে থাকলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার চাপ বহন করতে পারবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। উৎসব উদযাপনের আগে এই ভাবনাগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে আমরা হয়তো এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হব। অন্তত নিজ পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের কথা ভেবেই আমাদের সংযত হওয়া প্রয়োজন।
—————–
◾তথ্যসূত্র : ১। লেখচিত্র – ১ এবং লেখচিত্র – ২, রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইট; www.wbhealth.gov.in – এর corona bulletin থেকে নেওয়া।
২। লেখচিত্র – ৩, ডাঃ পুণ্যব্রত গুণের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
◾পুনশ্চ : এই লেখাটি তৈরি করে, টাইপ করে পোস্ট করতে করতে ষষ্ঠী এসে গেল। তার মধ্যে হাই কোর্টের রায় বেরিয়েছে, যা উৎসবের আতিশয্যকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে সবারই ধারণা। কিন্তু কোর্টের রায় কতটা বাস্তবায়িত হবে তা বলা মুশকিল। ইতোমধ্যে দুর্গোৎসব কমিটিগুলির পক্ষ থেকে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানো হয়েছে এবং এঁদের পক্ষে আইনজীবী এবং তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোর্টে আবেদন করেছেন।